“হাতির বাচ্চাটা আমাদের বাড়িতেই হইসিল। তাই কদিন আগে ওর এক বছরের জন্মদিন আমাদের বাড়িতেই হইল। আপনাকে ছবি দেখাব, ম্যাডাম।” ধূপঝোড়ার রিসর্টে দুপুরে খাবার বেড়ে দিতে দিতে অজয় বলতে থাকে। আজই সকালে কলকাতা থেকে আমরা উত্তরবঙ্গে পৌঁছেছি। আসার কথা ছিল আগামিকাল। ঘটনাচক্রে একদিন আগেই চলে আসতে বাধ্য হলাম। বাধ্যই যখন হলাম তখন দিনটার সদ্ব্যবহার তো করতেই হয়। চিন্ময়ের শরণাপন্ন হতেই এককথায় বলল,“পাহাড়ে তো ক’দিন যাবিই, একদিন না হয় ডুয়ার্সে কাটিয়ে যা।”এখন দিনটা মনে হচ্ছে উপরি পাওনা।
ধূপঝোড়াতে এসে থেকেই প্রকৃতির কোমলতা প্রতি পদে অনুভব করতে পারছি। সামনেই মূর্তি নদী, ওপারে গোরু চড়ছে, আবার অনায়াসে নদী এপার-ওপার করছে, আর একটু দূরে তাকালে দিগন্ত বিস্তৃত গোরুমারার জঙ্গল। ডুয়ার্সের নায়ক তো হাতি, তাই স্থানীয় লোকের সাথে এক কথা দুই কথা বলতে গেলে হাতির প্রসঙ্গ উঠে আসবেই। চাষিদের বিস্তর আতঙ্ক ঘিরে থাকে গজবাহিনীকে ঘিরে। রাত জেগে ফসল রক্ষা করা যেন তাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। কিন্তু অজয়ের মুখে হাতিকে ভালবাসার গল্প আমাদের ক্ষিদের পেটে গরম ভাত দিয়ে মুরগির ঝোল খাবার থেকেও বেশী আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল।

—আমাদের গ্রামের হাতি কোনও ক্ষতি করে না। সবাই তাদের আদর করে খাইতে দেয়। ওরা একটাও গাছ ভাঙে না। ভাত আর ডাল সিদ্ধ কলা পাতায় সাজাইয়া দিতে লাগে, গুড়ও খায়।
—তুমি হাতি সম্পর্কে এত কিছু জানলে কি করে ?
—আমার বাবা তো মাহুত। ছোট থেকেই জঙ্গলে থাকার অভ্যাস আছে বাবার সঙ্গে। কত হাতিরে
স্নান করাইসি, পিঠে চড়সি। রাত্রে যখন ডিনারে আসবেন তখন জন্ম দিনের ভিডিও দেখাব।
কী সাবলীল বন্ধুত্বের গল্প। ছবি দেখার অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু ছেলেটা আমার মনকে আর এক অরণ্যে টেনে নিয়ে গেল।
মাসখানেক আগেই ক’টা দিন মাদারিহাটে একটা কাজের জন্য থাকতে হয়েছিল। হঠাৎ পরিচয় ঘটে আমার এক বন্ধুর ছাত্রীর সাথে। শরণ্যা এবং শুভঙ্কর দু’জনে এসে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে যায় ওদের সরকারী নিবাসে অতিথি হবার জন্য। যুগলের আন্তরিক অনুরোধ ফেলতে পারিনি, তার উপর জঙ্গলের মধ্যে রেঞ্জার সাহেবের বাংলো দেখার সুযোগ ছাড়ে কে?
পরদিন কালচিনিতে কাজ সেরে বিকেলে মাদারিহাট পৌঁছতেই শুভঙ্কর ওর গাড়িতে আমাকে নিতে এল।
—তাড়া নেই তো আপনার?
— না না। রাতে ফেরার অসুবিধা না থাকলেই হল। রাতে ফিরতেই হবে, কারণ পরদিন বেশ সকালেই আবার যেতে হবে।
—সে যত রাতই হোক, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাব।
বনকর্তার হাতেই যখন সব তখন বনে আর চিন্তা কি? গাড়ি এগোতে থাকে বড় রাস্তা ছেড়ে হলংয়ের দিকে। দু-চারটে ময়ুরকে ঘুরতে দেখা যায় এদিক ওদিক। যাবার পথের ডান দিকটা পুরোটাই টানা ধাতব তার লাগানো খুঁটির সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ওটা হাতিকে বনের বাইরে যাওয়া ঠেকানোর জন্য। মৃদু বিদ্যুৎ চলাচল করে তাতে, হলকা ঝটকায় যাতে ওরা পিছিয়ে যায়।
হাতিকে নিয়ে নানান কথা চলতে থাকে। সাধারণ ভাবে গজকূল পূজিত প্রাণী হলেও অরণ্যসীমাবর্তী মানুষের কাছে এরা কখনও কখনও ত্রাসের কারণ হয়ে যায়। মূলতঃ খাদ্যের সন্ধানেই লোকালয়ে প্রবেশ করে আর এমন ফসল নেই যে তার ক্ষতি করে না। চা গাছটাই এখনও পর্যন্ত ব্যতিক্রম। হাতির প্রিয় খাদ্য বট, অশ্বত্থ আর ডুমুর পাতা। বনদপ্তর থেকে তাই শাল সেগুনের মাঝেও এই গাছ গুলো রোপন করে হচ্ছে। উদ্দেশ্য, যদি বনেই খাবার জোটে তাহলে ঐরাবত আর লোকালয়ে যাবে না।

জঙ্গলের মধ্যে বেশ খানিকটা যাবার পর গাড়ি বদল হল। রেঞ্জার সাহেব তার নির্দিষ্ট শকটে সান্ধ্য পরিদর্শনে বেরোবেন। এই রাউন্ডে আমি সঙ্গী হব— সেই পরিকল্পনা করাই ছিল। চলতে চলতে যদি কোন অরণ্যচরের দেখা মেলে, সেটাই পাওনা। তাদের দর্শন না হলেও গভীর অরণ্যে আধা আলো আধা অন্ধকারে ঘুরে বেড়ানোও তো এক অনন্য অভিজ্ঞতা— সেটাই তো বড় ব্যাপার।
একটা মজবুত গাড়িতে বসলাম। সামনে চালকের আসনের পাশে শুভঙ্কর— ওটাই রেঞ্জার সাহেবের নির্দিষ্ট সীট চতুর্দিকে নজর রাখার জন্য। দ্বিতীয় সারিতে আমি আর অন্য একজন বলিষ্ঠ চেহারার বনকর্মী জন বড় টর্চ হাতে। গাড়িটার একটা বিশেষত্ব চোখে পড়ল— জানলার কাঁচের নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই চালকের হাতে।
মূল রাস্তা ছেড়ে আমরা ডানদিকে জঙ্গলে ঢুকলাম। রাস্তা তো নয়, গাছপালার মাঝে ফাঁকা জায়গায় মাটিতে চাকার ছাপ ধরে ধরে চলা। এই পথ ধরেই ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর অরণ্যের দিকে আমরা চলতে লাগলাম। ভাগ্য সহায়, একটু পরেই একটা গণ্ডার আর কয়েকটা বাইসনের দেখা মিলল। বর্ষাকাল বলে ঝোপের গাছগুলো অনেক ঘন এবং উঁচু হয়ে গেছে। তাই শিংগুলোই দেখা যাচ্ছে মাত্র। গাড়ি চলতে চলতে মাঝে মাঝেই গাছের ডাল জানালার ফাঁক দিয়ে গা ঘষে দিয়ে যায়। চালক কাঁচটা তুলে দিলেন। কখনও কখনও কোনও গাছের সাথে ঘর্ষণে সুন্দর বুনো গন্ধ আসে…যার তুলনা কোনও পারফিউমের সাথে মেলে না। গাড়ি বুড়ি-তোর্সার কিনারে একটু দাঁড়াল, যদি কোনও বন্য পশু জল খেতে আসে, তবে দেখা যেতে পারে। কারও দেখা না হলেও পড়ন্ত সূর্যের আলোয় জায়গাটা বড় মায়াবী দেখাচ্ছিল। সূর্যাস্ত হতেই আমরা অন্যদিকে এগিয়ে গেলাম। গাড়ি আর এগোতে পারে না। সামনে দু’টো দলছুট গোরু। সরু রাস্তায় ওদের টপকে যাওয়ার উপায় নেই— ভয়ের চোটে ওরা ঝোপের মধ্যে সরে দাঁড়াতে তবে এগোনো গেল। সূর্যের আলো আরও কমে যাচ্ছে, বন্যজন্তু আর দেখার সম্ভাবনা আর নেই; ভাগ্যক্রমে গাড়ির আলোর সামনে কিছু শ্বাপদ চোখে পড়লেও পড়তেও পারে। কিন্তু দূরে ওটা কি দেখা যাচ্ছে? ওটা তো দ্বিপদ একজন মানুষ।

গাড়িটা কাছে যেতেই দেখা গেল একজন মধ্য বয়সী যুবক। প্যান্টটা হাঁটু পর্যন্ত গোটানো, ময়লা নীল জামার বোতাম নাভি পর্যন্ত খোলা, গর্তে জমা জল দিয়ে চোখ মুখ ধুচ্ছে। এই কোর এরিয়া, যেখানে সাধারণের প্রবেশ একেবারে নিষেধ সেখানে এই লোকটা কি করে এল? উদ্দেশ্যই বা কি? রেঞ্জার সাহেব এবার হঠাৎ বদলে গেলেন। এতক্ষণ অরণ্যের নানা বিষয়ে অনর্গল বর্ণনা দিচ্ছিলেন, কোথায় ছোট ছোট আকর্ষনীয় দ্রষ্টব্য আছে, তা দেখাচ্ছিলেন। এখন তার বিরাট দায়িত্ব— আগন্তুকের পরিচয় উদ্ঘাটন এবং পরবর্তী কর্তব্য পালন।
—এই, তোর নাম কি?
—মহাদেব।
মহাদেবই বটে। চালচুলো নেই, বাউন্ডুলে।
—বাড়ি কোথায়?
—উদালগুড়ি।
—সাথে কে আছে ?
—কেউ নেই।
—এখানে কেন?
কোনও উত্তর নেই, শুধু এক শূন্য দৃষ্টি।
—জন, একে গাড়িতে তোল।
ও দুটো থাপ্পড় মেরে গাড়িতে এনে পিছনের দরজা খুলে বসালো মহাদেবকে। একেবারে আমার পিঠ ঘেঁষে— মুখোমুখি পাহারায় জন। কে জানে বাবা? পকেটে কোন অস্ত্র নেই তো? বনকর্তা সামনের ওয়াচ টাওয়ারে খবর দেন তৈরি থাকার জন্যে। রেঞ্জ অফিসে বার্তা যায় গাড়ি পাঠানোর জন্য।
ওয়াচ টাওয়ারে রক্ষীরা তৈরিই ছিল। রেঞ্জার সাহেবকে স্যালুট দিয়ে যখন ওরা মহাদেবকে গাড়ি থেকে নামালো তখন ভালই অন্ধকার নেমে গেছে। দু’দিকে দুজন লাঠিধারী সান্ত্রী আগন্তুককে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিয়ে গেল। এবারে ওরা জেরা করে বোঝার চেষ্টা করবে মানুষটার গভীর জঙ্গলে আসার উদ্দেশ্য কি? শুভঙ্কর বলল, “ওরা ওদের কাজ করুক, চলুন আমরা অন্য কাজ সেরে আসি।” আমরা চললাম বিট অফিসের উদ্দেশ্যে। এবার গাড়ি থেকে নেমে বুড়ি তোর্ষা নদী পেরোতে হবে। বনকর্মীরা টর্চ নিয়ে অপেক্ষায় ছিল। সরু দোলনা সেতুর কাঠের পাটাতন কয়েক জায়গায় ভাঙা, তাই ওরা বারবার আলো দেখিয়ে সাবধান করতে থাকে যেন অসাবধানে ফাঁকে পা ঢুকে না যায়। সেদিন কোন তিথি ছিল জানি না— বোধহয় পূর্ণিমা আর অমাবস্যার মাঝামাঝি। আধা চাঁদের লাজুক আলো বুড়ি তোর্ষার বুকে এসে পড়ছে আর তার সাথে কুলকুল আওয়াজের অভিসার। পা বাঁচাতে গিয়ে এই অনবদ্য পরিবেশ আর পুরোপুরি উপভোগ করা হল না।
বিট অফিসে ভালই অভ্যর্থনা জুটল। ঐ গহন অরণ্যে চা- সিঙ্গারা দিয়ে আপ্যায়ন আমার কল্পনার অতীত ছিল। রেঞ্জার সাহেব সব খোঁজখবর নিলেন জঙ্গলে বর্ষার জল কোথায় কত বেড়েছে ? পাশের গ্রামে কোন পশুর উৎপাত হয়েছে কিনা ইত্যাদি। উপস্থিত বনকর্মীদের সাথে কথা সেরে আমরা আবার ওয়াচ টাওয়ারে ফেরত এলাম ।
শুভঙ্কর উপরে উঠে গেল। আমি একা রইলাম গাড়িতে। আর কিছু রক্ষী নিয়ে অন্য একটা গাড়িও ততক্ষণে চলে এসেছে। আমার গাড়ির কাঁচ প্রায় পুরোটা তুলে দেওয়া নিরাপত্তার কারণেই। অন্ধকারে একা বসে নির্জনতা উপভোগ করতে ভালই লাগছিল, তবে দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়। ক্রমশ কাঁচগুলো বাষ্প জমে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল রুমাল দিয়ে মুছে মুছে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করছিলাম। বেশ খানিক সময় পর শুভঙ্কর নেমে এসে বলল, “আপনাকে দু’জন কর্মী বাসায় নিয়ে যাক, আমার একটু সময় লাগবে। ডিনারের জন্য অপেক্ষা করবেন না,কখন ফেরা হবে জানি না।’’ পরিস্থিতির প্রয়োজনে আমাকে সেটা মানতেই হল।
জনের পরিবর্তে এখন অন্য এক বনকর্মী আমার সঙ্গী, নাম চিন্টু। ও এতক্ষণ জেরার সময় টাওয়ারে ছিল। ড্রাইভার এবং চিন্টুর কথোপকথন চলতে থাকে।
—ছেলেটাকে কি মনে হয় তোর ?
—বোঝা মুশকিল। পাগলের ভান করে। খুব সুবিধার না। গার্ড কতগুলি ডান্ডার মাইর যা দিসে। না! তবুও পরিচয় বলে না। কখনো কয় লগে(সাথে) দুই তিনজন আসে(আছে), কখনও কয় নাই।
—বোঝা মুশকিল। পাগলের ভান করে। খুব সুবিধার না। গার্ড কতগুলো ডান্ডার মাইর যা দিসে— সাথে লোক থাকলে তো চোরা শিকারিই মনে হয়। গণ্ডার মারতে আইসে।
—চেহারাটা প্যাংলা দেখাইলে কি হইব, ভালই মাইর সইহ্য করতে পারে।
—ডান্ডা খাবার অভ্যাস আছে। স্যার যেন অত সহজে ওরে না ছাড়ে, ওনার আবার দয়া মায়া বেশি।
—না, না, স্যার ভাল মন্দ ভালই বোঝে। বয়স কম, তাই খুব কঠোর হইতে পারে না। মানুষ কে যে কেমন হয়? ভগবান জানে। নেশাখোরও হইতে পারে।
পুরো যাত্রা পথেই আমি নীরব শ্রোতা, শুধু চিন্তা হতে থাকল মহাদেবকে নিয়ে। যদি সত্যিকারের অপরাধী না হয় তাহলে অকারণ যন্ত্রনা পাবে।
রেঞ্জার সাহেবের বাংলোয় পৌছলাম, কাঠের উঁচু একতলা বাড়ি। শরণ্যা সাদরে ভিতরে নিয়ে গেল।
—স্যার, কফি না চা?
—চা। দুধ ছাড়া, চিনি চলবে। আর কিছু দিওনা; একেবারে রাতের খাবার খাব।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নানান কথা চলতে থাকল। আড্ডা দিলেও আমার মন পড়ে আছে ফেলে আসা ওয়াচ টাওয়ারে, সেখানে কি না ঘটছে। অত রোগা ছেলেটা কত মার খাবে কে জানে?
—স্যার, আপনার খাবার রেডি করি, নটা বেজে গেল। সারাদিন তো পরিশ্রম গেছে।
—না না, শুভঙ্কর আসুক, একসাথে খাব।
—অনেক দেরিও হতে পারে, আপনার ধারণা নেই। এইরকম ঘটনা ঘটলে অনেকরকম নিয়ম কানুন পালন করতে হয়। কখনও থানায় পাঠাতে হয়, কখনও হাসপাতালে পাঠাতে হয়, তারপর ঘরে ফেরা…আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
—তবুও দেখা যাক না আরও কিছু সময়। আমার রাত করে খাবার অভ্যস আছে। চোখে ক্লান্তি নেমে আসছে তবুও নিশ্চিন্ত না হয়ে খেতে বসতে মন চাইছে না। বেশি অপেক্ষা করতে হল না, শুভঙ্করের গাড়িটা এসে থামল।
—কি হল সাহেব?
—না, ওকে ছেড়েই দিলাম। আমিও হালকা হলাম।
—লোকটা কে ছিল তাহলে?
—মানসিক ভারসাম্যহীন, পথ ভুল করে ঢুকে পড়েছে। এরকম মাঝে মধ্যে হয়।
—চোরা শিকারী নয় কেন?
—ওদের কাছে কিছু না কিছু অস্ত্র থাকে আত্মরক্ষার জন্য। এর পকেট খুঁজে কিছুই পাওয়া যায়নি, মোবাইল ফোনও নয়। চোরেরা দলে থাকে। অন্য ওয়াচ টাওয়ার থেকেও আর কারও কোনও মুভমেন্ট দেখা যায়নি।
—কোথায় ছাড়া হল?
—পার্কের গেটের বাইরে বড় রাস্তায়।

এবার নিশ্চিন্তে বসে ডিনার সারা হল। অতিভোজন যে হল, তা বলাই বাহুল্য। খাওয়া শেষে লোকালয়ে ফেরা, আধঘণ্টা বনপথে গাড়িতে যেতে হবে। গহন অরণ্যে গভীর রাতে ভ্রমণ বেশ রোমাঞ্চকর। গাড়িটা ইচ্ছা করেই একটু দীর্ঘতর পথ ধরল কিছু চতুষ্পদ দর্শনের আশায়। সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে একটু ধীরে চালানো হল, বড় টর্চ এদিক ওদিক আলো ফেলল— না, কিছুই দেখা গেল না। শরণ্যা-শুভঙ্করের ইচ্ছা ষোল আনা পূর্ণ হতো আমি কিছু দেখতে পেলে। আমার কোন আক্ষেপ নেই— যতটুকু নতুন অভিজ্ঞতা না চাইতেই পেলাম, তা অমূল্য বললেও কম বলা হবে। যাত্রাপথের তখন প্রায় শেষ অংশে পৌঁছে গেছি; দূরে মনে হল এক ঝাঁক জোনাকি বাঁ দিক থেকে ডানে চলে গেল। একটু এগোতেই দেখি ডান দিকের ঝোপে দাঁড়িয়ে কতগুলো বাইসন, ওদের চোখেই দুর থেকে আলো পড়ে জোনাকির মতন দেখাচ্ছিল। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ওরা যেন আবার অরণ্যে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
মাদারিহাটের বুড়ি তোর্ষার ব্রিজটা প্রবল জলের তোড়ে ভেঙে গেছে। বাঁশের চাটাই দিয়ে পায়ে চলার একটা সাময়িক ব্যবস্থা হয়েছে। সাবধানে নদী পার হয়ে অতিথি নিবাসে পৌঁছলাম।
ঘুম না আসার অনেক কারণ হয়, সদ্য ফেলে আসা স্মৃতির আবেশে কত ঘণ্টা জেগে রইলাম কে জানে? সাকুল্যে হয়তো তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছি, তবুও সকালে কোনও ক্লান্তি ছাড়াই তৈরি হয়ে গেলাম কুমারগ্রাম যাবার জন্য।

সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে কেটে গেল। প্রকৃতি আর মানুষের সারল্য যেখানে সহাবস্থান করে সেখানে পেটে খিদে পেলেও মনের সতেজতা অটুট থাকে। একটু বেলা করেই আমরা বারোবিশার একটা খাবারের দোকানে খেতে ঢুকলাম। হাত ধুয়ে ভাতের থালার অপেক্ষায় বসে আছি, হঠাৎ একটা কথা শুনে পিছনে তাকালাম। “ওই জংলিটা আবার আইসে,” দোকানদার বলে উঠল। আরে! এ তো সেই গতকালের মহাদেবের মত লাগছে। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ওকে চেনেন?”
—ও এদিকে সেদিকে ঘোরে, দুই এক সময় খাবার চাইতে আসে। দুটো ভাত পেলেই চলে যায়। কথা বিশেষ বলে না।”
পাশে বসা এক বৃদ্ধ বললেন, “ওডা ফাঁক পাইলেই জঙ্গলে যায়। পুলিশ ধরে আবার ছাইড়া দেয়। ওর কেউ নাই, রাস্তায় থাকে। শুনছি ওর বাপে নাকি মাহুত আছিল। তাই মনে হয় ভয়ডর কম, বনবাদাড়ে মানুষ হওয়া তো।
মানসিক ভারসাম্যহীন! ভারসাম্য না থাকলে নাকি পাল্লা একদিকে ঝুলে যায়। মহাদেবের পাল্লার কাঁটা আসল আর নকলের মাঝে থাকতে থাকতে অকৃত্রিম অরণ্যের দিকে ঝুঁকে গেছে…তাই নির্ভয়ে চলে যায় বনানীর স্নেহ ক্রোড়ে। সেখানে কাঁটা ফুটলে ব্যথা লাগে না, কাউকে শত্রু মনে হয় না, হাতি শুঁড়ে পেঁচিয়ে আদর করে পিঠে চাপিয়ে নেয় মাহুতের ব্যাটাকে।

1 COMMENT

Comments are closed.