ভারতের অন্যতম বৃহৎ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, নন্দন নিলেকানি মনে করছেন— মহামারী, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি আরও একটি বড়সড় সঙ্কট এখন আমাদের সামনে আসছে। এই সঙ্কট হল, বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ।
দুনিয়ায় অনেক মানুষের হাতেই স্মার্ট ফোন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে বিভিন্ন বিষয়ে কৌতূহল মেটাচ্ছে মানুষ। কেউ আবার দিনভর বসে ল্যাপটপ কিংবা ডেস্কটপে। প্রেম-ভালবাসা-বিক্ষোভ-প্রতিবাদের অস্ত্র হয়ে উঠেছে মোবাইল। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় মানুষ পা রাখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। এই সময়েই নতুন সঙ্কটের কথা তুলে ধরেছেন নিলেকানি।
‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিলেকানি ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে তাঁর মতামত জানিয়েছেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, প্রযুক্তি কি মানবতাকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে? নন্দন জানান, বিষয়টি তিনি সে ভাবে দেখতে রাজি নন। তাঁর কথায়, ‘‘ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার সারা পৃথিবী জুড়ে, বিশেষ করে শেষ দু’বছরে মহামারীর মধ্যে মানুষ আরও বেশি করে ডিজিটাল প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আজ আমরা বাড়ির প্রতিটি জিনিস, এমনকি খাবার পর্যন্ত ডিজিটাল মাধ্যমে কিনতে শুরু করেছি। এমনকি, সম্পর্কগুলি আজকের দিনে ডিজিটাল হয়ে গিয়েছে। ঠাকুমা তাঁর নাতি-নাতনির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে ডিজিটাল মাধ্যমের সাহায্য নিচ্ছেন।’’ নন্দন বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, ডিজিটাল মাধ্যমের অত্যাধিক ব্যবহার ভবিষতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ধারণাকে পাল্টে দেবে। কারণ, মানুষ ধীরে ধীরে তার সম্পর্কগুলি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তাই আমি এই সমস্যাকে আজকের পৃথিবীর তৃতীয় সবচেয়ে বড়ো সমস্যা বলে মনে করি।’’
ইনফোসিস কর্তার মতে, এই সময়ে বড় সমস্যা অবশ্যই মহামারী, যেখানে ভাইরাস পৃথিবীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। দ্বিতীয় সমস্যা, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিববর্তন—পৃথিবী জুড়ে পরিবেশে কার্বনের মাত্রা বৃদ্ধি। আর তৃতীয় সমস্যা হল, পৃথিবী আজ ডিজিটাল প্রযুক্তির দাসে পরিণত হচ্ছে। নিলেকানি বলেন, ‘‘এটা হতে দেওয়া যায় না। একজন মানুষের এই প্রলুব্ধময় ডিজিটাল প্রযুক্তির নেশা থেকে বেরোনো দরকার। ডিজিটাল প্রযুক্তিকে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু সেই নেশায় ভেসে যাওয়া উচিত নয়।এই নেশা মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারে।’’
প্রশ্ন – আপনি কী ভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেন?
নন্দন – আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় অংশগ্রহণ করি না।…আমার তিনটি ডিভাইস রয়েছে। একটি ল্যাপটপ, যেখানে রিসার্চের কাজ করি। দ্বিতীয়,পড়াশুনার কাজের জন্য একটি আই প্যাড। আর তৃতীয় মাধ্যম, একটি ফোন। কথাবার্তা বলা আর এসএমএস করার জন্য সেটাকে ব্যবহার করি। হ্যাঁ, আমার একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সেটার সাহায্যে আমি আমার কোনও রিসার্চ বা মতামত প্রকাশ করি। তবে কোনও আলোচনায় যোগ দিই না।
প্রশ্ন – দুনিয়া জুড়ে আজ তথ্য নিয়ে কারবার। কিন্তু আমাদের দেশে বা বেশির ভাগ দেশে তথ্যসুরক্ষা বা গোপনীতার উপর কোনও আইন তৈরি হয়নি। আপনার কি মনে হয়, এ কারণে যে কোনও মানুষের তথ্য সহজে অন্যদের নাগালের মধ্যে চলে আসছে। বিঘ্নিত হচ্ছে মানুষের সুরক্ষা ?
উত্তর – নিশ্চয়ই! অবশ্যই একটি শক্তিশালী আইন থাকা দরকার। তথ্য সুরক্ষার আইনের প্রস্তাব ভারতের আইনসভায় আনা হয়েছে। তবে আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে ডিজিটাল দুনিয়ার ব্যবহারকারীদের সতর্ক হওয়া উচিত। তথ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্রাহককে নিজের একটি সীমা নির্ধারণ করা উচিত। কেউ বলতে পারেন, আইন ছাড়া কী ভাবে সেটা সম্ভব ? কিন্তু আপনি কোন এজেন্সিকে আপনার সীমায় ঢুকতে দেবেন, সেটা নিজেকে ঠিক করতে হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। যে শিশুর কাছে ডিজিটাল জগতে প্রবেশের সুবিধা রয়েছে, সে কিন্তু যার সেই সুবিধা নেই, সেই শিশুর থেকে অনেক এগিয়ে থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই শিশুটিকে একটি পরিধিটিকে বাধতে হবে। জগতে প্রচুর হাতছানি। কিন্তু একজনের উচিত, তাঁর পছন্দ সঠিক ভাবে নির্ণয় করা। এটাই হল, তথ্য প্রযুক্তির সীমানা। চাকরি ,স্বাস্থ্য ,শিক্ষা ক্ষেত্রে যারা প্রযুক্তির সাহায্য পাচ্ছে, তারা অনেক বেশি এগিয়ে যাচ্ছে। মনে রাখা দরকার, আমরা আজকের দিনে প্রযুক্তির কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছি। তাই যারা প্রযুক্তির হাত ধরছে না, ধরতে পারছে না—তারা পিছিয়ে পড়ছে। আজকের দিনে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক বেশি জটিল ও অসমতায় ভরা।
প্রশ্ন- দিনে দিনে প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে। এর ফলে কি মানুষের বুদ্ধি ও সহজাত উদ্ভাবনী ক্ষমতা নতুন ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে? নাকি প্রযুক্তির অত্যধিক ব্যবহার মস্তিষ্ককে অক্ষম করে তুলছে?
উত্তর – তথ্য প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার মানুষকে দিকভ্রষ্ট করে দেয়। প্রথম যে কাজ হল, নিজেকে সংযত করা। নিজেকে একটি সিস্টেমের মধ্যে সাজানো। যাতে প্রযুক্তি কারও উপর চেপে না বসে।
প্রশ্ন -আগামী দিনে কাজের পরিবেশ কেমন হতে চলেছে? যেমন সুইডেন সপ্তাহে চারদিন কাজ করার কথা ঘোষণা করেছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা এই যে মেটা ভার্চুয়াল বিশ্ব (Meta Virtual World)—সেই জগতে আমাদের ভবিষৎ প্রজন্ম কী ভাবে সমাজের পরিবর্তন বা কাজের পরিসরকে মানিয়ে নেবে?
নন্দন- ভবিষতে কাজের ক্ষেত্রে কয়েকটি নতুন দিকের উন্মেষ ঘটবে। প্রথম দিক হল, তুমি কোথায় বসে কাজ করছো ? অফিসে নাকি বাড়িতে বসে বা আংশিক বাড়িতে আর আংশিক অফিসে! এই কর্মসংস্কৃতির প্রকাশ ঘটেছে বিশ্ব মহামারীর কারণে। আমার কাছে এই মুহূর্তে এ প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। তবে কোম্পানিগুলিকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। দেখতে হবে, ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য কী করে তারা কাজের পরিসরকে মসৃণ করবে।