পর্ব ১১

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

কোটি টাকার ব্যবসা। যা সুন্দরবনের জলদস্যুদের নিয়ে তৈরি। আর এই ব্যবসার আয়ের মূল সোর্স ছিল সুন্দরবনের অসহায় জেলে, মাওয়ালী ,বাওয়ালীরা। মূলত এদের কষ্টার্জিত অর্থ লুট করে তা  দিয়ে চলতো এক একটা গোষ্ঠী। কেমন সে গোষ্ঠী? সবাই আছে তাতে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে পুলিশ, সাংবাদিক, উকিল, মোক্তার, পদস্থ কর্মচারী, মাছ ব্যবসায়ী সবাই। গরিব মানুষগুলিকে বঞ্চিত করে, তাদের রক্ত চুষে খাবার জন্য তৈরি হয়েছিল সেই সম্মিলিত বাহিনী। বাহিনীর সামনের দিকে ছিল জলদস্যুরা। যারা সরাসরি সেই টাকা আদায় করতো জেলে, বাওয়ালীদের থেকে। খুলনার এক মাছ ব্যবসায়ীর কাছে শুনেছিলাম, বছরে প্রায় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা তোলা আদায় করা হতো জেলেদের থেকে। সেই টাকার থেকে আশি নব্বই লক্ষ টাকা থাকতো জলদস্যুদের কাছে। বাকি টাকা ছড়িয়ে পড়তো বিভিন্ন মাধ্যমে। 

 গত শতাব্দীর আটের দশক থেকে সুন্দরবনের মাছের ব্যবসা ভীষণ বেড়ে যায়। এলাকায় তৈরি হয় মাছের মহাজন। বাংলাদেশের সুন্দরবন একটি বিরাট এলাকা, প্রচুর নদী আর সেই নদীতে প্রচুর সুস্বাদু মাছ। মাছের মহাজনেরা বুঝতে পারে— যে যত এলাকা দখল করতে পারবে, তার তত লাভ। আর তাই নিজেদের এলাকা বাড়ানোর উদ্দেশে তারা পুষতে শুরু করে ডাকাত বাহিনী। শোনা যায়, একসময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফিশারম্যান কো-অপারেটিভের অধিকারী নিজেই ছিলেন একজন বড় জলদস্যু। আসে নয়ের দশক। এই সময় জলদস্যুবাহিনীগুলি ভয়ঙ্কর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শোনা যায়, তারা সেই সময় বনবিভাগের অফিসগুলিকেই নিজেদের বাড়িঘর বানিয়ে ফেলেছিল। পাটকোষ্টা, হংসরাজ ,মাদারবাড়িয়া ,হারবাড়িয়া ,চরাপুটিয়া, মরাভোলার বন অফিসগুলি জলদস্যুদের সরাইখানা নামে কুখ্যাত ছিল। ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে কোনও গোলমাল হলে পুলিশ নিজেই মধ্যস্থতা করতো দুই জলদস্যুবাহিনীর মধ্যে। (তথ্যসূত্র :-খসরু চৌধুরী—সাংবাদিক, লেখক)

ফিরে যাই মূল প্রসঙ্গে।

রাজু না চাইলেও আমি আমার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। শহীদুল রাজি। আমার মনে হচ্ছিল, তাড়াটা যেন শহীদুলের দিক থেকেও কম নয়। কথা বলে জেনেছিলাম, গ্রামের প্রভাবশালী মাতব্বররা বাড়ির স্ত্রী ও মেয়েদের শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। বাড়ি ফিরতে হবে। আর নয়। আত্মসমর্পণ করতেই হবে।

শহীদুলের সঙ্গে কথাবার্তা চুড়ান্ত করে আমি ঢাকা থেকে মংলায় পৌঁছলাম। কিন্তু তারপর থেকে আর শহীদুলের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। কেটে গেলো কয়েক ঘণ্টা। বেশ কিছুক্ষণ পরে ফোনে পেলাম তাকে। আমার কাছেই তখন এশার আজান হচ্ছিল। শহীদুলের মোবাইল থেকেও ওই একই আওয়াজ পেলাম। বুঝতে পারলাম, শহীদুল কাছেই আছে।

-আপনি কোথায়? মংলায় ?

তার অবস্থান আমি টের পেয়েছি, বুঝতে পেরেছে শহীদুল। ভাই পরে ফোন করছি— বলেই ফোনটা কেটে দিলো শহীদুল।

না আর ফোন করেনি সে। পরদিন জানতে পারলাম, ক্রসফায়ারে মারা গেছে তরুণ জলদস্যু শহীদুল।

রাজুর চাপে দলের অন্য সদস্যরা তাকে দড়ি বেঁধে লোকালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর তারপর খবর দিয়েছে ৱ্যাবকে।

রাজুই তাকে নেতা বানিয়েছে, আবার রাজুই তাকে তুলে দিয়েছে ৱ্যাবের হাতে। কি নির্মম পরিণতি ছেলেটির !

অনেক ভেবেও আমি এই হিসাবে মেলাতে পারিনি। যে নিজেই চেয়েছিল আত্মসমর্পণ করতে, সেই রাজু তার দলের কাউকে আত্মসমর্পণ করতে দিতে রাজি নয়। কেন ? কি সেই ধাঁধা?

আসলে সুন্দরবনের জলদস্যু বাহিনীগুলির একটি অলিখিত নিয়ম আছে। জলদস্যুদের অস্ত্রের মালিক দলের নেতৃত্ব দেবে। রাজু বাহিনীর বেশির ভাগ অস্ত্র রাজুর। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমাগত চাপে রাজুকে অজ্ঞাতবাসে চলে যেতে হয়, যাবার আগে সে শহীদুলকে নেতৃত্বের ভার দিয়ে যায়। সুন্দরবনের লুটের টাকা ভাগের নিয়ম ছিল, অস্ত্রের মালিক পাবে ৬০ শতাংশ। বাকি ৪০ শতাংশ বাহিনী চালানোর খরচ ও অন্য জলদস্যুদের ভাগ। রাজুর দলে ছিল রাজুর অনেক আত্মীয়স্বজন। তারা ঠিক শহীদুলকে মেনে নিতে পারেনি। তারাই চেয়েছিল তাদের মধ্যে কেউ বাহিনীর নেতৃত্ব দিক। এরা প্রতিনিয়ত রাজুকে খবর পাঠাতো। আর এরাই শহীদুলের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে উপরে মানে ডাঙায় পাঠিয়ে দেয় ও বাহিনীকে খবর দেয়।

রাজুর আত্মসমর্পণ না করতে চাওয়ার কারণ আমার মনে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযান। ওই অভিযানে অনেকটাই আত্মবিশ্বাস হারিয়েছিল রাজু। ওর ভয় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওকে পেলে বাঁচতে দেবে না। মেরে ফেলবে।

যাই হোক, শহীদুলের মৃত্যুর পরে রাজু বাহিনীর ভার গিয়ে পড়ল নোয়া মিয়ার কাঁধে। রাজু ডেরায় পরিচয় হয়েছিল নোয়ার সাথে। নোয়া রাজুর এক আত্মীয়। কিন্তু নোয়া বড় নরম স্বভাবের। বাহিনী চালাতে একজন কঠোর মনের মানুষের দরকার। নোয়ার ক্ষেত্রে তা একেবারেই ছিল না। বাহিনী চালানোর কোনও যোগ্যতা তার ছিল না। আর রাজুও নেই তল্লাটে। রাজুর দল আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করলো। বাকিরা অনাস্থা প্রকাশ করলো নোয়ার উপরে।

বেশিদিন টিকতে পারলো না নোয়া। সুন্দরবন ছেড়ে দিল।

ইলিয়াস। একটি তরুণ, সুগঠিত স্মার্ট ছেলে। রাজুর ডেরায় ওকে দেখে প্রথমেই বুদ্ধিমান মনে হয়েছিল। নোয়া চলে যাবার পরে ইলিয়াস নিল পুরো রাজু বাহিনীর দায়িত্ব। ডাকাবুকো ছেলে, কোনও  ভয়ডর নেই। একটা থ্রি নট থ্রি বন্দুক হাতে নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে বলেছিল ‘‘তোলেন ভাই তোলেন, কোনও সমস্যা নাই।’’

খুব অল্পদিনের মধ্যে ইলিয়াস রাজুর দলকে আবার একটি বড়সড় দলে পরিণত করলো। আশপাশের প্রচুর ছোট ছোট উপদল মিশে যায় রাজু বাহিনীতে। পুরোটাই হয়েছিল ইলিয়াসের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতার জন্য।  প্রায় দেড়শ জনের একটি দল বানিয়ে ফেলে সে। আর ইলিয়াস হয়ে উঠলো সুন্দরবনের আর একজন অবিসংবাদী নেতা। বাহিনীর নামও পাল্টে হল ইলিয়াস বাহিনী।

মোবাইল নেটওয়ার্ক পেতে গেলে গাছে আপনাকে উঠতেই হবে

ইলিয়াসের জলদস্যু হবার গল্পটাও কম ঘটনাবহুল নয়। একটি সাধারণ ছেলে ছিল ইলিয়াস। কয়রা এলাকার এক মহাজনের ট্রলারের সহযোগী হিসেবে কাজ করতো। কাজ ছিল ট্রলারের জমা পানি বাইরে বের করে দেওয়া। ওই ট্রলার থেকেই এক দস্যুদল তাকে অপহরণ করে। না মহাজন, না তার কোনও স্বজন—ইলিয়াসকে ফিরিয়ে আনার জন্য কেউই মুক্তিপণ দিলো না। তাই দস্যুদলের সাথে থেকে গেলো ইলিয়াস। শুরুতে ফরমাইশ খাটতো। ওই ফরমাশ খাটতে খাটতে একদিন দলের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছিল ইলিয়াস। তারপর ক্ৰমে দস্যু দলের নেতা।

আমিও বেশ কিছুদিন চুপচাপ থাকার পরে আবার শুরু করলাম আমার কাজ। দস্যুদের আমি আত্মসমর্পণ করাবোই। খোঁজ লাগানোর চেষ্টা করলাম ইলিয়াসের। কিছুদিনের মধ্যেই আমার সঙ্গে যোগাযোগও  হল। একদিন তার সাথে দেখা করতে চলেও গেছিলাম সুন্দরবনের গহীনে।

আমি চারদিন ছিলাম ইলিয়াসের ডেরায়। একটা জিনিস বুঝতে পারলাম, রাজু দূরে থাকলেও নিজের বাহিনীর উপর ওর নিয়ন্ত্রণ সাংঘাতিক। ইলিয়াস কিন্তু সবসময় মেনে চলতো রাজুর কথা। রাজুর নির্দেশ ছিল, কোনও কিছুতেই আত্মসমর্পণ করা যাবে না। পরে আসছি সেই কথায়।

সেই সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেষ্টা করছিল জলদস্যু নির্মূল করে এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে।  বরগুনা, পিরোজপুর ,পটুয়াখালী-সহ কয়েকটি উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে ছিল জলদস্যু বাহিনীর দাপট। দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয়েছিল বন্দুকের লড়াই। আর তাতেই অস্থির হয়ে উঠেছিল সুন্দরবন।

(ক্রমশ)