এ যেন কৃষ্ণের সুদর্শন চক্র। উড়ে যাচ্ছে শত্রু নিধনে। তবে ইনি আকাশে ভাসবেন মারতে নয়, দেখতে শুনতে। মহাভারতে সঞ্জয় যেমন কুরুক্ষেত্রে না-থেকেও ধৃতরাষ্ট্রকে শুনিয়ে গিয়েছে যুদ্ধের লাইভ টেলিকাস্ট, এ যেন তারই বাস্তব রূপ। হাত থেকে উড়ে গিয়ে চোখের সীমানা ছাড়িয়ে, তুলে আনবে জীবন্ত বর্ণনা। কয়েক মাস পরেই হাতে আসতে চলেছে এমনই ড্রোন-মোবাইল।
৬.৯ ইঞ্চি মোবাইল থেকে এক ক্লিকে বেরিয়ে আসবে দেড় ইঞ্চি বাই দেড় ইঞ্চি সামান্য বেধের ড্রোন। উড়ে যাবে ২০০ মেগাপিক্সেল ক্যামরা নিয়ে, লক্ষ্যবস্তুর বিভিন্ন কোন থেকে ভিডিও তুলতে থাকবে। রেকর্ড হবে মূল মোবাইলে। বাড়ির টিভি যেমন চলে রিমোটে, তেমনই মূল মোবাইল থেকে ইনফ্রারেড রশ্মি ড্রোনকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ব্যাটারি শেষ হবার আগেই যা ফিরে আসবে আপনার হাতে।
অর্ধ শতাব্দী আগেও কবি সাহিত্যিকেরাও কল্পনা করতে পারেন নি এমন ম্যাজিক ডিভাইসের। ধরা যাক, ইয়ান ফ্লেমিং-এর জেমস বন্ড কিংবা সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কুর কথা। সেখানেও এমন আজব বস্তুর ভাবনা নেই।
একটা গল্প বলি।
সবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শুরু হয়েছে ঠান্ডা যুদ্ধ। জেমস বন্ড এসেছেন ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে। উদ্দেশ্য, ডেনমার্কের অজান্তে সমুদ্রগর্ভে গোপন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন। ডেনিস পুলিশ সর্বক্ষণ নজর রেখেছে। বন্ড পিছনের প্রাচীর পেরিয়ে মোটর সাইকেলে চেপে এক পার্কের দেওয়ালে পাশে সেটা রাখলেন। গুটি পায়ে সন্তর্পণে রাস্তা পেরিয়ে একটা চারতলা বাড়ির পিছন দিকে এসে দাঁড়ালেন। টপ ফ্লোরের একটা ঘরে বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থার আস্তানা। এখানেই আজ চারজনের মিটিং হবার কথা। বাজপাখির চোখে বন্ড চারিদিক জরিপ করলেন।
নাঃ। কেউ দেখছে না।
এবার জলের পাইপ বেয়ে সবে দু-পা উঠেছেন, ওমনি দুই কিশোরের একজন হাসতে হাসতে বলে উঠলো,
“এই যে বন্ড, নেমে এসো। ভয় নেই। আমরা শত্রুপক্ষের নই।”
নেমে ধীর পায়ে বন্ড এসে দাঁড়ালো, স্ট্রিটলাইটে পরিষ্কার দেখতে পেল নির্মল পবিত্র দুই বালকের মুখ। হতভম্ব বন্ড কেমন যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, “কি চাও বল তো?”
ঐশ্বরিক এক বালক বলল, ” তুমি তো জানো না, চারতলায় একজন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। উঠলেই নিঃশব্দ বন্দুকের গুলিতে তোমাকে মেরে লাশ গায়েব করে দিত।”
আশ্চর্য হয়ে গেল বন্ড। বলল, ” তুমি জানলে কী করে?”
–“এই দেখো আমাদের মোবাইলে।”
মোবাইলের পাশে এক জায়গায় ক্লিক করতেই, দেড় ইঞ্চি বাই দেড় ইঞ্চি ক্যারাম গুটির মত মোটা চৌকোনা ড্রোন সোজা চারতলার ছাদে। মোবাইলের স্ক্রিনে বন্ড দেখতে পেল সেই ঘাতককে। আরেকটু হলেই ভবলীলা সাঙ্গ হতো আর কি! একজন বলল, “দেখ বন্ড, তোমার স্রষ্টা ফ্লেমিং কিন্তু এত দূর কল্পনা করতে পারেননি। তাহলে তোমার অস্ত্র ভান্ডারের প্রধান প্রফেসর Q, এরকম কিছু একটা বানাত।”
অপরজন বলল, “জানো তো ভারতে এক সাহিত্যিক ও অস্কারজয়ী পরিচালক ছিলেন। তোমার প্রফেসর Q এর মতো তারও ছিল প্রফেসর শঙ্কু। Q কিন্তু শুধু মারণাস্ত্র বনিয়েছে। প্রফেসর শঙ্কু ধ্বংসাত্মক অ্যানিহিলন পিস্তলের সঙ্গে সঙ্গে মানব কল্যাণের অনেকগুলি ধন্বন্তরি ওষুধও আবিষ্কার করেছিলেন। ধর শত্রুর আঘাতে তোমার বড় কোনও ক্ষত হল। মিরাকিউরল বড়ি খেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওটা সম্পূর্ণ জোড়া লেগে যাবে। তাঁর কল্পনা কিন্তু অনেক মানবিক ও সুদূরপ্রসারী”— বলে সে থামল।
দ্বিতীয়জন শুরু করল, “তবে হ্যাঁ, কেউই কিন্তু ড্রোন ক্যামেরা ফোনের কথা ভাবেননি।”
এ পর্যন্ত সবটাই কল্পকাহিনী। যার মাধ্যমে এটা পরিষ্কার, অর্ধ শতাব্দী আগেও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকেরা যতটা কল্পনা করেছিলেন, ডিজিটাল বিশ্ব তাঁকে ছাড়িয়ে অনেক দুর এগিয়ে গিয়েছে।
ড্রোন ক্যামেরা কথা আমরা শুনেছি আফগানিস্তানের যুদ্ধে, কাশ্মীরে জঙ্গি বিরোধী অভিযানে বা সিনেমা শুটিং এর প্রস্তুতিতে। পাহাড়ের সুরঙ্গে লুকিয়ে থাকা তালিবানের অবস্থান জানতে বা কোনও গোপন ডেরায় ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গিদের খুঁজে বের করতে এক ধরনের জবড়জং যন্ত্র। অ্যাটাচির মতো বড় একটা নিয়ন্ত্রণ বাক্স, সঙ্গে ৩ফুট বাই ৩ ফুটের মতো চার পাখার কোয়াড্রিকপটার।
কিন্তু ড্রোন ক্যামেরা ফোন একদম আলাদা। ৬.৯ ইঞ্চি মোবাইল থেকে এক ক্লিকে বেরিয়ে আসবে দেড় ইঞ্চি বাই দেড় ইঞ্চি বেধের ড্রোন। উড়ে যাবে ২০০ মেগাপিক্সেল ক্যামরা নিয়ে, লক্ষ্যবস্তুর ভিডিও তুলবে। রেকর্ড হবে মোবাইলে। মূল মোবাইল থেকে ইনফ্রারেড রশ্মি ড্রোনকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এই ড্রোনটি কতক্ষণ উড়বে সেটা স্পষ্ট করে কেউ বলেনি, তবে মোটামুটি সেটা ৫ মিনিটের কিছু কম। ভাবুন তো, এই যে স্যাটেলাইট সংযোগের OB ভ্যান, লাইফ টেলিকাস্টের অন্যতম হাতিয়ার। বিশাল খরচ সাপেক্ষ। বড় সংবাদ সংস্থা ছাড়া বহন করা দুঃসাধ্য। ড্রোন ক্যামেরা মোবাইল এটাকে জলভাত করে দেবে। সামান্য টাকাতে কেনা এই বিশেষ মোবাইলের সাহায্যে কোন সাংবাদিক গোপন আস্তানা থেকেও জীবন্ত বিবরণ দিতে পারবে।
এট সম্ভব হয়েছে মূলত দু’টো কারণে। এক ৫জি সম্প্রচার। দুই, ৫জি ভিত্তিক সেমিকন্ডাক্টর চিপসের জন্য।
কয়েক মাসের মধ্যেই বাজারে চলে আসছে যুগান্তকারী এই গ্যাজেটটি। প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে ভিভো, সাওমি, নকিয়া, স্যামসং ইত্যাদি । মোটামুটি ভাবে দাম ৮০,০০০ টাকা, তবে স্যামসুঙের একটু বেশি। চিপসেট আমেরিকার কোয়ালকমের স্ন্যাপড্রাগন ৮৯৮, ৫জি। ব্যাটারি ৮০০০ mAh, মূলবডির ক্যামেরা ছাড়াও ড্রোনে যুক্ত থাকবে ২০০ এমপি ক্যামেরা।
এ পর্যন্ত বেশ গোলাপের রঙে রঞ্জিত। কিন্তু এটা ব্যক্তিজীবনের গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করবে নাতো? খুব অসম্ভব নয়। আরেকটু উন্নত হলেই ইনি এক ঘণ্টার উপরে ভিডিও করতে সক্ষম হবেন। তখন কোনও প্রেমিক প্রেমিকার ঘনিষ্ঠ মূহূর্তের ভিডিও তুলে কেউ যদি ব্ল্যাকমেল করে? এরকম গ্যাজেট হাতে থাকলে বেশ সহজেই সেটা করা সম্ভব। জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ড্রোন ক্যামেরা অনায়াসে ঘরে ঢুকে পড়বে। একান্ত নিজস্ব জীবন বলে কিছু থাকবে না। বে-আব্রু হবে সবকিছু।
এতো গেল ব্যক্তি জীবনের গোপনীয়তা।
সবচেয়ে বড় প্রশ্নবোধক চিহ্নের মুখে পড়বে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। এই ছোট্ট পোকাটাকে কোনও রাডার ধরতে পারবে না। খালি চোখেও দেখা যাবে না। অনায়াসে ঢুকে পড়তে পারবে দেশের কেন্দ্রগুলির নিরাপত্তা বেষ্ঠনীকে টপকে। এটা জঙ্গিদের বড় হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। আবার উল্টোদিকে নিরাপত্তা বাহিনীকেও অনেক সময়ে নজরদারির জন্য সাহায্য করতে পারে এটি। দু’টো উল্টো উদাহরণ টেনে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
যেমন ভারতীয় সংসদ আক্রমণের সময় জঙ্গিদের হাতে এই ধরনের গ্যাজেট থাকলে নিরাপত্তার ফাঁকগুলি সহজেই খুঁজে নিতে পারতো তারা, আরও অনেক প্রাণহানি হতো। আবার এই ড্রোন-মোবাইল হাতে থাকলে আজমল কাসবদের জঙ্গিদলটাকে আগেই শেষ করে দেওয়া যেত। চারদিন ধরে হোটেলে লুকিয়ে থাকার পর ১৬৪ জনের প্রাণ নিতে পারতো না তারা। সেদিন মুম্বইয়ে হেলিকপ্টার থেকে ছাদে নেমে আর নিচ থেকে তাজমহল হোটেলে কমান্ডো অভিযান করতে হয়েছিল স্রেফ আন্দাজের ভিত্তিতে। ফলে মোবাইল ড্রোন ক্যামেরা একদিকে জঙ্গিদের সহায়ক হয়ে উঠতে পারে আবার বিপরীতে জাতীয় নিরাপত্তার হাতিয়ারও হতে পারে। এ যেন সেই ছুরি, ডাক্তার অপারেশন করে রোগী বাঁচায়, আবার খুনির হাতে পড়লে মানুষ হত্যা করে।
কৃষ্ণের হাতে সুদর্শন চক্র না হয় দুষ্টের শাসন শিষ্টের পালন করে। হাতবদল হলেই তো উল্টো।
সুতরাং ফিরে আসছে সেই পুরনো বিতর্ক। বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ।