পদাতিক এক্সপ্রেস এনজেপি স্টেশনে এসে পৌঁছল ধীরে লয়ে , সময় সকাল নটা চল্লিশ। রূপলেখা অনেক আগে থেকেই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিল খুব শান্ত ভাবে। পিছনে ধীর লয়ে পুলিশ অফিসার রূপম। এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল ওরা দু’জনেই ট্রেনের কাছাকাছি । দুটো সিট মুখোমুখি, দু’জনেই বসল কিন্তু কোনও কথা নেই পরস্পরের । ট্রেনটা এনজেপি স্টেশনে এসে কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল। একটু আগে প্ল্যাটফর্মে অসম্ভব রকম ভিড় ছিল; কি ভীষণ প্রাণবন্ত লাগছিল চারপাশের পরিবেশ এবং নিজের মনটাও। নিজের সিটে এসে বসার পর কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা বোধ কাজ করতে লাগল নিজের মনের মধ্যে। জানালা দিয়ে ভাল করে একবার দেখে নিল আশেপাশে চেনা কেউ আছে কিনা। না তেমন কাউকে তো দেখা গেল না। আজকাল চেনা লোকের চেয়ে অচেনা মুখের ভিড়েই ভরে গেছে চারপাশ। রূপলেখা খেয়াল করল পাশের সাইড লোয়ারে দুটো অল্প বয়সী ছেলে এসে বসেছে , বয়স কতো হবে তেইশ -চব্বিশ ।
রূপলেখা থাকে দুর্গাপুরে , বন্ধুর বোনের বিয়ে উপলক্ষে শিলিগুড়ি আসা। দুর্গাপুরে না ফিরে পদাতিক এক্সপ্রেসে উল্টোপথে রওনা দিল নিজের প্রচ্ছন্ন ভাললাগাকে গুরুত্ব দিতে।
রূপম থাকে কলকাতায় । নিজস্ব কিছু কাজ ছিল নিউজলপাইগুড়িতে। সেই কাজ শেষ করতে দু’দিন লাগল, তারপর নিজস্ব ঠিকানায় না গিয়েে তার বিপরীত অভিমুখে রওনা দিল শিয়ালদা থেকে আগত পদাতিক এক্সপ্রেসে। ট্রেন ছাড়ল তার নিজস্ব নিয়মে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রূপম। একটা গোলাপের তোড়া, একটা চকলেট , আর একটা টেডিবিয়ার এগিয়ে দিল রূপলেখার দিকে। সবগুলোই রূপলেখার ভীষণ পছন্দের। ফেসবুক থেকেই আলাপ-পরিচয়, এরপর ধীরে ধীরে রূপলেখার ভাল লাগা-না লাগাকে জেনে নিয়েছে রূপম এতদিন ধরে ।
রূপমের চোখে সানগ্লাস, মাথায় টুপি , এটা রূপমের নিজস্ব স্টাইল, টুপিটা কিন্তু তার স্মার্টনেসকে অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে । লম্বা পেটানো চেহারার পুলিশ অফিসার রূপমকে দেখছিল শান্ত চোখে কিন্তু সানগ্লাসটা খুলতেই মুখটা কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগল রূপলেখার কাছে। চোখদুটোও একেবারে ছোট ছোট, দাঁতগুলো ফাঁক ফাঁক। আর রূপম ভাবছে, রূপলেখার যে মাধুর্য বা সৌন্দর্য অনেক বেশি ধরা পড়েছে ফেসবুকের প্রতিটি ছবিতে, কিংবা যে আকর্ষণ এতটা সময় ধরে সে অনুভব করে এসেছে, বাস্তবে তার অনেকটাই অভাব। বয়সটাও কেমন যেন বেশি বেশি লাগছে; নমনীয় ব্যাপারটাও কম , আহামরি তেমন কিছুই নয়।
ট্রেন চলছে দুরন্তগতিতে। দুপাশে সবুজের সমারোহ। কত গ্রাম, কত নরম মাটির গন্ধ বাতাসের মধ্যে দিয়ে যেন ভেসে আসছে। তার-ই মাঝে হালকা কিছু কথাবার্তা। ট্রেনের আওয়াজে কথা তেমন শোনা যাচ্ছে না। খুব যে বলার তাগিদ তা-ও নয়। কিছুক্ষণ পরে টুকটাক খাওয়া দাওয়া। তারমধ্যেই ট্রেন এসে পৌঁছল হাসিমারা। নেমে পড়ল দু’জনে। এরপর অটো করে দুপাশের চা বাগানকে সঙ্গী করে রওনা দিল জয়গাঁ । আগে থেকেই হোটেল ঠিক করা ছিল।
ফেসবুক সূত্রেই আলাপচারিতা তারপর বন্ধুত্ব। এরপর ধীরে ধীরে সেই বন্ধুত্ব থেকে বেশ গভীর এক সম্পর্কে পৌঁছে গেছে কখন তারা খেয়াল-ই করেনি। রূপলেখাকে সুন্দর করে বুঝিয়েছিল রূপম সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কথা। বিবাহ বহির্ভূত একটা সম্পর্ক থাকতেই পারে , তাতে আইনত কোনও
অপরাধ নেই। দিনের পর দিন বুঝিয়েছিল, জীবন কী, জীবনের রং-ই বা কী। আলোচনা করেছিল জীবনের সারমর্ম নিয়ে। দিনের পর দিন শুনতে শুনতে কেমন যেন অন্যরকম এক ভাললাগা কাজ করতে লাগল রূপলেখার মধ্যে। তাই তো বছরের শেষ দিন একত্রিশে ডিসেম্বর রাতে যখন রূপলেখা জানালো রূপমকে তার ভালবাসার কথা, আনন্দে উল্লাসে তিন রাত্রি ঘুমাতে পারেনি রূপম। স্বপ্নের রাজকন্যা এখন শুধুই তার, বিশ্বাস-ই হচ্ছিল না, ভাবতেই মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হল যেন। আর রাত জাগা শুরু হল রূপলেখার সেই থেকে।
অদ্ভুত এক আবদার রূপমের। ভোরবেলার অন্ধকার থাকতে ডেকে দিতে হবে তাকে কারণ তার মর্ণিং ডিউটি । রূপলেখা তাহলে কিভাবে ঘুমবে? এমনিতেই রূপমের সাথে কথা বলতে বলতে কতো রাত হয়ে যায়, এরপর ঘুমলে তো বুঝতেই পারবে না কখন ভোর হয়েছে। তাই রূপমকে পৌনে চারটের সময় ডেকে তারপর ঘুমতে যেত। এইভাবে অনিদ্রায় ক্ষিদেও কমে গেল রূপলেখার। চোখের তলায় হালকা কালিও ভেসে উঠল। কিন্তু তার মধ্যেও একটা অন্য অনুভূতি -একটা অন্যরকম ভাললাগায় এই চোখের তলার কালি একেবারেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ল ।
আজ এতদিন পর পরস্পরের প্রথম সাক্ষাৎ , এতদিনের জমে থাকা দু’জনের অনেক কথা, অনেক স্বপ্ন-অনেক ব্যথা যা এতদিন দূর থেকে আলোচনা হয়েছিল মাত্র। ভাবনা -চিন্তা ভাললাগা -না ভালোলাগা সব যেন আজ এক বিন্দুতে এসে মিশে গেল। হোটেলের বিছানায় শুয়ে পাশাপাশি দু’জনে। এতদিনের চেনা রূপমকে একদম অচেনা লাগছে। একটু যেন অন্যমনস্ক, একটু যেন বেশিই চুপচাপ। স্বামী অভিমুন্যের সুন্দর মুখটা মনে পড়ছে।
অন্যদিকে চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরে শুয়ে রূপম ভাবছে কি এমন আকর্ষণীয় রূপলেখা। স্ত্রীর মুখটা বারবার মনে পড়ছে । সোমা অনেক বেশি সিম্পল, অনেক ঘরোয়া। ঝাঁ চকচকে রূপলেখার প্রোফাইল ছবিতে যে চমক এনেছিল রূপমের হৃদয়ে, ঝড় তুলেছিল প্রতিটি শিরায় শিরায়, হঠাৎ এতটা কাছে আসার পর রূপলেখা যেন নতুন রূপ-অন্যরকম রূপে ধরা দিল । ঠোঁটটা কেমন কালো। বলেই ফেলল রূপম, “তুমি কি বিড়ি খেতে খুব?” হেসে রসিকতা করে বললেও বুকের ভিতর কথাটা বিঁধল ভীষণ রকম। তোমার স্কিনে এতো দাগ, ছবিতে একটুও বোঝা যায় না কিন্তু।
তারপরেই রূপম ভাবল রূপলেখার মধ্যে তেমন কোনও আকর্ষণ নেই। ভ্রু তেমন ঘন নয় আর খুব আগোছালো। সোমা অনেক শান্ত, লক্ষ্মীশ্রী অনেকটাই বেশি। গায়ের রং সোমার অনেকটাই বেশি সুন্দর। স্কিন কতো মোলায়েম সোমার। ইস কতো স্বপ্ন দেখেছিল রূপলেখাকে নিয়ে, একটা বিরাট ধাক্কা খেল রূপম । একটা দিন কোনওরকমে কেটে গেলে মঙ্গল।
সূর্যাস্তের আলো তখন পশ্চিমাকাশে ছেয়ে আছে। অসাধারণ এই দৃশ্যের মধ্যেও রূপলেখার মনটা খুব আনমনা। অদ্ভুত ভাবে খুঁত ধরছে রূপম তার প্রতিটি কাজে যা এতদিন অনুভব করেনি সেইভাবে। কোথাও ঘুরতে গেলে এতো নিয়মকানুন মানতে হবে কেন? তাহলে তো ঘোরার মজাটাই মাটি । এটা কি বাড়ি নাকি?
একটা চুমু -ভালবাসা ভরা আদর এই সময়টুকুকে ভরিয়ে দিতেই পারত। রূপম কেমন যেন ছাড়াছাড়া, অদ্ভুত এক বিষন্নতা গ্রাস করল রূপলেখাকে। চোখের জলকে নীরবে মুছে নিল । পরস্পর পরস্পরকে কিছু ভাষাহীন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।

সন্ধ্যাবেলা রাস্তায় ঘুরতে গিয়ে একটা দোকানে গিয়ে কিছু জিনিস কিনল রূপম। রূপলেখা একটা পারফিউম আর একজোড়া চটি কিনে দিয়ে বলল, ‘কলকাতা ফিরে গিয়ে মাটিতে পা দিয়ে চটিটা পড়তে গেলেই আমার কথা মনে পড়বে তোমার, আর এই নাও চকলেট, কাউকে ভাগ দেবে না যেন। চকলেট কাউকে শেয়ার করতে নেই জানো তো? ‘
রূপম হেসে বলল, ‘না কাউকে ভাগ দেব না। কিন্তু এত কিছু কেন কিনছ?’
রূপলেখা হেসে বলল, “কিছু স্মৃতি অতীতকে বাঁচিয়ে রাখে।” আর মনে মনে বলল, আসলে তোমার আমার কিছু ভাল সময়, কিছু ভাল মুহূর্ত , অনেক কথা জীবনকে এতদিন অন্য রঙে মাতিয়ে রেখেছিল। কাল থেকে রংটা পালটে গেলেও তারও তো একটা নতুন রং হবে। রং যাই হোক না কেন; সবুজ হয়ত কালো হবে কিংবা আরও কালো হবে- ঘন কালো।
রাতে মাটনকষা -স্যালাড -ঝরঝরে ভাত-কাশ্মীরি মুগডাল, বেগুনভাজা। এই ব্যাপারে রূপমের আন্তরিকতাকে সম্মান করতেই হয়। তখন কেমন যেন ছেলেমানুষের মতো আচরণ করে, মুগ্ধ চোখে দেখে রূপলেখা। তারপর রাত নেমে পড়ে ঝুপ করে। রাতের নিবিড় অন্ধকারে ওরা মিলিত হল কিছুটা দায়বদ্ধতা থেকেই। কেউ কাউকে বাধা দিল না, এক তাগিদ বা কোনও এক শর্ত থেকেই ভালবাসা সামনে এসে কথা বলে গেল। এতদিনের জলতরঙ্গের রিনিরিনি আওয়াজ কোথায় যেন মিশে গেল ধীরে ধীরে; মিশে গেল কিছু কথা, কিছু নীরব প্রতিশ্রুতি।
টুকরো টুকরো কতো কথা সামনে এসে ভিড় করল। এতদিনের রাগ অনুরাগ অভিমান সব যেন নতুন রূপে ধরা দিল। পরের দিন সকালে বড় বেশি প্রস্তুতির পালা। ফিরতে হবে যার যার নিজস্ব ঠিকানায়। মনে পড়ছে প্রিয়জনের মুখ। আসলে কিছু বাইরের ছবি শুধুই বাইরের জগতের জন্যে, তার মূল্যায়ন করতে যাওয়া বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। ভার্চুয়াল জগতের মায়া থাক তার নিজস্ব ঘেরাটোপে। আর নিজস্ব জগতের ঘেরাটোপে যে জীবন , পরাধীন হয়েও কেমন স্বাধীনতার আনন্দে জ্বলজ্বল করছে যেন।
রূপলেখা ভাবছে স্বামী অভিমন্যুকে নিয়ে, ” আমি কি তোমার বিশ্বাসে আঘাত করলাম ? তোমার জন্যে কেন জানি ভীষণরকম কষ্ট হচ্ছে আজ।” আর রূপম হোয়াটসআপে মেসেজ করছে, ” মিস ইউ সোমা , আই রিয়েলি মিস ইউ ডিয়ার …।”

1 COMMENT

Comments are closed.