সৈয়দ রেজাউল করিম

(খাকি উর্দি গায়ে কয়েক যুগ চষে বেড়িয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত। রাজ্যের বিভিন্ন থানা ও ক্রাইম ব্রাঞ্চে কাজ করতে গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই হয়ে উঠেছে সৈয়দ রেজাউল করিমের গল্পগুলির রসদ।)

আমি ভালো করে ছবিটা দেখে বললাম— হ্যাঁ, এই মেয়েটাই মৌমিতা। কিন্তু তুমি মৌমিতার ছবিটা পেলে কোথায়?
সুচরিতাদি সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল— মৌয়ের পাশে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে, দেখ তো তাকে চিনতে পারিস কিনা!
আমি ভালো ভাবে দেখে বললাম— এতো তোমার ছবি দেখছি!
—তাহলে আমাদের সম্পর্কটা একটু বোঝার চেষ্টা কর। মৌমিতা হল আমার প্রাণের বন্ধু। সহপাঠী। অনেক বছর তার সাথে যোগাযোগ নেই। ও এখন কোথায় আছে? কেমন আছে? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে। যোগাযোগ করতে মন চাইছে ওর সাথে।
সুচরিতাদিকে কিছুটা সাসপেন্সে রাখতে আমি বললাম— সে কাহিনি বলতেই তো বসেছি। মন দিয়ে শোনো। সেদিন সন্ধেবেলায় অনুপের লাশ এসে পৌঁছল মাদারিহাট থানায়। দাহ করতে সেই লাশ নিয়ে যাওয়া হল তোর্সা নদীর চরে। চোখের জলে অনুপের মুখাগ্নি করল মৌমিতা। থানায় ফিরে এসে আমি মৌমিতাকে জিজ্ঞাসা করলাম—আপনি এখন কি করবেন? বাপের বাড়িতে ফিরে যাবেন?
মৌমিতা বলল— কোন মুখে আমি তাদের বাড়িতে ফিরে যাব? তাদের মান-মর্যাদা সব ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে এসেছি আমি। কোন পোড়ামুখে আমি তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াব?
—তাহলে আপনি কি করবেন বলে ঠিক করলেন?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৌমিতা বলল— জানি না।
আমি বললাম, আপনি কি শ্যামলের বাড়িতে ফিরে যাবেন?
আমার কথা শুনে নিঃশব্দে ঠোঁটের কোণে হেসে ফেলল মৌমিতা। তারপর একটু ভেবে কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলল— যদিও আক্ষরিক অর্থে অনুপের সাথে আমার বিয়ে হয়নি, যদিও আমার মাথায় জ্বলজ্বল করছে শ্যামলের দেওয়া সিঁদুর, তবু আমার মতো বেয়াদপ, বেপরোয়া, অহংকারী মেয়ের সঙ্গে তিনি কেন থাকতে রাজি হবেন?

সেই মুহূর্তে আমি আর কোনও কথা বললাম না। মৌমিতাকে থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম জলদাপাড়া লজে। রাতে ফোনে শ্যামলের সাথে কথা বললাম। পরদিন প্লেনে করে সে উড়ে এলো বাগডোগরায়। সেখান থেকে সোজা চলে এলো মাদারিহাটে। মৌমিতাকে তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম—- ভাই ! তোর আমানত তুই নিয়ে যা।

সেই থেকে এখনও ওরা সুখে ঘর সংসার করছে। ওদের দুই ছেলে এখন প্রতিষ্ঠিত। এখনও ওদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে।
সুতরিতাদিকে বললাম, মৌমিতার সঙ্গে তোমাকে এখনই কথা বলিয়ে দেবো। তোমার পরিচয় পেলে খুব খুশি হবে মৌমিতা।

কাহিনি শুনে সুচরিতাদি বলল— তুই মাঝে মাঝে আমাকে জিজ্ঞেস করিস, কেন আমি বিয়ে করলাম না? এখন বুঝতে পারছিস তো— জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে।
আমি বললাম— হ্যাঁ, সুচরিতাদি! লোকে বিশ্বাস করুক বা না করুক, আমি কিন্তু সেদিন থেকে বিশ্বাস করি কথাটা।

সুচরিতাদি আমাকে বলল— তোর মনিহারের কাহিনি তো শুনলাম, ভালোই লাগল। মানুষের জীবনে যে এরকম কত ঘটনা ঘটছে, ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। অথচ এটাই বাস্তব। তবে তোর সাহায্য পেয়ে মৌমিতা যে এখন সুখে ঘরসংসার করছে, একথা জেনে আমি খুব খুশি হয়েছি। এখন তুই আমাকে একটু মৌমিতার সঙ্গে যোগাযোগটা করিয়ে দে। আমি ধৈর্য্যহারা হয়ে পড়ছি ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য।

আমি এক পলক দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম। বললাম— রাত দশটা বাজতে চলল সুচরিতাদি। এত রাতে ফোন করা কি ঠিক হবে? বরং কাল সকালে…।
—তোর অত চিন্তা কিসের বল তো? ধমকের সুরে সুচরিতাদি বলল— ওসব বাহানা ছাড়। কলকাতার লোকজনদের হাল হকিকত আমার খুব জানা আছে। দশটার সময় কেউ ঘুমাতে যায় না। কথা না বাড়িয়ে ফোনটা একটু ধরে দে। অনেক বছর মৌমিতার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ নেই। অনেকদিন ওর গলা শুনিনি। ওর সাথে একটু কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে।
—ঠিক আছে সুচরিতাদি! আমি চেষ্টা করে দেখছি।

একথা বলে মোবাইল ফোনটা বার করে নাম দেখে রিং করলাম। রিং দু’বার বাজতে না বাজতেই শুনতে পেলাম– হ্যালো!
শ্যামলের গলা বুঝতে পেরে পরিচয় দিয়ে আমি বললাম— কেমন আছিস তোরা?
অভিমানী গলায় অনুযোগ করে সাথে সাথে শ্যামল বলল— এতদিন পরে আমাদের কথা মনে পড়ল তোর? রিটায়ার্ড হয়ে কলকাতায় ফিরেছিস শুনলাম। এর মধ্যে একদিন আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে যাবার আর সময় হল না তোর? মৌমিতা এখনও প্রায়ই তোর কথা বলে।
শ্যামলের সব মান অভিমানের গোড়ায় জল ঢালতে আমি বললাম— সামনের সপ্তাহে একদিন তোদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসব। তা মৌমিতা বৌদি জেগে আছে?
— ধর। ওকে দিচ্ছি।
‘মৌমিতা’ ‘মৌমিতা’ বলে দু’বার চিৎকার করে ডাকল শ্যামল। পাশের ঘর থেকে মৌমিতার গলা শুনতে পেলাম— ডাকছো কেন?
শ্যামল বলল, তোমার ফোন।
— কে?
আমার পরিচয় পেয়ে ফোনটা ধরে মৌমিতা বলল— নমস্কার স্যার! আপনারা সব কেমন আছেন?
আমি বললাম— আমরা তো ভালো আছি। কিন্তু তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য একজন উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে।
আগ্রহের সাথে মৌমিতা জানতে চাইল— কে?
আমি নামধাম কিছু না বলে জবাব দিলাম— দেখো, চিনতে পারো কি না?
ফোনটা ধরিয়ে দিলাম সুচরিতাদির হাতে। ফোনটা হাতে নিয়ে সুচরিতাদি বলল— হ্যালো!
সেই গলার স্বর ঠিকমত বুঝতে না পেরে এবং তার পরিচয় জানতে মৌমিতা বলল— আপনি কে বলছেন?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুচরিতাদি আক্ষেপের সুরে বলল— এখন আর আমাকে চিনবি কি করে! আমি তোর রিতাদি!

‘রিতাদি’ নামটা শুনে যেন লাফিয়ে উঠল মৌমিতা। পুরনো কথায় কথায় কোথা থেকে এক-দেড় ঘন্টা কেটে গেল, তা বুঝতেই পারল না দু’জনে। আর আমি সুচরিতাদির পাশে বসে সব কথা শুনছিলাম। স্মৃতিচারণ যে কতটা সুখের, কতটা বেদনার— তা-ও অনুভব করছিলাম প্রতিটি মুহূর্তে। একসময় মৌমিতা প্রশ্ন করল—রিতাদি! তোমার বাবার কোন সন্ধান পেয়েছিলে?

প্রশ্নটা শুনে সুচরিতাদি কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে গেল। তার চোখে মুখে ফুটে উঠল একটা অস্বস্তি ভাব। আমি বেশ বুঝতে পারলাম সুচরিতাদি আমার সামনে কথাটা বলতে চাইছে না। তাই আমি বিছানা থেকে উঠে বাথরুমের দিকে গেলাম। সেইসময় সুচরিতাদি গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল— না। আমি আর কোন চেষ্টা করিনি। সেসব কথা তোকে পরে বলব। অনেক রাত হল। শুয়ে পড় গিয়ে।

একথা বলে ফোনটা কেটে দিল। আমি ফিরলাম বাথরুম থেকে। আমার দিকে তাকিয়ে সুচরিতাদি বলল— অনেক রাত হয়েছে। শুয়ে পড়।

সুচরিতাদি চলে গেল পাশের কামরায়। কিন্তু আমার মাথায় রয়ে গেল কথাটা। সুচরিতাদির বাবা কোথায় গেছেন? এত বছর তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? কোন রহস্য লুকিয়ে আছে এর পিছনে? এত কাছের মানুষ হলেও কেন সুচরিতাদি আমার সামনে কথাটা বলতে ইতস্তত বোধ করল? আসল ব্যাপারটা কি, তা জানার জন্য মনটা আকুলিবিকুলি করে উঠল। কিন্তু এ ব্যাপারে সুচরিতাদিকে কিছু জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলতে চাইবে না। তখনই মনে হল, মৌমিতার কাছে ব্যাপারটা জানতে হবে। যদি সত্যিই সুচরিতাদির বাবা হারিয়ে গিয়ে থাকেন, তাহলে যে কোন ভাবেই হোক তাঁকে খুঁজে বার করতে হবে।

(ক্রমশ)

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়