কখনও কখনও কিছুই ভাল লাগে না। মনে হয় দমবন্ধ হয়ে আসছে। এরকম কম বেশি সবার মধ্যেই হয়ে থাকে। কেউ বুঝতে দেয়, কেউ দেয় না। কিন্তু মানুষের মন হঠাৎ করে তো আর খারাপ হয় না, তার পিছনে কোনও না কোনও কারণ তো নিশ্চয়ই থাকে। তাই নিজেকে নিজেই প্রশ্নটা করতে হবে, মন খারাপের কারণটা খুঁজে বের করতে হবে । আর এই খারাপটাকে দূর করে মনকে আনন্দে ভরিয়ে তুলতে হবে । কিন্তু কী ভাবে, তাই তো ?
হয়তো আমরা সচেতন ভাবে বুঝতে পারি না, অবচেতন মন কিন্তু বুঝতে পারে। খুব বেশি মন খারাপ থাকলে স্বাভাবিক কাজকর্মের উপর তার প্রভাব পড়বেই । নিজস্ব কাজের জগতে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আর মন খারাপ নিয়ে যে সিদ্ধান্তগুলি আমরা নিয়ে থাকি, তা অনেক সময় পরবর্তী জীবনের জন্য খারাপও হয়ে থাকে। তবে খারাপ মনটাকে ভাল করার উপায় কিন্তু আমাদের নিজেদেরই হাতে।
শুনতে অবাক লাগলেও এটাই কিন্তু বাস্তব সত্য— এই মন ভাল করার চাবিকাঠি কিন্তু আমাদের নিজেদেরই হাতে। আজ তাই নিয়ে আলোচনা করব।
হঠাৎ খারাপ হয়ে যাওয়া মন নিমেষের মধ্যেই ভাল হয়ে যেতে পারে। সত্যিই ভাল হয়ে যায়। কী ভাবে ? এক একজনের ক্ষেত্রে এক একভাবে ।
অনেকেই গান শুনতে ভীষণ ভালোবাসেন। মন খারাপ হলে তাই গান শুনলে অনেকের মন ভাল হয়ে যায়; কিংবা গান শুনতে শুনতে ঘর সাজানো , গাদা গাদা কাজ করা , আলমারির জামাকাপড় গোছানো , বইগুলোকে পরিস্কার করে তাদের আদর করে চুমু খাওয়া , শরীরচর্চা করে প্রচুর ঘাম ঝরানো— এসব করলে দেখবেন ম্যাজিকের মতো মন ভাল হয়ে যাবে। আবার গান শুনতে শুনতে নতুন নতুন সব পদ মনের মাধুরী মিশিয়ে রান্না করলে ধীরে ধীরে মনটা সত্যিই ভাল হয়ে যায় ।
তবে মন খারাপের দায় কখনওই কারও উপরে চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। অনেককেই দেখেছি মন খারাপের কথা সকলের সাথে ভাগ করে নিতে পছন্দ করেন, তাঁরা মনে করেন মনের কথা কারও সাথে ভাগ করে নিলে মনটা খুব হাল্কা লাগবে। অনেকেই আবার মন খারাপের কথা কারও কাছে বলতে পারেন না। আসলে কিছু ব্যথা, কিছু যন্ত্রণা, চোখের দু-ফোঁটা জল— এ যে সত্যিই একান্ত আপন । এ সব কি সত্যিই কারও সাথে ভাগ করা যায়? চিন্তা করে দেখুন দুঃখের কথা ভাগ করে নেবার মধ্যে সত্যিই কি কোনো কৃতিত্ব রয়েছে ? আপনার দুঃখ আরও একজনের মধ্যে ঢেলে দিলেন। ভাল কিছু দিতে পারলেন কি ?
দুঃখের কথা, যন্ত্রণার কথা, মন খারাপের কথা ভাগ করার মধ্যে সত্যিই মহৎ কিছু নেই। তবে সেই জোরটা অনেকেরই থাকে না। খুব কম মানুষই আছেন, যাঁরা নিজের সব ব্যথা নিজের কাছেই রাখেন। সেই বিশেষ মানুষদের বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই মনের মধ্যে কতটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অথচ তিনি হাসছেন, সবার সঙ্গে গল্প করছেন, আর মনের ভেতরটা তোলপাড় করছে কেউ বুঝতেও পারছেন না। আবার অনেকে উল্টো, অল্পতেই কাহিল হয়ে পড়েন। কারও সাথে সেই অনুভূতি নিয়ে যতক্ষণ না আলোচনা করছেন ততক্ষণ শান্তি পান না। আবার কিছু মানুষ বুঝে উঠতে পারেন না সেই পরিস্থিতিতে ঠিক কী করা উচিত বা উচিত নয়।
প্রথমেই যেটা করতে হবে, মন খারাপের কারণ নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে। সেটা বোঝা গেলে, তার নিরাময়ের রাস্তাও বেরবে। খুব বেশি রকম মনের অসুখ হলে মনের চিকিৎসকের কাছে যেতেই হবে। তবে মনের অসুখ যাতে বাড়তে না পারে, কয়েকটা কাজ করা যেতে পারে—
১। মন খারাপের অন্যতম কারণ হল, কোনও কাজ খুঁজে না পাওয়া, অর্থাৎ অলস সময় পার করা। এতে একঘেয়েমি আসে যা মন খারাপের রূপ নেয়। তাই একঘেয়ে ভাব প্রথমে কাটাতে হবে। কিন্তু কী ভাবে? প্রথম উপায় বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনের সঙ্গে কথা বলা। সময় কিছুটা তো কাটবেই। এখন প্রায় সকলের কাছেই আছে মোবাইল, তাই ফোন করে গল্প করলে মনটা হাল্কা হয়ে যাবে। একদিকে যেমন মন ভাল হবে তেমনি যাঁর খোঁজখবর নিচ্ছেন তাঁরও ভাল লাগবে ।
২। বাইরে বা ছাদে গিয়ে খোলা বাতাস, উন্মুক্ত আকাশ উপভোগ করলে মন ভাল হয়ে যায়। তাছাড়া, রাতের আকাশের কিন্তু সুন্দর মায়াবী রূপ আছে। মন খারাপ হলে ছাদে একটু পায়চারি করলে কিম্বা আপন মনে তারাদের দেখলে মনটা কেমন মোলায়েম হয়ে যায়।
৩। যোগ ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করতে পারেন। নিয়মিত করলে শরীর আর মন খারাপ কোনওটাই তেমন রেখাপাত করবে না। আর যাঁরা নিয়মিত করেন না, তারা যদি শরীর চর্চা শুরু করেন, দেখবেন মনটা কেমন ভাল হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত করুন।
৪। আপনার ভাল লাগে এমন কোনও মিউজিকের সাথে নাচ করতে পারেন। নাচ করলে ভীষণ মন ভাল হয়ে যায়। যে কোনও মিউজিকের সাথেই নাচতে পারেন । দেখবেন মনটাও কেমন নেচে উঠবে পায়ের সাথে সাথে, শরীরের সাথে সাথে। আর যাঁরা নাচ ছেড়ে দিয়েছেন— একটা দু’টো স্টেপ দিয়েই শুরু করুন, ফিরিয়ে আনুন সেই নাচকে। ফিরিয়ে আনুন পুরনো ভালবাসাকে।
৫। গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করুন, মন ভাল হয়ে যাবে।
৬। বই পড়ুন, যার যেমন ভাল লাগে তেমন বই নির্বাচন করুন। বই পড়ার বিশেষ উপকারের দিক হল, আপনি নিশ্চয় সেখান থেকে কিছু না কিছু জানতে পারবেন। জীবন সম্পর্কে আপনার নতুন একটি ধারণা সৃষ্টি হবে। তাই মন খারাপ দূর করতে বই পড়াকে একটি মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলাই যায়।
৭। কিছু সময় মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার থেকে একদম দূরে থাকতেই হবে । এটা কিন্তু একেবারে হাতে হাতে ফল পাবেন । সারাক্ষণ মোবাইল কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকার ফলে অনেক সময়ই আমরা বাস্তব জীবনের সাথে নিজেদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে তখন বেশ কষ্ট হয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এসব ব্যবহার না করলে শরীর ও মন দুইই ভাল থাকবে।
৮। ঘর গোছালে বা সাজালে মন ভাল হয়ে যায় । চারপাশটা যদি সাজানো গোছানো থাকে তবে মন ভাল থাকবে । দ্বিতীয়ত, ঘর গোছানোর মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়।
৯। শখের কাজ করলেও মন ভাল থাকবে। পুরনো হারমোনিয়াম বা গিটার পরিস্কার করে একটু বাজাতেই পারেন। সত্যিই কি ইচ্ছে করে না নিজের হারিয়ে যাওয়া অনুভূতিকে আবার ফিরে পেতে ? সেই কবেকার কত হারিয়ে যাওয়া নাচ বা গান বা ছবি আঁকা, আবৃত্তি করা বা শখের জিনিসকে কাছে টেনে আনা । দেখবেন, এতে মনটা আশ্চর্য রকম ভাবে ভাল হয়ে যাবে।
১০। সুন্দর হাসি মন ভাল রাখার সব চেয়ে সেরা ওষুধ। একটা হাসি মাখা মুখ যেমন মনকে ভাল করে দেয়, আবার নিজে হাসলেও মন ভাল হয়ে যায়।
১১। হাঁটলে কিন্তু বেশ সতেজ লাগে। ঘরে যদি ভালো না লাগে তবে হাঁটতে বেরিয়ে যান।
১২। চা-কফি খেতে খেতে পরিবারের মানুষদের সঙ্গে আড্ডা দিন। ভাল করে স্নান সেরে মন চায় এমন খাবার খান। আর বাড়িতে একান্তই যদি কাউকে না পান, নিজেই কফি আর মুখরোচক কিছু খেতে খেতে দারুণ হাসির সিনেমা দেখতে দেখতে আর হাসতে হাসতে নিজেকে বলুন ‘এই দেখো আমি তোমায় কতো ভালবাসি …।’