মনের কিছু প্রাথমিক কথাবার্তা দিয়েই শুরু করা ভাল। 

স্বাস্থ্য দু-রকম – শারীরিক এবং মানসিক। অথচ শরীরকে আমরা যে মূল্য দিই, মনকে তা দিই না। একটা সহজ নমুনা দিলেই সেটা স্পষ্ট হবে। ‘শরীর খারাপ’—এই শব্দবন্ধটি আমাদের যতটা উদ্বিগ্ন করে, ‘মন খারাপ’ শব্দবন্ধটি ততটা মোটেই করে না। অর্থাৎ, শরীরের ভালমন্দ নিয়ে আমরা যতটা তৎপর, মনকে নিয়ে তা একেবারেই নই। এ কথা ঠিক, শরীর ভাল না থাকলে মনও ভাল থাকতে পারে না। আবার এ-ও ঠিক যে শরীর ভাল থাকলেই মন সবসময় ভাল থাকবে এরকম কথা নেই। শরীর অসুস্থ হলে আমরা চটজলদি ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে পড়ি। কিন্তু মনের অসুস্থতা স্বীকার করতে সদাই মহা আপত্তি। মনের ডাক্তারের কাছে যেতে তো আরও নারাজ। কারণ, তাহলে নাকি ‘পাগল’ বলে প্রতিপন্ন হতে হবে। এবং সাধারণ ধারনা এরকম যে মানুষ পাগল হলেই একমাত্র মনোবিদের কাছে যায়। শিক্ষিত মহলেও এই ধারণা বেজায় জনপ্রিয়। পরিণামে, মন বেচারি উপেক্ষা আর অবহেলার পাত্র হয়েই পড়ে থাকে যতদিন না সত্যি সত্যিই সেই অসুস্থতা গুরুতর পর্যায়ে কিংবা হাতের বাইরে চলে যায়।

প্রতিদিনের জীবনে নানা ঘটনা, পারস্পরিক সংযোগ, আচার-আচরণ ব্যক্তির মনের ওপর নেতিবাচক অভিঘাত সৃষ্টি করে। তার প্রভাব মনকে সুস্থ থাকতে বাধা দেয়। নিজের প্রতিক্রিয়ার ওপর সবসময় আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলত, তার পরিণতি কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে তা নিয়ে ভাবিত হই না আমরা। মনের ভাল থাকা না থাকার দায় বস্তুত ব্যক্তির নিজের ওপরেই বর্তায়। কিন্তু সমস্যা এই যে সেই দায় অন্য কোনও ব্যক্তি, বস্ত কিংবা ঘটনার ওপর চাপিয়ে দেওয়াটাই দস্তুর। এই চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা যত বেশি হয়, সমস্যা ততোই গভীর হতে থাকে, সমাধান দূর অস্ত। কেন এই চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা? আসলে আমরা যে কোনও সমস্যা বা সংঘাতের ক্ষেত্রে নিজেদের দোষত্রুটি স্বীকার করে নিতে নিতান্তই অনিচ্ছুক। ঘটনার গভীরে গিয়ে তার মূল কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে যে দায়িত্ব নিজেকে নিতে হয়, তার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত নই পাছে নিজের দোষত্রুটি ধরা পড়ে যায়। তাই যতক্ষণ সম্ভব সমস্ত দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াই রীতি। কিন্তু প্রশ্ন হল, নিজের ত্রুটিকে আড়াল করে কি সমস্যার জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব? কখনও নয়। 

ব্যক্তিগত সংঘাতের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত পরস্পরকে দোষারোপ করতেই অভ্যস্ত। তার ফলে দু’পক্ষই জেদ ধরে বসে থাকে এই প্রত্যাশায় যে অপরজন এসে নিজের ভুল স্বীকার করে নেবে। এই জেদই আমাদের বাধা দেয় খোলা চোখে ঘটনাটির বিশ্লেষণ করতে। ইংরেজিতে একটি সুন্দর, বাস্তবসম্মত কথা চালু রয়েছে: Apology does not mean that you are wrong and the other person is right. Apology means you give more importance to your relationships than your ego. ‘ইগো’ বা ‘অহম্’ এর ঘেরাটোপ থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালে জীবনের বড় ছবিটাকে স্পষ্ট করে দেখা যায়। আমাদের জীবনে যে সম্পর্কগুলোকে আমরা সত্যিই মূল্য দিতে চাই, যেসব সম্পর্ক আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ, সেই সব সম্পর্কগুলোকে ইগো-র জানলা দিয়ে দেখলে তারা কখনওই টেকসই হতে পারে না। যে মানুষের সান্নিধ্য এবং মতামতকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে থাকি, তাঁর কাছে নিজের দোষত্রুটি স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে লজ্জাবোধ কিংবা আত্মমর্যাদাবোধ খোয়ানোরও কোনও কারণ নেই। বরং যে মানুষ প্রয়োজনে ক্ষমা চাইতে দ্বিধাবোধ করেন না, মানুষ হিসেবে পরিচিত মহলে তাঁর ঔজ্জ্বল্যই বাড়ে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও পোক্ত করে তুলতে সাহায্য করে। 

এই যে আমরা ‘ইগো’ বা ‘অহম্’কে হাঁকুপাঁকু করে আঁকড়ে থাকি, এটা আসলে নিজেকে অন্যের থেকে আড়াল করার চেষ্টা। আড়াল করার চেষ্টা নিজের কাছ থেকেও। আমরা কি কখনও নিজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করি? কখনও কি ভেবে দেখতে চেষ্টা করি– আমি কে বা আমি কী, আমি কেমন? নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলোকে অপরের ওপর চাপিয়ে দিয়ে অনেকে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। নিজের ব্যক্তিত্বকে এভাবেই শান দেবার চেষ্টা। সম্পর্ক নামক বস্তুটি এই ধরনের লোকেদের কাছে নিতান্তই অর্থহীন এক বায়বীয় পদার্থ মাত্র। এরকম মানসিকতা অবশ্যই স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।

ব্যক্তি হিসেবে একজন সচেতন মানুষের প্রথম কাজ হল, নিজেকে চেনার চেষ্টা করা। নিজেকে চেনা বলতে আমরা বুঝবো— নিজের আবেগ অনুভূতিগুলিকে ঠিকঠাক ভাবে চেনা। অর্থাৎ, বিভিন্ন পরিবেশ পরিস্থিতিতে আমাদের যে প্রতিক্রিয়া হয় সেগুলিকে বুঝে ওঠা। কোনও বিশেষ পরিস্থিতিতে আমার কেন বিশেষ এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়, তার কারণ খুঁজে দেখা। দ্বিতীয়ত, নিজের সক্ষমতা-অক্ষমতা, গুণ-দোষ ইত্যাদি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া। অর্থাৎ আমি কী কী ধরনের কাজ করতে সক্ষম এবং অক্ষম। আমার সক্ষমতার এবং অক্ষমতার পিছনের কারণগুলি খুঁজে দেখা জরুরি। আত্মসচেতনতা অর্জনের মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের আচার- আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখি। প্রতিদিনের যাপনে অনেক বেশি নমনীয়তা অর্জন করতে পারি। খুব বেশি আবেগের বশীভূত হয়ে পড়া, সহজেই হতাশ হয়ে পড়া এবং অবিবেচনাপ্রসূত হঠকারিতা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি। আত্মসচেতনতা অর্জনের এই চর্চায় আমাদের সহায়ক হয়ে উঠতে পারেন সেই সব মানুষেরা যাঁদের মতামত, ভাবনাচিন্তা এবং পরামর্শকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকি। হতে পারেন তিনি বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব কিংবা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে কেউ।

নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে যথাযথ ভাবে সচেতন হতে পারলে নিজের ওপর আস্থা ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গিতে দুনিয়ার দিকে তাকানো যায়। একই রকম ভাবে, নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত হতে পারলে খামতিগুলিকে শুধরে নেবার তাগিদ তৈরি হয় নিজের মধ্যে। প্রতিদিনের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অসাফল্যের মুখোমুখি মাঝে মাঝে হতে হয়, তাতে আশাহত না হয়ে নিজের সীমাবদ্ধতাগুলিকে চিহ্নিত করতে পারলে সেগুলো কাটিয়ে উঠে সাফল্যের মুখ দেখা সম্ভব। নিজের স্বভাব ও আচার আচরণ সম্পর্কে শুভাকাঙ্খীদের মতামত ও পরামর্শের গুরুত্ব অসীম। তবে তার আগে দরকার প্রকৃত শুভাকাঙ্খীকে চেনা। তাঁদের মতামতের সবটুকুই যে খুব মিষ্টিমধুর হবে এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। হওয়ার কথাও নয়। সেক্ষেত্রে ক্ষুণ্ন হলে নিজেরই ক্ষতি বই লাভ নেই। তাঁদের বক্তব্য নিজের সঙ্গে নিবিড় ভাবে মিলিয়ে দেখতে হবে। সেই নমনীয়তা না থাকলে তা আয়ত্বে আনতে হবে। সেটা সম্ভব নিজেকে চেনার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই। সমালোচনা কিংবা বিরূপ মন্তব্যকে সহ্য করতে না পারাও এক গুরুতর অক্ষমতা। সেটা মাথায় রাখতে হবে। বরং ভেবে দেখতে হয় সেই সমালোচনা বা বিরূপ মন্তব্য যৌক্তিক কিনা।

যদি মনে হয় যুক্তিসিদ্ধ, তাহলে উপকারিতা দু’রকমের। প্রথমত, সমালোচক যে প্রকৃতই আপনার হিতাকাঙ্খী তা প্রমাণিত হল। দ্বিতীয়ত, নিজের সম্পর্কে আপনার সচেতনতা অনেকটা বেড়ে যাওয়ায় খামতিগুলিকে পূরণ করার পথে এগোনোর একটা চেষ্টা থাকবে আপনার।

নিজের আবেগ-অনুভূতিগুলিকে চিনে নেবার ব্যাপারটাও তেমনটাই। কোন কোন ধরনের পরিস্থিতিতে আপনার আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট, রাগ, অভিমান, বিষণ্নতা, বিরক্তি, হতাশা, উচ্ছ্বাস এই সব অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে— এই প্রতিক্রিয়াগুলির উৎসে পৌঁছতে পারাটা নিজেকে চেনার জরুরি কিছু পন্থা। সদর্থক ও নঞর্থক – দুরকম আবেগ-অনুভূতিই থাকে। নঞর্থক অনুভূতিগুলো মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সেগুলি মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদাসীনতার কারণেই আমরা আমাদের এইসব আবেগ-অনুভূতিগুলোকে চিনে ওঠার ব্যাপারে সচেষ্ট হই না। দিনের শেষে ঘুমোতে যাবার আগে একবার অন্তত কিছুক্ষণের জন্য পিছন ফিরে দেখুন তো আপনার সারাদিনের নানা ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যে আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে তার মধ্যে কার সংখ্যা বেশি— সদর্থক না নঞর্থকের? সদর্থক অনুভূতির সংখ্যা বেশি হলে অবশ্যই আমাদের বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে।