আমরা এসে গেছি ডাক্তারবাবু—দরজাটা ফাঁকা করে সহাস্য মুখে সুহৃদবাবু বললেন।
—আসুন, আসুন। বাড়ির সবাই ভালো তো ?
—হ্যাঁ, ঠিকই আছি দুজনে। গত মাসে ছেলে এসে ঘুরে গেল। ভালই আছে ওরা।
এই দুলালের মাকে দেখানোর জন্য আপনাকে ফোন করেছিলাম। দেখুন ওনার জন্য কী করা যায়? আমার সহকারী ভদ্রমহিলাকে বসিয়ে দিল আমার সামনে রাখা চোখ দেখার যন্ত্রে। পরীক্ষা করে বললাম, “দুচোখেই ছানি পড়েছে বয়সে যা হয় আর কি। এক এক করে অপারেশন করতে হবে, বাম চোখটা আগে।’
—বেশ, ব্যবস্থা করে দিন।
—অবশ্যই হবে। কিন্তু এই গরমে কষ্ট করে আপনি এতদূর আসতে গেলেন কেন? দুলাল এসে দেখা করলেই তো হয়ে যেত।
—অচেনা জায়গায় প্রথম দিন সবারই একটু অসুবিধা হয়ে থাকে। এই চিনিয়ে দিলাম, এবার দুলাল মাকে নিয়ে নিজেই চলে আসবে। আমার সহকর্মী দুলালের মাকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। এই অবসরে সুহৃদ বাবু দুলালের পরিচয় দিলেন।
—ও আমার পাড়ার রিক্সাচালক, তার চেয়েও বড় কথা দুলাল আমাদের বড় সহায়। কয়েকমাস আগে আমি বাজার করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যাই। ও আমাকে তুলে নিয়ে কাছের নার্সিংহোমে ভর্তি করে দিয়ে বলে, ‘আপনারা চিকিৎসা শুরু করুন, আমি বাড়ির লোককে খবর দিচ্ছি।’ সে যাত্রায় এর জন্য বেঁচে যাই।
—এবারে বুঝলাম আপনি কেন নিজে এসেছেন। আপনাকে যতটুকু চিনি তাতে এটাই স্বাভাবিক।

অনেক বছর আগের কথা। তখন আমরা সপরিবারে চৈতন্যপুরে থাকতাম। সেদিন হাসপাতালে কাজ তখন প্রায় শেষের দিকে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল। আমি পূবের ওয়ার্ড থেকে পশ্চিমে অফিসের দিকে আসছিলাম। একটা অন্যরকম গানের সুর কানে ভেসে এল। কোথা থেকে আসছে? এ তো রেকর্ড নয়, খালি গলায় কেউ গাইছে। গানটা তো অফিসের উপরে আমার আবাস থেকেই আসছে। শুভ্রা তো হায়দ্রাবাদে, মায়ের গলাও তো এরকম নয়। তবে কে?
“হৃদয় আমার প্রকাশ হল অন্ত আকাশে…
আহা! কলেজে পড়ার সময় পঁচিশে বৈশাখে একবার জোড়াসাঁকোয় মেনকা ঠাকুরের কন্ঠে এই গান শুনেছিলাম। সেই দিনটাকে মনে করিয়ে দিল যে।
দোতালায় উঠতেই মা পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘‘এ হল প্রতিমা, কলকাতা থেকে এসেছে, কাল ওর স্বামীর চোখ অপারেশন হবে।’’ নমস্কার বিনিময় করে এক কাপ চা খেয়ে আবার আমি ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে চলে গেলাম। বিশেষ ভাবে খোঁজ নিলাম প্রতিমাদেবীর স্বামীর ব্যাপারে। ওনার একটা চোখে দৃষ্টি ভাল নেই— উন্নতির সম্ভাবনাও নেই, তাই যে চোখটা অপারেশন হবে, সেটাই ভরসা। ভদ্রলোক খুবই শান্ত প্রকৃতির, মনে হল গভীর কোনও চিন্তায় মগ্ন। আমিও মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম। বাড়ি ফিরে দেখলাম দুই ভদ্রমহিলা বেশ গল্পগুজব করছেন। যেহেতু প্রথম পরিচয়, তাই আমার আলাপচারিতা সীমিতই রইল।
রাতে একসাথেই মেঝেতে বসে তিনজনে ভাত খেলাম। বিশেষ কোনও আয়োজন নয়। ঘরে যা ছিল তাই ভাগ করে খাওয়া। প্রতিমা দেবী সলজ্জ ভাবে বললেন, চিকিৎসা করাতে এসে ডাক্তারের বাড়ি থাকা-খাওয়া এতো উপরি পাওনা।
—ভালই তো, আমরা অতিথি পেলাম।
—সে আপনি যা বলবেন বলুন, কিন্তু আমি কি এমনটা হবে ভাবতে পেরেছিলাম?
ভদ্রমহিলা ঘুমাতে যাবার পর মায়ের কাছে যা শুনলাম তা-ও আমার কল্পনার বাইরে ছিল।
স্বামীকে ভর্তি করে দেওয়ার পর উনি কিছুতেই সাধারণ যাত্রীনিবাসে একা থাকতে পারছিলেন না। আমাদেরই এক কর্মী ওনাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য ঘুরতে ঘুরতে আমার মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। কথায় কথায় উঠে আসে এক বিপর্যয়ের কাহিনী। ওনারা সদ্য নিজেদের কন্যাকে হারিয়েছেন— এখনও শোক সামলে উঠতে পারেননি। স্বামীর চোখের দৃষ্টি এতটাই কমে এসেছিল যে অপারেশন না করলে নয়, তাই হাসপাতালে আসতে হয়েছে।
ওর মনের অবস্থা জেনে মা বলেছিলেন, ‘‘থেকে যাও না আমাদের বাড়ি— এখানে ঘরের অভাব নেই।’’
সন্ধ্যাবেলা অনেক গান শুনিয়েছেন উনি খুবই দরদী কণ্ঠ। বলেছিলেন, ‘আগে রবীন্দ্রনাথের গান অর্থের গভীরে গিয়ে গাইতাম না, দিদি। এখন জীবন দিয়ে তার সত্য উপলব্ধি করি।’
পরদিন প্রতিমাদেবীর স্বামী সুহৃদবাবুর অপারেশন, অনেক দায়িত্ব আমার উপর। বিশেষ করে গতরাতে ওদের জীবনকথা জানার পর আমি আরও বেশি সাবধানী হয়ে গেছিলাম। সবার সহযোগিতায় অস্ত্রোপচার নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হল। দিনের কাজের শেষে ব্যান্ডেজ খুলে দেখলাম, চোখ ভালই আছে। সবার কাছেই এটা বড় স্বস্তির খবর। সুহৃদবাবু শুধু আমার হাতটা ধরে একটু হাসলেন। সেদিন সন্ধ্যায় প্রতিমাদেবীর সাথে একটু গল্প হল। এখন স্বাভাবিক ভাবেই উনি একটু মন খুলে কথা বলতে পারছেন। বললাম, পরের দিন সকালে দেখে ছুটি দিয়ে দেব।

সপ্তাহখানেক পর সুহৃদবাবু পরিকল্পনা মতো আবার দেখাতে এলেন। স্বচ্ছন্দে চলতে পারছেন দেখে খুব আনন্দ হলো। কুশল বিনিময়ের পর চিকিৎসার কাজ সারলাম। প্রেসক্রিপশানটা দিয়ে বললাম, “আবার মাসখানেক বাদে দেখিয়ে যাবেন, আশা করি এর মধ্যে আর কিছু সমস্যা হবে না, হলে অবশ্যই যোগাযোগ করবেন।’

—আমি এখন নিজের কাজকর্ম শুরু করতে পারি?
—নিশ্চয়ই পারেন। বিশেষ কি করতে চান?
—কম্প্যুটর? চোখের ক্ষতি হবে না তো?
—নিশ্চিন্তে করুন, আলো অসহ্য হলে আমাকে জানাবেন।
একমাস পর যথারীতি আবার দেখা।
—ভাল আছেন তো ?
—অনেক ভাল, ডাক্তারবাবু। বই পড়তে পারছি— এটাই আমার কাছে জীবন ফেরত পাওয়ার মতন। লিপিকা আবার পড়ে ফেললাম, গল্পগুচ্ছ নতুন করে শুরু করেছি।
—বসুন, চোখটা দেখি।
—সে হবে। আমার এই উপহারটা গ্রহণ করলে খুব খুশি হবো। তিনটে গানের সিডি আছে। দৃষ্টিটা ফিরে আসতে অবসর সময়ে বসে বসে আমার পছন্দমতো সংকলনটা তৈরি করেছি। জানিনা, আপনার পছন্দ কতটা মিলবে।
—অবাক কাণ্ড! আমার জন্য ঠিক এই উপহারটা বাছলেন কি করে?
—বলব?
—হ্যাঁ, বলুন।
—আমার অপারেশনের সময় আপনি গুনগুন করে গান গাইছিলেন। ওটা আমাকেও কতটা শান্তি দিয়েছে জানেন না।
—আমি কিন্তু গায়ক নই, লজ্জা পেয়ে গেলাম। কোনওদিন গানের চর্চাও করিনি।
—তাতে কি হয়েছে? গান তো মনের থেকে সৃষ্টি হয় মনের জন্য। আপনি না বললেও আমার মনে হয় আপনার যথেষ্ট গান শোনার অভ্যাস আছে।
—তা আছে। তবে বেশীরভাগই রবীন্দ্রসঙ্গীত।
—ভাল খুঁটি ধরেছেন।
সুহৃদবাবু হেসে বিদায় নিলেন।
আমার তো আর তর সইছে না, দেখি কি কি গানের সম্ভার আছে তিনটে সিডিতে। সন্ধ্যাবেলা আগ্রহ নিয়ে ল্যাপটপটা খুলে বসলাম। প্রচুর গান— সবই তো আমার প্রিয় শিল্পীদের খুব পছন্দের সৃষ্টি, রেকর্ডের বেশিরভাগই রবীন্দ্রনাথের গান, কিছু আছে অতুলপ্রসাদী। বেশ কিছু স্বল্প পরিচিত গানও আছে …কতদিন পর ওগুলো শোনার সুযোগ পেলাম। কিন্তু সুহৃয়বাবুর সঞ্চয়ন আর আমার পছন্দ কিভাবে যে এতটা মিলে গেল সেই রহস্য তো কিছুতেই কাটছে না। কৌতূহল আর চাপা যাচ্ছে না, ফোন করেই ফেলি।
—হ্যালো।
—গান শোনার সময় হয়েছিল?
—হয়েছিল মানে? একটা প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না, তাই ফোন করলাম।
— এমন কি জিজ্ঞাসা?
আমার পছন্দ আপনার সাথে কি করে এভাবে মিলে গেল?
—তাহলে আমার আন্দাজ ঠিক আছে দেখতে পাচ্ছি।
—সেই অমূল্য আন্দাজটা কি করে হল? এটাই তো বিস্ময়।
—কি বলি বলুন তো? বলেই দিই।
—হ্যাঁ, বলুন, অপেক্ষা সইছে না।
—আপনার গান শুনে মনে হয়েছিল আপনি সুবিনয় রায়ের গান পছন্দ করেন। আমিও ওনার খুব ভক্ত, তাই কাজটা সহজ হয়ে গেল, নিজের পছন্দে মিলিয়ে দিলাম।

এ তো নমস্য সমঝদার গোয়েন্দা! খুব হাসলাম।
—আর আমার আনন্দটা শুনুন— যখন চিন্তা-দুশ্চিন্তায় ডুবে আছি, তখন আমার এক মনের সঙ্গী পেয়ে গেলাম। রবি ঠাকুর কোথায় নিয়ে চলে গেল। আপনি আমাকে এক অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার স্বাদ দিলেন।
—ঘটক কিন্তু রবীন্দ্রনাথ।
অন্তত একদশক কেটে গেছে ইতিমধ্যে। বয়স সবারই বেড়েছে। তার সাথে বেড়েছে আমার কাজের ব্যস্ততা। নিজের মনের যত্ন নিতে যেন ভুলে গেছি— যে শখগুলো এককালে আদর করে লালন করেছি তারা কোথায় হারিয়ে গেছে মনে হয়। সুহৃদবাবুর সাথে বছরে অন্তত: একবার দেখা সাক্ষাৎ হয় — চিকিৎসা ছাড়া দু-চারটে মনের কথা বিনিময় হয়। মাঝে মাঝে সুরের উপহার এখনও পাই। দুলালের মাকে দেখিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় উনি একবার আবার আমার ঘরে ফেরৎ এলেন। প্রবীণ মানুষ, হয়তো আমাকে দেখে কিছুটা অন্যরকম মনে হয়েছে।
—ডাক্তারবাবু, এখনও গান শোনার অভ্যাস আছে তো?
—না তেমন নেই। আছে বললে ভুল বলা হবে। সব চাপা পড়ে গেছে মনে হয়।
—সে কি! এ কেমন কথা?
ইদানিং আমার কর্মক্ষেত্রে মনের সাথে বহু যুদ্ধ করতে হচ্ছে— তাই শখের কথা প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে।
—এমন ভাবতে নেই, রবীন্দ্রনাথ আছেন না। আমি আরও গানের সংগ্রহ দেব আপনাকে— সব বিরল কন্ঠের সংকলন। ভাল থাকবেন।
সুহৃদবাবু চলে গেলেন, আমি মনে মনে নানান কথা ভাবতে লাগলাম। তাই তো, ‘রবীন্দ্রনাথ আছেন না’। রবিঠাকুর চলে যাননি, ছুটি নিয়েছেন সাময়িক, ডাকলেই আবার আসবেন গানের সুরে জাগিয়ে তুলতে।