ভাইফোঁটা সেরে মেয়েকে নিয়ে ট্রেনে বাড়ি ফিরবো। ছোড়দির বিরাটির বাড়ি থেকে ফোঁটা সেরে ট্রেনে শিয়ালদা।
বিরাটি স্টেশনে এসে মানুষের ভিড়ে চোখে পড়ল একজোড়া বিদেশী। ওদের উচ্চতা-গায়ের রং-সাজপোশাক খুব সহজেই আমাদের থেকে আলাদা করে। ওদেশে কাপল মানেই যে বিবাহিত হতে হবে, এমন মাথার দিব্যি নেই। বোঝাপড়া দিয়ে সুস্থ-সহাবস্থানটুকুই যথেষ্ট। জন্মসূত্রে বাঙালি আমি, তাই আড়িপাতা মজ্জাগত গুণ। বুঝলাম, গুগল ম্যাপে তারা কিছু একটা বুঝে নিতে চাইছে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বুঝলাম, ওদের জিজ্ঞাস্য খুব সামান্যই। শিয়ালদা যাবার ট্রেন কোন দিক থেকে আর কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে মিলবে? ইতিমধ্যে তিন-ভাষাতেই দু-তিনবার ডাউন বনগাঁ লোকাল ট্রেনের ঘোষণা হয়েছে। ওরা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু দুজনেরই শরীরী ভাষায় একটু চঞ্চলতা। আন্দাজ করলাম, হয়তো স্টেশনে ঘোষিকার ইংরেজিটা গুগল ম্যাপের বলা ভদ্রমহিলার মতো স্পষ্ট নয়, অথবা সাহেবের কানের কোনও সমস্যা। আমার শিশুকন্যা তো অতি উৎসাহী হয়ে চেপে ধরেছে “বাবা, তুমি আরেকবার ওদের সঙ্গে কথা বল”। অগত্যা আমিও দেশীয় সৌজন্যে তাদের সঠিক প্লাটফর্ম বুঝিয়ে দিলাম এবং জানালাম আমাদেরও গন্তব্য একই পথে। কামরা থিক থিক করছে ফোঁটা দেওয়া আর নেওয়া ভাইবোনেদের ভিড়ে।

তাই ১২ বগির লোকালটা ছেড়ে দিলাম। কারণ, মেয়েকে নিয়ে বসেই ফিরতে চাইছিলাম আর ফেরার তেমন তাড়াও ছিল না। ট্রেন দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল, প্লাটফর্মে এখন অনেকটা ভিড় পাতলা। খেয়াল করলাম, সাদা যুগলও প্লাটফর্মে, মানে তারাও ট্রেন ধরতে পারেনি। ভিড়ের কারণে আগে নজরে পড়েনি, এখন চোখে পড়লো দুজনের পিঠের রুকস্যাক ছাড়াও হাতে কিছু বড় লাগেজ আছে। যুগলের পোশাক, মোবাইল ফোন আর জুতো অতি সাধারণ। মিনিট দশেক পরে প্রায় ফাঁকা ডাউন দত্তপুকুর লোকালের এক বগিতে মেয়েকে নিয়ে চেপে বসলাম। বিদেশি যুগলও একই বগিতে। আবার মেয়ের আবদার,”বাবা, কথা বলো”। মেয়ের নাছোড় আবদারে জিজ্ঞাসা করে বসলাম, কোন দেশ থেকে এদেশে আগমন আর কি তাদের মাতৃভাষা? আর পাঁচটা সাধারণ ভারতীয়দের মতোই আমার মেয়েরও ধারণা সাদা চামড়া হলেই বুঝি ইংরেজিভাষী। সেই ভাবনায় আঘাত করে লাতিন উচ্চারণে অত্যন্ত ভাঙা ইংরেজিতে জানালো সুদূর আর্জেন্টিনা থেকে তিন মাসের জন্য তারা ভারত ভ্রমণে এসেছে। এবং তাদের মাতৃভাষা স্প্যানিশ। একমাস উত্তর ভারত ঘুরে কলকাতা হয়ে দার্জিলিং যাবে।
বিষয়টাতে খুব একটা নতুনত্ব নেই, কারণ বাস্তবে ইউরোপ-আমেরিকা বা পশ্চিমী দেশগুলো ঘোরার যে খরচ তার চেয়ে অনেক কম খরচে বেশিদিন ধরে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ঘোরা যায়, দেখা আর শেখাও যায় ঢের বেশি।


প্রথম এক মাস ইন্ডিয়া ট্যুর করে তারা এইটুকু বুঝেছে এদেশের মানুষ তাদের মাতৃভূমি সম্পর্কে শুধু দুটি তথ্য জানে– ফুটবল, মেসি-মারাদোনা। সুবিস্তৃত আর্জেন্টিনা দেশটির যে বহুমাত্রিক সত্তা রয়েছে, তা জানতে ভারতীয়রা তেমন আগ্রহী নয়। তাই যখন আমার মুখে ক্যাপিটাল বুয়েনাস এয়ার্স, আন্দিজ পর্বতমালা, পম্পাস তৃণভূমির কথা শুনলো, স্পষ্টতই তাদের খুব ভাললাগা লক্ষ্য করলাম। কথা এগোতে জানলাম সবুজ চোখের মেয়েটির বয়স ৩১, নাম মারিয়া ফেরেরা। আই.টি ফার্মে কর্মরত ছিলো আর ৩৬ বছরের ফিজিক্স পড়া জুয়ান মার্কোজ একটি রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার। দুজনেই চাকরি ছেড়েছুড়ে জমানো টাকা নিয়ে ভারত ভ্রমণে এসেছেন। ভারতে তিন মাস ঘোরার জন্য ওঁরা দু’জনে বাজেট করেছিলেন ১৫ লাখ টাকা। এখন বুঝতে পেরেছেন ব্যাপারটা তার চেয়ে অনেক কমেই সারা হয়ে যাবে। মেয়েটা জানলা দিয়ে বাইরে দেখছে রেললাইনের ধারের ঝুপড়ি, খাটা পায়খানা। যদিও কোনও বিরক্তির উদ্রেক হচ্ছে না মুখে। বিধাননগর ছাড়ার পর ওদের প্রশ্ন করেছিলাম, ক্যারিয়ারের শুরুতে এরকম অনিশ্চয়তায় ভরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস কি করে পায়? সাতদিনের পুরী ঘুরতে গেলেও আমাদের বিরাট প্রস্তুতি লাগে। কিন্তু ওরা সব ছেড়েছুড়ে এভাবে বেরিয়ে পড়েছে,
এরপর তাদের ভবিষ্যৎ কি?
স্বল্পভাষী মারিয়া মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, ‘সেলেব্রা লা ভিদা’। কিছই বুঝলাম না বুঝে মার্কোস বললেন, জীবনটা ক্যারিয়ারের চেয়ে অনেক বড়। মানুষকে যে ঈশ্বর যে প্রকৃতি সৃষ্টি করেছে তাকে লালন-পালনও সেই প্রকৃতিই করে নেবে। ভাল ক্যারিয়ার ও তথাকথিত সাকসেস নিয়ে ওদের কোন মাথা ব্যথা নেই। জীবন একটাই, তাই তাকে প্রতি মুহূর্তে উদযাপন করতে হবে— ‘সেলেব্রা লা ভিদা’ যার ইংরেজি করলে হয় Celebrate the Life ।

1 COMMENT

  1. ছোট্ট অথচ ভারী মনোগ্রাহী লেখা।

    সত্যিই তো, আমরা কেরিয়ার, সাফল্য ইত্যাদি বুনোহাঁসের পেছনে ছুটতে গিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কত সৌন্দর্য্য কে উপেক্ষা করি।

Comments are closed.