আশিসরঞ্জন নাথ

দক্ষিণ আসামের বরাক উপত্যকার মেলা, উৎসবের তালিকায় আরেকটি উৎসবের নাম যোগ হতে চলেছে। শন বিল উৎসব। বরাকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য এক জলাভূমি এই শন বিল। তাকে নিয়ে প্রথমবারএই ধরনের উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে । দেবদ্বারে ২৪ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে শন বিল উৎসব। লক্ষ্য, এই জলাভূমিকে ভারতের পর্যটন মানচিত্রে তুলে ধরা। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা উৎসবের সূচনা করবেন। সেদিন উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে আসামের পর্যটনমন্ত্রী জয়ন্ত মল্ল বরুয়া ও রাজ্যের জলসম্পদ মন্ত্রী পীযূষ হাজরিকারও। শন-বিল উৎসবের মূল আয়োজক হিসেবে রয়েছে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় (শিলচর)।

শন বিল ভারতের সবচেয়ে বড় এবং এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাভূমি। কোনও জলাভূমিকে কেন্দ্র করে এই ধরনের উৎসব জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বিরল। ফলে উৎসবকে কেন্দ্র করে পর্যটনের সাফল্যের জন্য বুক বাধছেন এলাকার মানুষ। তাঁদের আশা, শন বিলের সৌন্দর্যের কথা ছড়িয়ে পড়ুক দেশ-বিদেশে। প্রকৃতিকে সঠিক মর্যাদা দিয়ে তাকে ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠুক পর্যটন। যা এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক বিকাশে সাহায্য করবে।

বরাক উপত্যকার অন্যতম জেলা করিমগঞ্জ। শন বিল এই জেলাতেই। দক্ষিণে মিজোরামের পাহাড় থেকে উৎপন্ন জলধারা সিংলা নদী দিয়ে বাহিত হয়ে শন বিলে পতিত হয়েছে। আর শন বিলের জল উত্তরের কচুয়া নদী হয়ে কুশিয়ারা নদীতে গিয়ে পড়ছে। গ্রীষ্মে ৪৩৮৮ হেক্টর আর বর্ষায় প্রায় ৯৮০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত শন বিল। এত বড় জলাভূমি গোটা ভারতেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। উৎসবের আবহে শন বিল জলাভূমির রক্ষণাবেক্ষণের দিকটিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বরাকের মানুষজন। কোনও অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে একে পর্যটনস্থলে পরিণত করার জন্য বরাকে সম্ভবতর কোথাও স্থানভিত্তিক উৎসব হয় না। সেক্ষেত্রে শন বিল উৎসব একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ।

এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাভূমি হিসেবে পরিচিত শন বিল। জলাভূমির রক্ষণাবেক্ষণে বিশ্বজুড়ে আলোচনা, সচেতনতা, প্রচার চলছে অনেক বছর থেকে। ইরানের রামসার সম্মেলনে বহু জলাভূমি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। আসামের দীপর বিল রামসার সাইটে ঘোষিত হলেও শন বিল অন্তর্ভুক্ত হয়নি। রামসারে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জলাভূমি সম্পর্কিত প্রথম সম্মেলনে জলাভূমি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশ্ব জলাভূমি দিবস প্রথম পালিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। আর ওই বছর থেকে জলাভূমি সংক্রান্ত সম্মেলন রামসার কনভেনশন নামে পরিচিত হয়। রামসার কনভেনশনের লক্ষ্যই হল বিশ্বব্যাপী জলাভূমির অবক্ষয় রোধ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারে তার সংরক্ষণ এবং এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। এই লক্ষ্যের সবক’টিই শন বিলের ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য। একসময় শন বিলে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসত। শীতের শেষে ফিরেও যেত। শন বিলে অন্তত ১৫০ টির বেশি প্রজাতির পাখির রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু এখন পরিযায়ী পাখিরা বিরল দর্শনে পরিণত হয়ে পড়েছে। ইকো সিস্টেমের পরিবর্তন,জলবায়ুর পরিবর্তন এবং অন্য কারণগুলির জন্য পরিযায়ী পাখিরা আর এ মুখো হয় না বলে মনে করা হচ্ছে। শন বিলকে রামসাইট ঘোষণা করা এবং ecotourism-এর উদ্যোগ নেওয়া হলে হয়তো পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে।

বরাকের ‘শন বিল উৎসব’ নেহাৎ বিনোদন উৎসব হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। জল বা জলাভূমি সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে এই উৎসব। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (শিলচর) অধ্যাপক মানবেন্দ্র দত্ত চৌধুরী এই উৎসবের প্ল্যানিং অ্যান্ড ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে রয়েছেন। শন বিল অঞ্চলের ভূমিপুত্র মানবেন্দ্রবাবু দীর্ঘ দিন থেকে এই জলাশয়ের আনাচে কানাচের খোঁজখবর রেখে চলেছেন। গবেষণার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ। শন বিলের সুরক্ষা এবং ম্যানেজমেন্টের নানা পরামর্শ এবং পরিকল্পনা সরকারের কাছেও পেশ করেছেন। শন বিল নিয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পার্থঙ্কর চৌধুরীর গবেষণা সন্দর্ভও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন জার্নালে। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ( শিলচর) ভূতপূর্ব অধ্যাপক দেবাশিস করও শন বিল নিয়ে গবেষণা করেছেন। শনবিলের ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ হিসেবে খ্যাত প্রয়াত শ্যামলাল দাসের ‘শনবিলের কথা’ বইটিতেও যথেষ্ট তথ্যের সন্ধান মেলে। ওই অঞ্চলের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী সুমন্ত দাস বহু তথ্যের জোগান দিয়েছেন অনেক গবেষক ও লেখককে।

ফলে একটি অনন্য জলাভূমিকে ঘিরে যে এলাকার মানুষের এতটা আগ্রহ, সেখানে শন বিল উৎসবের আয়োজন একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেই আশা করা হচ্ছে। আয়োজকদের আশা, পর্যটনের পাশাপাশি জলাভূমি সংরক্ষণ ও এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বড় ভূমিকা পালন করবে এই ধরনের উৎসব। সেজন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, লোকশিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এই উৎসবে।

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়