হিম্যান, সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান,ব্যাটম্যান কিংবা খাঁটি ভারতীয় শক্তিমান গোছের কাল্পনিক অতিনায়কের গল্পে মজেনি, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু এই গল্পের নায়ক কোনও কাল্পনিক চরিত্র নন। বরং ঊনষাট বছরের ক্যানসার-জয়ী এক প্রৌঢ়। নাম, অলগরথানম নটরাজন। কিন্তু ‘মটকা ম্যান’ নামেই তাঁকে একডাকে চেনেন দক্ষিণ দিল্লি সংলগ্ন এলাকার আপামর মানুষজন।
দিল্লির আবহাওয়া বরাবরই চরমভাবাপন্ন। জলসঙ্কটও নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা। কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল হয়ে উঠছে দিন-দিন। খাস দেশের রাজধানীর বুকেই ‘জল পাই কোথা?’— এই প্রশ্ন করতে করতে জিভ বেরিয়ে যায় পথিকের। অথচ সুতীব্র গরমে এক আঁজলা তৃষ্ণার জল অধরাই থেকে যায়। দীর্ঘ চার দশক লন্ডনে কাটিয়ে সদ্য দেশে ফেরা অলগরথানমকে ভাবিয়ে তুলল গোটা বিষয়টা।
আসলে ক্যান্সারকে হারিয়ে জীবনে ফেরাটাই বদলে দিয়েছিল অলগরথানমের জীবনকে দেখার চোখ। তাঁর কথায়, ‘দেশে ফেরার ইচ্ছে বরাবরই ছিল। কিন্তু ক্যান্সারই যেন সেই প্রায় ভুলতে বসা ইচ্ছেটাকে উস্কে দিল।’ লন্ডনে এক স্যুভেনির দোকান-মালিক দেশে ফিরে হয়ে উঠলেন ‘চলমান জলসত্র’। বেঁচে থাকা জীবন আর সময়টুকু সমাজকে দেবেন বলে মনস্থির করে ফেলেন অলগরথানম। জড়িয়ে পড়েন বেশ কিছু অনাথ আশ্রম, ক্যান্সার পুনর্বাসন কেন্দ্র ইত্যাদির সঙ্গে। তবু কোথাও যেন একটা তৃপ্তির অভাব।
বেঙ্গালুরুতে জন্মানো নটরাজনকে নাড়া দিল দিল্লির জল-সঙ্কটে আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের নগ্ন চেহারা। ফুটপাথের হকার, রিকশাওয়ালা, ঝাড়ুদার— তীব্র গরমেও কাজে বিরতি নেই কারোর। অথচ তেষ্টা মেটানোর জন্য একান্ত জরুরি জলটুকুও জোটে না। বোতলের ঠান্ডা জল কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই যাঁদের, তাঁদের কথা ভেবেই নটরাজন প্রথমে বাড়ির সামনে একটা ওয়াটার কুলার বসিয়েছিলেন। কিন্তু এ’টুকু জলে আর ক’জনের গলা ভিজবে! শহর জুড়ে এই উদ্যোগকে ছড়িয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু ইলেকট্রিকে চলা ওয়াটার-কুলারের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ তো বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। দেশের মানুষের সেবা করতে চেয়ে দেশজ পরম্পরার হাত ধরলেন নটরাজন। শহরের আনাচ-কানাচের ৭০টি জায়গায় বসালেন মাটির বড় বড় জালা বা কলসি। এ সেই আজব কলস, যার জল কখনও ফুরোয় না।
কাকভোরে দিন শুরু হয় নটরাজনের। বেরিয়ে পড়েন নিজের জলযান নিয়ে। ৮০০ লিটারের ট্যাঙ্ক-পাম্প-জেনারেটর লাগিয়ে নিজের মারুতি ভ্যানকে বদলে ফেলেছেন ‘অলৌকিক’ জলযানে। ভরা গ্রীষ্মে অন্তত চার বার জল ভরতেই হয় কলসিগুলিতে। এই সময়ে রোজ গড়ে ২০০০ লিটার জল লাগে। নটরাজন জানান, ‘একটি স্কুল এবং দু’জন সহৃদয় ব্যক্তি এই কাজের জন্য নিয়মিত জল দেন। যেটুকু ঘাটতি থাকে, তা আমার বাড়ি থেকে পুষিয়ে দিই।’ প্রত্যেকবার জল ভরতে বেরোলে চার-পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে।এ জন্য বাধ্য হয়েই একজন সহায়ক রেখেছেন নটরাজন। আর প্রত্যেকটা মটকার গায়ে লিখে দিয়েছেন নিজের ফোন নম্বর। জল ফুরোলেই যাতে তিনি খবর পান, তাই এই ব্যবস্থা। জল খেতে-খেতে দু’দণ্ড জিরিয়ে নেওয়ার জন্য রয়েছে বেঞ্চও। জল ভরতে-ভরতেই আবার গরিব মানুষদের জন্য রোজ ৪০-৫০ কেজি মরসুমি ফল-সবজি বিলিয়ে থাকেন নটরাজন। নিজের বসতি এলাকার আশপাশে বসিয়েছেন শ’খানেক সাইকেল পাম্পও। কেউ নিজের বাড়ির বাইকে কলসি রাখলে, ভরে দেন তা-ও।
আসলে আজকের যুগে দাঁড়িয়ে যখন শুধু নিজেরটুকুই বুঝে নেওয়াটা দস্তুর, সেখানে নটরাজনের মতো মানুষেরা আলো ছড়ান। ‘দ্য মটকাম্যান’ নামের একটি বেশ জনপ্রিয় ভার্চুয়াল গেমে দেখা যায় এক জন কলসির ভিতরে আটকে পড়া মানুষ কী ভাবে সব বাধা ডিঙিয়ে এগোনোর চেষ্টা করে। বাস্তবের ‘মটকাম্যান’ কিন্তু আমাদের নিজস্ব এই স্বার্থপরতার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার পাঠই দেন তাঁর কাজ আর যাপনের মধ্যে দিয়ে।