হাইলাইটার, আই শ্যাডো, গ্লসি লিপস্টিক (Lipstick)। নারীর চোখের দ্যুতিকে মোহময়ী করে তুলতে কিংবা তার ঠোঁটকে আরও আকর্ষনীয় করে তুলতে এসবের জুড়ি নেই। নিজের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে তাই এগুলি ব্যবহার করেন অনেকেই। কিন্তু জানেন কি, আপনাকে উজ্জ্বল করে তোলার এই উপকরণ তৈরি হচ্ছে বহু শিশু শ্রমিকের জীবনের বিনিময়ে।

শুনতে আশ্চর্য  লাগছে না? অনেকেই বলবেন, নারীর সৌন্দর্য্য বিকাশের সঙ্গে শিশুর জীবনে ঝুঁকির সম্পর্ক কি? হ্যাঁ, সেই যোগের কথা এখন সামনে আসছে। আসলে আপনার মেকআপ বক্সে সাজিয়ে রাখা আই শ্যাডো, হাইলাইটার, গ্লসি লিপস্টিক তৈরিতে লাগে এক বিশেষ ধরনের অধাতব খনিজ। নাম, মাইকা (mica)। তেরো- চোদ্দটি কেমিক্যাল এলিমেন্ট নিয়ে তৈরি এই মাইকা। বেশির ভাগটাই সিলিকা ও অ্যালমিনিয়াম। এছাড়া পটাশিয়াম অক্সাইড ,ফেরিক অক্সাইড। এ সবের সংমিশ্রনেই তৈরি হয় মাইকা। আর এটিই হল নারীকে কৃত্রিম সৌন্দর্য্যে রূপবতী করার চাবিকাঠি।

সারা পৃথিবীতে যে সব এলাকায় সবচেয়ে বেশি মাইকা উৎপাদন হয়, ভারতের ঝাড়খণ্ড ও বিহার তার অন্যতম। বিতর্ক মাইকা উৎপাদনকে ঘিরেই। ১৯৮০ সালে পরিবেশ দূষণের কারণ দেখিয়ে ভারতে মাইকা উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ঝাড়খণ্ডে পরিত্যক্ত খনিগুলি থেকে মাইকা উত্তোলনের অবৈধ ব্যবসা চলছেই। এখানে পরিত্যক্ত খনিগুলি থেকে মাইকা তুলে আনছে অসংখ্য শিশু(Child Labour)। এদেরই একজন পূজা ভার্লা। বয়স এগারো। বাড়ি গিরিডির অদূরে ঝুমরী লাইয়া এলাকায়। আট বছর বয়স থেকে পরিতক্ত খনিতে মাইকা খোঁজার কাজ করছে পূজা। একটি চ্যানেলের সাংবাদিককে পূজা তার জীবনের কথা শুনিয়েছে।

ব মিলিয়ে সারা ভারত জুড়ে প্রায় ২২০০০ শিশুশ্রমিক কাজ করে এইসব পরিত্যক্ত মাইকা খনিগুলিতে

সাংবাদিক – তুমি এই খনিগুলিতে সপ্তাহে কতদিন কাজ করো ?

পূজা- রোজই মাইকা তুলতে আসি।

সাংবাদিক- রোজ?

পূজা- মাইকা না তুললে খাবো কি ?

এ কথা বলেই একটি ঝুড়ি নিয়ে পূজা চলে যায় সংকীর্ণ গুহার ভিতরে। তারপর নেমে যায় নীচে। গুহার ধাপে ধাপে পা মিলিয়ে মিলিয়ে যায় সে। কিছুক্ষণ পরেই পাথর মেশানো এক ঝুড়ি মাটি নিয়ে ফিরে আসে। 

সাংবাদিক- তোমার ভয় করে না ওই ভাবে খনির ভিতরে ঢুকতে ?

পূজা- হ্যাঁ, ভীষণ ভয় করে। একবার যদি মাটি ধসে পড়ে, জানি বেঁচে ফিরব না। নিজের চোখে এক বন্ধুকে মাটি চাপা পড়ে মরতে দেখেছি।

সাংবাদিক- কি বলছো ? এখানে খনিগুলিতে ধস নামে ?  তা-ও তোমরা ভিতরে যাও ?

পূজা – খিদের জ্বালা থেকে মরা ভাল।

সাংবাদিক- তোমার বাবা-মা কোথায় ? আর এই কাজ করে কত পাও?

পূজা- বাবা-মা মজুরের কাজ করেন। আর আমি সারাদিন কাজ করে দশ-কুড়ি টাকা পাই।

সংবাদিক- মাত্র দশ-কুড়ি টাকা! আচ্ছা, তোমাদের এখানে স্কুল নেই?  পড়াশুনা করতে ইচ্ছে করে না?

পূজা- করে। কিন্তু আগে তো খেতে হবে। 

ঝাড়খণ্ডের অবৈধ খনিতে শিশুরা

বহু বছর ধরে ভারত বিশ্বব্যাপী শীট মাইকার সবচেয়ে বড় উৎপাদক এবং রপ্তানিকারক হিসাবে স্বীকৃত। মূলত বিহার আর ঝাড়খণ্ড হল মাইকা উৎপাদনের কেন্দ্র। গরিব পরিবারগুলিতে বাঁচার লড়াইয়ের মধ্যেই স্কুলে না গিয়ে অনেক শিশু কিশোর কিশোরী পৌঁছচ্ছে মাইকার অবৈধ খনিতে শ্রম বিক্রি করতে। সেখানে মাত্রাতিরিক্ত দূষণে কিছুদিনের মধ্যে শিশুদের শ্বাসকষ্টের (Child Diseases) রোগ ধরে যায়। খনিগুলিতে সারাদিন ধরে থাকার কারণে চামড়়ায় দেখা দেয় মারাত্মক রোগ। বুড়িয়ে যায় দশ-বারো বছরের শিশু। শুধু পূজা নয়, এমন অসংখ্য শিশুকেই খুঁজে পাওয়া যাবে অবৈধ খনিগুলিতে। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরে দিন শেষে যাদের রোজগার দশ-কুড়ি টাকা। যে কোনও সময়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে যায়। আর অবৈধ খনিতে দুর্ঘটনা ঘটে গেলে ক্ষতিপূরণও মেলে না। খনিতে কাজ করা শিশুদের উপর যৌন ও শারীরিক নির্যাতন বা মানব পাচারের  বিপদ সবসময়েই থেকে যায়।

তবে রয়টার্স (Reuters) জানিয়েছে, ঝাড়খণ্ড সরকার এই ক্ষেত্রটিকে বৈধ করতে চাইছে। তারা কিছু আইন আনতে চাইছে, যাতে মাইকা মাইনিং গ্রামবাসীদের কাজের সুযোগ তৈরি করে। সরকারের ধারণা, তেমন হলে বয়স্করা এই কাজে আসতে চাইবেন। শিশুদের আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হবে না। প্রক্রিয়াটি অবশ্য ধীরগতিতে চলছে ।