ডাক্তারি এবং শিক্ষকতা – এই দুটি পেশাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে মর্যাদামণ্ডিত করার জন্য বছরে দুটি দিন ধার্য রয়েছে। দু’টির একটিও নাকি প্রকৃত অর্থে পেশা নয় —ব্রত। ডাক্তারদের কথা বরং আপাতত তোলা থাক। প্রতি বছর একটি বিশেষ দিনে ঘটা করে শিক্ষকদের সম্বর্ধনা দেবার যে উৎসব, সেই শিক্ষক দিবসের মাহাত্ম্য বুঝে ওঠা সত্যিই দুস্কর। বস্তুত, সেকালের শিক্ষককুলের যে দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত জীবন, তাতে মহত্ত্ব আরোপ করার পেছনে যা ছিল, সেটা রাজনীতি ছাড়া কিছু নয়। গরিবির গায়ে মহত্ত্বের আলোয়ান মুড়ে দিলে অষ্টপ্রহরের অভাব-দীর্ণ জীবনে শিক্ষককুল একটু হলেও আত্মশ্লাঘা বোধ করবে, সামাজিক গ্লানির জর্জরতা থেকে রেহাই পাবে, এই-ই ছিল মতলব। হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান — এই

মনস্তাত্ত্বিক সন্তোষটুকু যুগিয়ে দেওয়াই ছিল সমাজ-কর্তাদের গভীর অভিপ্রায়। শিক্ষা দানের ব্যাপারটিকে মহান ব্রত হিসেবে উপস্থাপিত করতে পারলে, ব্রতধারীদের দারিদ্র্যের ওপর তা সান্ত্বনার প্রলেপ হিসেবে কাজ করবে। এই অভিপ্রায়ের আড়ালে বসে এই উপেক্ষিত বৃত্তিধারীদের কাছ থেকে আদর্শের পরাকাষ্ঠা দাবি করা হযেছে চিরকাল।

শিক্ষকতাকে যদি সত্যিই সম্মানিত পেশা হিসেবে মান্য করা হতো, তাহলে সেই মধ্য-উনিশ শতকে কাঙাল হরিনাথ শিক্ষকতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত হতেন না। হিন্দু কলেজ থেকে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র মতো শিক্ষক-কে হতমান করে বিতাড়িত করে রামকমল সেনের বাড়ির পাচককে সেই পদে নিযুক্ত করা হতো না। বৌবাজার মেট্রোপলিটান স্কুলের প্রধান শিক্ষক নরেন্দ্রনাথ দত্ত-কেও পদ ছেড়ে অপমানজনক ভাবে বিদায় নিতে হতো না। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছেন, শিক্ষকতার চাকরি পাওয়া সেন পরিবারের সেই পাচকের পড়ানোর কোনও যোগ্যতাই ছিল না। কিন্তু ছাত্ররা যাতে তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ না করে, তাই তাদের খুশি রাখার জন্য কলেজ স্কোয়ারে তাদের সঙ্গে ইয়ারদোস্তের মতো মেলামেশা করে ঘন ঘন পানের খিলি কিনে আনার ফরমায়েস করতেন। সেই সঙ্গে চলতো দিলখুশ আড্ডা। তাঁর ক্লাস থেকে ছাত্ররা নিস্তার পাবার জন্য মুখিয়ে থাকতো। পাচক থেকে পণ্ডিত হয়ে ওঠা এই ব্যক্তির প্রসঙ্গ স্বভাবসিদ্ধ ব্যঙ্গ ও রসিকতায় মুড়ে দিয়েছেন হুতোম, তাঁর বইটিতে। এই পাচক ঠাকুরের ছাত্রদের একজন ছিলেন রাজনারায়ণ বসুও। তিনি লিখেছেন, ‘তাঁহার সঙ্গে আমরা রান্নার গল্প করিয়া সময় কাটাইতাম’। হিন্দু কলেজের পরিচালন সমিতির এই পদক্ষেপ কি কোনও ভাবে শিক্ষক সমাজের মর্যাদা রক্ষার পক্ষে সহায়ক হয়েছিল? কে জবাব দেবে? হিন্দু কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানের বিদগ্ধ পরিচালকদের দৃষ্টিতেই যদি ওই পাচক ঠাকুর ডিরোজিওর চেয়ে যোগ্যতর শিক্ষক বিবেচিত হয়ে থাকেন, তাহলে সাধারণ মানসিকতায় শিক্ষকদের স্থান কোথায়, তা সহজেই অনুমেয়।

মাস্টারির হাল-হকিকৎ নিয়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র লিখেছেন, ‘যার আর কিছুই হল না, তিনি হয় হোমিওপ্যাথির বাক্স নিয়ে বসেন, নয় করেন স্কুলমাস্টারি’। তেমনই প্রণিধানযোগ্য জীবনানন্দ দাসের নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি, ‘খুব ভালোবেসে যে শিক্ষকতার কাজ নিয়েছিলাম একদিন, তা বলতে পারব না। শিক্ষকতায় লিপ্ত হয়ে থাকতে যে খুব ভালো লেগেছিল, তা-ও নয়’।

শুধু আজ বলে নয়, কোনও কালেই আমাদের সমাজ আত্মমর্যাদাবোধ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শিক্ষকদের সহ্য করতে চায়নি। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের স্কুলে প্রধান শিক্ষক নরেন্দ্রনাথ দত্তের (পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ) প্রতাপ সহ্য করতে না পেরে সম্পাদক সূর্যকুমার অধিকারী ষড়যন্ত্র করে তাঁকে বিতাড়িত করেছিলেন। মনোজ বসুর কালজয়ী ‘মানুষগড়ার কারিগর’ উপন্যাসে হেডমাস্টার দিব্যেন্দুধর দাশ স্কুলের ঘেরাটোপের মধ্যে ছিলেন এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যক্তিত্ব। তাঁর ভয়ে থরহরি স্কুলের শিক্ষক-কর্মী-ছাত্রছাত্রী প্রত্যেকেই। সেই দাশমশাইকে স্কুলের সম্পাদকের বাড়িতে হত্যে দিয়ে থাকতে হতো চোরের মতো। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সন্ধ্যা থেকে অনেক রাত অবধি তাঁকে বাইরের ঘরে বসিয়ে রেখে একটিও বাক্যবিনিময় না করে বিদেয় করে দেন সম্পাদক মশাই। ওই উপন্যাসের নায়ক মহিম আদর্শবাদী শিক্ষক হয়ে উঠতে চাইলেও মেধাবি ছাত্র হিসেবে তিনি কিন্তু এই বৃত্তি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতে নারাজ ছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল কর্পোরেশনের লাইসেন্স ইন্সপেক্টর হওয়া। তাই শিক্ষক হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে তাঁর বেজায় সঙ্কোচ।বলে দেবার প্রয়োজন নেই যে এই উপন্যাসটি মনোজ বসুর কর্মজীবনের দলিল। তিনি সাউথ সাবার্বান স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। সেখানে লব্ধ অভিজ্ঞতাই ছদ্মবেশে উঠে এসেছে তাঁর উপন্যাসে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অনুবর্তন’ উপন্যাসটিও কি ভিন্নরঙে আঁকা কোনও জলছবি? সেখানেও তো প্রায় একই আখ্যান।

আজকের সময়ে যেমন রাজনৈতিক কেষ্টবিষ্টুরা স্কুল-কলেজের পরিচালন সমিতির মাথায় চড়ে বসে থাকেন, সেকালে বিদ্যালয় পরিচালনার ওই মগডালটি সংরক্ষিত থাকতো সমাজের বিত্তশালী, প্রভাবশালী ব্যক্তি, বিশেষত আইনজীবিদের জন্য। শিক্ষকদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে, তাঁদের অর্থনৈতিক অসহায়তার সুযোগ নিয়ে অপমান করে যারপরনাই আত্মপ্রসাদ লাভ করায় ছিল প্রবল পরিতৃপ্তি। আবার নামমাত্র বেতনে অর্থসংকট ঘোচাতে অপারগ শিক্ষকরা যখন গৃহশিক্ষকতায় বাধ্য হয়ে স্কুলের পর ক্লান্ত পায়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন, সেই সব স্বচ্ছল, শিক্ষিত, তথাকথিত ভদ্র পরিবার থেকেও পদে পদে জুটতো উপেক্ষা, লাঞ্ছনা, তীব্র অপমান। শুধুমাত্র জীবিকা নির্বাহের তাগিদে সেসব মুখ বুজে সহ্য করে যেতেন তাঁরা।

ডঃ সর্বেপল্লি রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিনটিই ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা তাঁর জন্মদিন পালন করতে চাইলে তিনি ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, নিছক জন্মদিন নয়, এদিনটিই পালিত হোক ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে। অমরত্ব লাভের জন্য তাঁর এই আবদার স্বীকৃত হয়েছিল। তিনিও দীর্ঘকাল শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকার পর রাষ্ট্রনায়কের পদে আসীন হওয়ার প্রলোভন জয় করতে পারেননি। অথচ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি নাকি সদাই উদ্বিগ্ন ছিলেন। রাষ্ট্রনায়কের পদ লাভ করার পর নিজের সেই উদ্বেগ নিরসনে তিনি কতটা তৎপর হয়েছিলেন, বলা কঠিন। তবে বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি যখন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্দশা নিয়ে হাহাকার করেছিলেন, তখন সৈয়দ মুজতবা আলী খুব সংগত ভাবেই অতীব বিনয়ের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, ‘স্বয়ং রাধাকৃষ্ণনের যদি শিক্ষায় দরদ থাকতো, তবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে উপরাষ্ট্রপতি হতে গেলেন কেন’? এর উত্তরের অনুসন্ধান করতে হলে ফের আশ্রয় নিতে হয় ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ উপন্যাসের কাছে। বৃত্তির সঙ্গে বিশ্বাসের কোনওদিনই মিল খুঁজে পাননি মহিম মাস্টারের শিক্ষক সূর্যকান্ত। তিনি বলতেন, ‘পড়ো, কিন্তু এসব বিশ্বাস কোরো না’।

একথাও ঠিক, আজকের শিক্ষককুল জাত খোয়ানোর পেছনে নিজেদের দায় অনেক ক্ষেত্রেই অস্বীকার করতে পারবেন না। এই বৃত্তিধারীদের প্রতি সমাজের বীতরাগ উত্তরোত্তর বেড়েছে তো বটেই। যে অভিযোগের বর্শামুখ একটা সময় অবধি নিশ্চিত ভাবেই সমাজের দিকে তুলে ধরা যেত, তাতে এখন যে তাঁরা নিজেরাই বিদ্ধ হচ্ছেন, তা অবশ্যই অকারণে নয়। সমাজ এখন যুৎসই হাতিয়ার পেয়ে গেছে যা এতকাল ছিল না। তবে সবাইকে নিশ্চয়ই এক গোত্রে ফেলা সমীচীন নয়। অমর্ত্য সেন কিংবা শঙ্খ ঘোষের মতো শিক্ষকেরাও যখন নিজের দেশ ও রাজ্যের অর্বাচীন রাজনীতিকদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের পাত্র হয়ে ওঠেন, তখন বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না যে এই বৃত্তিধারীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সেকাল এবং একালের মধ্যে তারতম্য বিশেষ ঘটেনি। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। শেষ বিচারে প্রকৃত শিক্ষকের মর্যাদা ও সম্ভ্রমের নিশান শুধুমাত্র তাঁর মুষ্টিমেয় শিক্ষার্থীদের হাতেই ওড়ে– সেকালেও, একালেও।

তথ্যনির্দেশ

১. হুতোম প্যাঁচার নকশা: কালীপ্রসন্ন সিংহ

২. আত্মচরিত: রাজনারায়ণ বসু

৩. Annual Report of The Oriental Seminary 1922

৪. সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী, ২য় খণ্ড

৫. শিক্ষাদীক্ষা: জীবনানন্দ দাস (বিভাব পত্রিকা, জীবনানন্দ সংখ্যা)

৫. মানুষ গড়ার কারিগর: মনোজ বসু