সঞ্জয় গুপ্ত

সময়টা ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাস। হিটলারের দেশ জার্মানিতে বছর দু’য়েক কাটানোর পর জাপানে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেললেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। আর তার এই আশ্চর্য সফরে দু-দুটো ডুবোজাহাজে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিলেন তিনি। একটি ডুবোজাহাজ জার্মানির, অন্যটি জাপানের। আর উত্তাল সমুদ্রের মধ্যেই বিরাট বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ডুবোজাহাজ বদল করতে হয়েছিল তাঁকে। নেতাজির জীবনে সেটি ছিল চরম বিপদশঙ্কুল এক সফর। আর সেই সফরে তাঁর সঙ্গী ছিলেন হায়দরাবাদ থেকে জার্মানিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসা তরুণ এক ভারতীয়, আবিদ হাসান।

নেতাজি বার্লিন পৌঁছেছিলেন ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে Orlando Mazzotta, নামে ইটালিয়ান পাসপোর্টে। দু বছরের বেশি সময় বার্লিনে ছিলেন তিনি। সেসময় অনেক ভারতীয়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে জার্মানিতে আসা, সেটা হয়ে উঠছিল না। শেষটায় ঠিক করলেন, জাপান যাবেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। প্লেনে করে গেলে বেশি বিপদের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা। জার্মানির সঙ্গে আলোচনায় ঠিক হল, সমুদ্রপথে, ডুবো জাহাজে করে যাওয়াটাই ঠিক হবে। জার্মানির সামরিক দফতর থেকে সাংকেতিক মেসেজ পাঠানো হলো টোকিওতে। দু পক্ষের আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল, জাপান থেকে সাবমেরিন আসবে ভারত মহাসাগরে। এদিক থেকে জার্মানরা নিয়ে যাবে নেতাজিকে। মাঝসমুদ্রে এক ডুবো জাহাজ থেকে অন্য ডুবো জাহাজে সুভাষচন্দ্রকে পারাপার করানো হবে। দুটো ডুবোজাহাজের দেখা হওয়ার জায়গা ঠিক হলো, মাদাগাস্কার দ্বীপ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে।

দুটি বিশ্বযুদ্ধেই জার্মানরা তাদের ডুবোজাহাজ নিয়ে খুব সাফল্য পেয়েছিল। জার্মানির ডুবোজাহাজ গুলিকে বলা হতো, ইউ বোট। এর পিছনের কারণ হচ্ছে একটি জার্মান শব্দ ,” Unterseeboot”, যার অর্থ, সাবমেরিন বা সমুদ্রের নীচের বোট । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের সবচেয়ে সফল ইউ বোট ছিল SM U 35 । এই বোটটি ১৭ বার পেট্রোলিং কিংবা শিকার করতে বেরিয়ে ২২০ টি জাহাজ, যার অধিকাংশই পণ্যবাহী— তাদের ডুবিয়ে দিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের হার হওয়ার জন্য, ১৯১৮ সালের ২৬ নভেম্বর ডুবোজাহাজটি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে সফল ইউ বোট ছিল U-48। মোট ১২ বার পেট্রোলিং করতে বেরিয়ে এটি ডুবিয়ে দিয়েছিল ৫৬টি জাহাজ। এটিকে ১৯৪৫ সালের ৩ মে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে ট্রেনিং দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের প্রায় ১২০০ ইউ বোট ছিল যার মধ্যে ৭০০-র বেশি যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায় প্রায় ৩০০০০ হাজার সৈন্য-সহ।
নেতাজি এবং তাঁর সঙ্গীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জার্মান অ্যাডমিরাল Carl Doneitz বেছে নিলেন U-180 নামের ডুবোজাহাজটিকে। ১৯৪৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। জার্মানির কিয়েল শহরের ডক থেকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলো U-180 আর ৯ ফেব্রুয়ারিতে বোটে করে নিয়ে আসা হলো নেতাজি ও আবিদ হাসানকে। প্রথমে অবশ্য তাঁদের পরিচয় দেওয়া হয়েছিল মেকানিক হিসেবে। বলা হয়েছিল, এঁরা নরওয়েতে যাবেন। যাত্রা শুরু করার পর, জাহাজের অন্য কর্মীদের জানানো হলো, এঁরা যাবেন একদম ভারত মহাসাগর পর্যন্ত।

ডুবোজাহাজটির গতিবেগ ছিল জাহাজি ভাষায়, ২০.৮ নট। সেটা কিলোমিটারে নিয়ে এলে, ঘণ্টায় ৩৮.৫ কিলোমিটার । তবে এটা হচ্ছে জলের উপর ভেসে চলার সময়ের গতিবেগ। সমুদ্রের জলের নীচে সর্বোচ্চ গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ৬.৯ নট অর্থাৎ ১২.৮ কিলোমিটার। ইউ বোটটি জলের নীচে ২৩০ মিটার— মানে ৭৫০ ফুট অবধি নামতে পারতো। ১৯৪২ সালের ১৬ মে ডুবোজাহাজটি জার্মান নৌসেনায় যোগ দিয়েছিল।
নেতাজি যে ডুবোজাহাজে সফর করছেন তার ক্যাপ্টেন ছিলেন Warner Muizenberg. তাঁর নেতৃত্বে চলা ডুবোজাহাজটিতে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে টোকিওর জার্মান দূতাবাসের জন্য গোপনীয় চিঠিপত্র, জেট ইঞ্জিনের নকশা এবং ওই ধরনের কিছু টেকনিক্যাল কাগজপত্র জাপানি সেনাবাহিনীর জন্য।
একটা কথা বলে রাখা দরকার। সেটা হল, এই ধরনের ডুবোজাহাজ জলের নীচে থাকতে পারে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা। কিন্তু ততক্ষণ থাকলে ভিতরের বাতাসের মান খুব খারাপ হয়ে যায়। তাই দিনে ডুবে থেকে, রাতে উপরে ভেসে চলতে হবে ডুবোজাহাজটিকে। তাই গন্তব্যে পৌঁছতে তিনমাসেরও বেশি সময় লাগবে। কিন্তু সময় যতই লাগুক, উপায় নেই। দিনের বেলায় আকাশে বোমারু বিমানের উৎপাত, আর শত্রুর জাহাজ থেকে ক্ষণে ক্ষণে ডেপথ চার্জ করা হচ্ছে সমুদ্রে। এর মাঝখানে সাবধানে চলতে হবে U-180 ডুবোজাহাজটিকে।
প্রচুর ঘুরে যেতে হচ্ছে ডুবোজাহাজটিকে। সেটি নরওয়ের কুল ধরে যাত্রা শুরু করেছে। এবার পৌঁছবে নর্থ অতলান্তিকে। তারপর পুরো নর্থ অতলান্তিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাবে সাউথ অতলান্তিককে আর চলবে দক্ষিণ দিক ধরে। তারপর কেপ অফ গুড হোপ ঘুরে পৌঁছে যাওয়ার কথা ভারত মহাসাগরে।

কেমন আছেন নেতাজি

কয়েক মাস ধরে নেতাজি যেখানে থাকবেন, সেই থাকার জায়গাটি কিন্তু পুরো অন্ধকার। মেশিনে ডিজেল পুড়ে পুরো বাতাসে ধোঁয়ার সঙ্গে ডিজেলের গন্ধ। যে পাউরুটি খাওয়ার জন্য দেওয়া হতো, সেগুলিও যেন ডিজেলে চুবানো। গায়ে দেওয়ার কম্বলগুলো পর্যন্ত ডিজেলে ভেজানো বলে মনে হচ্ছে। থাকার জন্য সুভাষচন্দ্র ও আবিদ হাসানকে যে জায়গা দেওয়া হল সেটা আসলে জাহাজিদের আসা যাওয়ার রাস্তার পাশে এক টুকরো জায়গা। এটা অফিসারদের মেস হিসেবে ব্যবহার হতো। আবার দরকার হলে চিকিৎসার জন্য অপারেশন করারও জায়গা। এতটাই সংকীর্ণ যে দাঁড়ালে বা পা ছড়িয়ে বসতে গেলে কারো না কারো সঙ্গে ঠোকাঠুকি লাগছে।

আবিদ হাসান , ১৯৯৭ সালে মেইনস্ট্রিম জার্নালে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ” We had romantic notions about the journey in a submarine. When we boarded it we found that the U-Boat had space enough for only one bed. It was a small room where the entire crew, the doctors and we all sat together. We sat up all 24 hours and we sat there motionless. There was no elbow room at all. We felt cramped. It was like solitary confinement. Even in jail the living conditions would be better. It took us two months to travel from Germany to a point off the coast of Madagascar. This was the longest lap of our journey.

যাত্রাপথে ৩ মার্চ U-180 তেল ফের ভরে নিল অতলান্তিক সাগরের মাঝেই আরও একটি সাবমেরিন থেকে। ওই ডুবোজাহাজগুলিকে তেল রিফুয়েলিং করার কাজে ব্যবহার করা হয়।

প্রথমদিকে বেশ কয়েকদিন সি সিকনেস ভোগালো দু’জনকেই। একটু সামলে নিয়ে আবিদ হাসান ডুবোজাহাজ কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে, হাসি ঠাট্টা করে সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু নেতাজি ঘুমোচ্ছেন খুবই কম সময়। রাত দু’টো অবধি লেখালেখি। তারপরেও খুব সকালে উঠে সূর্যোদয় দেখছেন। নিজের আত্মজীবনীর একটা পরিচ্ছদ লিখছেন। নোট দিচ্ছেন আবিদ হাসানকে।

ডুবোজাহাজে চাঞ্চল্য

সাব মেরিনে এই যাত্রার বিবরণ খুব একটা পাওয়া যায় না। অন্তত ২০১০ সাল অবধি, যখন দুই অখ্যাত গবেষক Martin Bamber এবং Aad Neevan, জার্মানির পুরনো সামরিক দস্তাবেজ ঘেঁটে প্রকাশ করেছিলেন, যাত্রা নিয়ে বেশ কিছু তথ্য।
ডুবোজাহাজে যাত্রা চলছে। এরই মধ্যে, ১৯৪৩ সালের ১৮ এপ্রিল, ডুবোজাহাজের ক্যাপ্টেনের নজরে পড়লো একটি ব্রিটিশ পণ্যবাহী জাহাজ, Corbis । সেটিকে টর্পেডো মেরে ডুবিয়ে দেওয়ার হল। তার দু-একদিন পরই ক্যাপ্টেন Musenberg-এর চোখে পড়ল আরও একটি জাহাজ। শত্রুপক্ষের জাহাজ নজরে আসতেই ক্যাপ্টেন সাহেব সবকিছু গুছিয়ে টর্পেডো চালানোর হুকুম দেবেন— এমন সময় ইঞ্জিনে গোলযোগ। পরে এই ঘটনার গল্প শুনিয়েছেন আবিদ হাসান। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে U-180কে জলের উপরে ভেসে উঠতেই হলো। আর সেই সাবমেরিন দেখেই ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার মুখ ঘুরিয়ে ছুটে এলো, ধাক্কা মেরে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য।


সেই সময়, নিজের নির্দিষ্ট জায়গায় বসে, একটি ভাষণ লেখার জন্য মুসাবিদা করছিলেন নেতাজি। ভারতীয় মহিলাদের নিয়ে, যাতে তারা সামরিক যুদ্ধে অংশ নেন। ওদিকে সাবমেরিনের ভিতরের কথা বলার যন্ত্রের মাধ্যমে সুভাষচন্দ্র আর আবিদ হাসান— দু’জনেই শুনতে পাচ্ছেন আতঙ্কগ্রস্থ নাবিকদের চিৎকার। ক্যাপ্টেন চেঁচিয়ে হুকুম দিলেন, জলের নীচে যাও, তাড়াতাড়ি। হাসান সাহেবের চোখে পড়ছিল, চারপাশে মৃত্যুভয়ে ভীত বেশ কিছু চেহারা।
এমন সময় মৃদু ধমকের সুরে নেতাজি তাঁকে বললেন, ” হাসান, একটা পয়েন্ট দু’বার বললাম, তুমি নোটিং নিচ্ছ না!’’
একটা ঝাঁকুনির সঙ্গে U-180 জলের নীচে নিরাপদ দূরত্বে নেমে যেতে সক্ষম হল। সাবমেরিনের উপরের রেলিংয়ের সাথে অল্প আঁচড় কেটে ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার বেরিয়ে গেল। এরপর অবশ্য, ক্যাপ্টেন Musenberg, ডুবোজাহাজটিকে আর এদিক ওদিক না নিয়ে, মূল কাজের যাত্রায় নিয়ে চলতে শুরু করলেন।

দুই ডুবোজাহাজের দেখা

হালকা মায়াবী আলো ছড়িয়ে সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। তবে সমুদ্রের জলের নীচে তো সবসময়েই ঘন অন্ধকার। সেই অন্ধকারে U-180 ডুবোজাহাজের কোড অপারেটর একটি ডিজেল ইঞ্জিন চলার শব্দ শুনতে পেল যন্ত্রের মাধ্যমে।
১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিক সেটা। প্রায় দু’মাস ধরে যাত্রা করার পর, পূর্ব নির্ধারিত জায়গা মাদাগাস্কার এর উত্তর-পূর্বে এসে পৌঁছেছে নেতাজির ডুবোজাহাজ। ক্যাপ্টেন Musenberg সাবমেরিনটিকে জলের উপর ভেসে ওঠার জন্য কম‌্যান্ড দিলেন। বিকেলের সেই অপসৃয়মান আলোয় কিন্তু অন্য কোনও সাবমেরিন দেখা গেল না। পরের দিন একদম সকালে, জার্মানরা প্রথমবার দ্বিতীয় সাবমেরিনটিকে দেখতে পেল এবং পতাকা সংকেতের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিন্ত করলো। জার্মান ক্যাপ্টেনের বেশি ভয় ছিল কমে আসা জ্বালানি নিয়ে এবং সেজন্য তাড়াতাড়ি মিশন শেষ করতে চাইছিলেন।
কিন্তু সেদিন এবং তার পরের দু’দিন সমুদ্র ভয়ঙ্কর উত্তাল অবস্থায় রইল। পনেরো ফুট উচু ঢেউ। দু’টি ডুবোজাহাজ পাশাপাশি উত্তর দিকে ভেসে যাচ্ছে সমুদ্র শান্ত হওয়ার অপেক্ষায়, আকাশে নজর রাখতে হচ্ছে যুদ্ধবিমানের আনাগোনার উপর।

সমুদ্রের এই অংশে জার্মান ডুবোজাহাজ U-180 থেকে জাপানি ডুবোজাহাজ I 29-তে পৌঁছে দেওয়ার কথা নেতাজি ও তাঁর সহযোগীকে। কিন্তু উত্তাল সমুদ্র, কোনও ভাবেই সেই কাজটা সফল হতে পারছিল না।
শেষপর্যন্ত ১৯৪৩-এর ২৮ এপ্রিল, একজন জার্মান অফিসার আর একজন সিগন্যালম্যান সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে একটি মোটা জাহাজি দড়ি বেঁধে দিলেন জাপানি সবমেরিনটির সঙ্গে। এরপর তাঁরা ফিরে এলেন সেই দড়িটির সঙ্গে বাঁধা একটি রাবারের ডিঙি নৌকা এবং দুজন জাপানি নৌসেনা নিয়ে। এবার পারাপার শুরু হবে।
সবচেয়ে প্রথমে জার্মান ডুবোজাহাজ থেকে জাপানি ডুবোজাহাজে গেল ডিপ্লোমেটিক চিঠিপত্র, সামরিক কাগজপত্র। ওদিক থেকে এলেন দু’জন জাপানী নৌসেনা ক্যাপ্টেন— Emi Tetsushiro এবং Tomonaga Hideo, যাঁরা এসেছেন ইউ বোট বানানোর কায়দাকানুন শিখতে। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন শিক্ষার মূল্য হিসাবে আড়াই টন সোনা, আর জার্মানিতে জাপানের দূতাবাসের জন্য কিছু চাল, খাবার।
নেতাজি ও হাসান ততক্ষণে নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছেন। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সাবমেরিন ইউনিটের ডায়েরিতে নেতাজি লিখলেন— ‘ধন্যবাদ, যতটা সম্ভব ততটা যত্ন করে নিয়ে আসার জন্য।’ এরপর লাইফবোট পরে সেই ডিঙি নৌকায় বসলেন দু’জনে। সেটি নিয়ে যাওয়া হল জাপানি সাবমেরিনের কাছে।
পুরো ব্যাপারটিতে হয়তো সময় লেগেছে কয়েক মিনিট। কিন্তু এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রথম ঘটনা— যেখানে সাবমেরিন থেকে সাবমেরিনে পারাপার হয়েছেন দু’জন সাধারণ মানুষ— যা সৃষ্টি করেছে ইতিহাসের।

 জার্মান সাবমেরিন

U-180-র এবার ফেরার পালা। পথে সে একটি গ্রিক ডেস্ট্রয়ার Boris নামের জাহাজটিকে টর্পেডো মেরে ডুবিয়ে দিল। পথে তাকে জ্বালানি ভরে দেওয়ার কথা ছিল U-463 বলে আরও একটি ডুবো জাহাজের। কিন্তু সেটিকে ব্রিটিশ নৌবহর ১৯৪৩ সালের ১৬ মে ডুবিয়ে দেয়। শেষটায় ১৯ জুন ১৯৪৩ সালে, U-530 তাকে জ্বালানি ভরে দিল। প্রথমবারের ঐতিহাসিক সফর শেষ করে সে ডকে ফিরে এল ৩ জুলাই ১৯৪৩ সালে। তবে নেতাজিকে জাপানি ডুবোজাহাজে পৌঁছে দেওয়ার পর আবার জাপানের উদ্দেশে বেরিয়েছিল U-180. সময়টা ১৯৪৪ সালের ২০ অগস্ট। তবে সেবার আর তার ফেরা হয়নি। ২৩ অগস্ট, ১৯৪৪ থেকে তার নামের সঙ্গে লেখা হয়ে গিয়েছে—বে অফ বিস্কে, Bordeaux থেকে ৫৬ জন সেনা-সহ নিখোঁজ।

জাপানি ডুবোজাহাজে নেতাজি

জাপানি সাবমেরিনের কর্মীরা দড়ি ধরে টেনে টেনে রাবারের ডিঙি নৌকাকে নিয়ে এলেন তাঁদের সাবমেরিনের কাছে। তারপর হাত ধরে, দু’জন যাত্রীকে টেনে তোলা।
জাপানি সাবমেরিনটির নাম ছিল I 29. পেনাং থেকে ১৯৪৩ সালের ২০ এপ্রিল এটি যাত্রা শুরু করেছিল। ক্যাপ্টেন অবশ্য আগে থেকেই জানতেন অতিথিদের সম্পর্কে। তবু সাবধানের মার নেই বলে এই সাবমেরিনে নেতাজিকে সম্বোধন করা হচ্ছে মিস্টার মাসুদা বলে।
ডুবোজাহাজে উঠতেই প্রথমে স্যালুট করে অভিবাদন জানানো হল। তারপর অতিথিদের থাকার জন্য ক্যাপ্টেন ছেড়ে দিলেন নিজের কেবিন। এই সাবমেরিনটি বেশ বড়। থাকার ব্যাপারটা আগের তুলনায় আরামপ্রদ।
এই ডুবোজাহাজের ক্যাপ্টেন Teraoka Masao, একজন বিখ্যাত মানুষ নিজেও। ১৯৪১ সালে দু’টো ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ— HMS Repulse ও HMS Prince of Wales কে ধ্বংস করার পিছনে তাঁর অবদান রয়েছে।
মিস্টার মাসুদা ও অন্য যাত্রীদের নিয়ে জাপানি ডুবোজাহাজ যাত্রা শুরু করলো মালয়েশিয়ার পেনাং-এর দিকে। পেনাং-এ যাত্রা বিরতি। জাপানি সেনারা সেদিন তাদের ভারতীয় অতিথিদের জন্য কিনে এনেছে ভারতীয় মশলা। সেটা দিয়ে মশলাদার ঝোল রান্না করে খাওয়ানো হল। সেটা জাপানি সম্রাটের জন্মদিন উপলক্ষে সেলিব্রেশন।

পেনাং থেকে যাত্রা

নেতাজিকে নিয়ে জাপানি সাবমেরিন পৌঁছল সাবাং নামের একটি জায়গায়। সেটি সুমাত্রা- ইন্দোনেশিয়ার কাছে। মে মাসের ছয় তারিখে ওখানে পৌঁছে নেতাজি কয়েকদিন বিশ্রাম নিলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা করতে এলেন কর্নেল Yamamato, যাঁর সঙ্গে নেতাজির প্রথম পরিচয় হয়েছিল জার্মানিতে। তারপর একটি ছোট প্লেনে করে টোকিও পৌঁছলেন নেতাজি। সেটা ১৯৪৩ সালের মে মাসের ১৬ তারিখ।
সেই কবে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ছিলেন নেতাজি। কলকাতা থেকে আফগানিস্তান , রাশিয়া হয়ে বার্লিন। সেখান থেকে এসে পৌঁছে গেলেন টোকিও। এবার শুরু হবে তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায়।

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়