চিনের তৈরি কৃত্রিম সূর্যের কথাটা ভাবতেই কল্পনা ডানা মেলতে থাকে। তাহলে তো আমাদের মেরু অঞ্চল, যেখানে ৬ মাস রাত্রি, সেখানে এই কৃত্রিম সূর্য স্থাপন করা যেতে পারে। উত্তর বা দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি থাকা দেশগুলি তখন সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা হয়ে উঠবে। তবে এস্কিমোরা বিদ্রোহ করতে পারে! তাঁদের ইগলু গলে যাবে, তখন তাঁরা কোথায় বা আর বলগা হরিণ টানা স্লেজ চালাবে? অথবা রাতের আকাশে আরেকটু বেশি উজ্জ্বল কৃত্রিম চাঁদ থাকলে বিজলিখোর টিমটিমে স্ট্রিট লাইটের আর দরকার হবে না। আজকের বিদ্যাসাগরদের চোখের ক্ষতিও হবে না।
আসল বিষয়টা কিন্তু অন্য রকম। সূর্য যেমন সব শক্তির উৎস, তেমনি অবিরাম বিশাল কোন শক্তির উৎসকে কৃত্রিম সূর্য বলা যেতে পারে। চিন এরকম একটা নিউক্লীয় সংযোজন রিঅ্যাক্টার বানিয়েছে— যেখানে সূর্যের চেয়ে ৬ গুণ বেশি তাপমাত্রা (৭ কোটি ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড) প্রায় ১৮ মিনিট (১০৫৬ সেকেন্ড) ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। এর নাম ইস্ট (EAST= Experimental Advanced Superconductivity Tokamack)। টোকামাক হল নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়ার পরীক্ষাগার। ২০০৩ সালে ফ্রান্সে টোর সুপ্রার টোকামাক একই উত্তাপ ৩৯০ সেকেন্ড ধরে রাখতে পেরেছিল। সেই রেকর্ড চিন ভেঙে দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, আকাশে থাকা আমাদের চিরকালের সূর্য যখন একই ভাবে পৃথিবীটাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে, তখন পরীক্ষাগারে এমন একটা কৃত্রিম সূর্য তৈরি করতে হঠাৎ কেন তেড়েফুঁড়ে নেমে পড়ল চিন? এতে কোন কাজটা সমাধান হবে তাঁদের? আর সূর্যের সৃষ্টি নিখরচায় হলেও কৃত্রিম সূর্য তৈরি করতে কত অর্থ খরচ করে ফেলেছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ? ব্যাপারটা একটু গভীরে গিয়ে দেখা যেতে পারে।
পারমাণবিক চুল্লি আমাদের কাছে মোটেই অপরিচিত নয়। ভারতেই মোট ২২টি পারমাণবিক চুল্লি রয়েছে। এই সেদিনও ৭০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার চাপিত ভারী জলের চুল্লি স্থাপন করা হল। এরকম আরও ১৬টি রিঅ্যাক্টার বসার কথা। এই চুল্লিগুলি সবই নিউক্লিয় বিভাজন বিক্রিয়ার জন্য। এখানে একটা ভারি নিউক্লিয়াস দু’টো মাঝারি মাপের নিউক্লিয়াসে ভেঙে যায়, আর ভরের রূপান্তর ঘটে বিপুল শক্তিতে। সঙ্গে তিনটি নিউট্রন যার দু’টি মডারেটরের মধ্যে দিয়ে গিয়ে পুনরায় আবার দুটি ভারি নিউক্লিয়াসকে ভাঙে। এই ক্রমাগত ভাঙা বা শৃঙ্খল বিক্রিয়া অনিয়ন্ত্রিত হলে অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণ আর নিয়ন্ত্রিত হলে পারমাণবিক চুল্লি— যা থেকে মেলে বিপুল পরিমাণে বিদ্যুৎ শক্তি। তবে পরমাণু চুল্লি ঘিরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলছে প্রতিবাদ। কারণ, এ থেকে উৎপন্ন তেডস্ক্রিয় বর্জ্য দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির সৃষ্টি করে। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিলের পারমানবিক চুল্লির বিপর্যয়ের কথা সকলেই জানেন। এই সেদিনও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে আবারও শিরোনামে উঠে এসেছিল চেরনোবিল। রাশিয়ার সেনা চেরনোবিল দখল করেও তীব্র তেজস্ক্রিয়তার সংক্রমণের কারণে ওই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। প্রায় ৩০ বছর পরও ওই তেজস্ক্রিয় বিষক্রিয়ার খামতি নেই।
কিন্তু সেদিক থেকে দেখলে সংযোজন বিক্রিয়া কিন্তু কোনরকম দূষণ ঘটায় না।, এটি তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি করে না (যা করে তা-ও একেবারে ক্ষণস্থায়ী, তুচ্ছ)। এছাড়া, এতে গ্রিনহাউজ গ্যাসও তৈরি হয় না। ফলে এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ নিরাপদ। এ থেকে মিলতে পারে একেবারে ক্লিন এনার্জি।
আমাদের আলোচনার এই কৃত্রিম সূর্য হল, নিউক্লিয় সংযোজন। তবে বলে রাখা ভাল, চিনের কৃত্রিম সূর্যে চমক থাকলেও এই ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা কিন্তু বহু আগে থেকেই বিশ্বের অনেক দেশে চলছে। নিউক্লিয় সংযোজন হল সূর্যের সব শক্তির আসল রহস্য। হাল্কা নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত বড় নিউক্লিয়াসের সৃষ্টি, সেই সাথে অফুরন্ত শক্তি। দুনিয়ায় সবচেয়ে হাল্কা হল হাইড্রোজেন, নিউক্লিয়াসে একটিই মাত্র প্রোটন। মৌলের নিউক্লিয়াসের প্রোটন সংখ্যাই তার মূল পরিচয়, রাসায়নিক ও ভৌত ধর্মের নির্ধারক। লোহা যে সোনা হয় না, তার কারণ শুধুমাত্র ওই প্রোটন সংখ্যা। কোনওভাবে লোহার নিউক্লিয়াসে ২৬-এর বদলে ৭৯টি প্রোটন ঢুকিয়ে দিতে পারলেই লোহা হয়ে যেত সোনা। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় যা-ই হোক, লোহাকে সোনা করা অবশ্য কোনও পরশপাথরের কাজ নয়। নিউক্লিয় সংযোজন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, হাইড্রোজেনের তিনটি আইসোটোপ রয়েছে। অর্থাৎ, প্রোটন সংখ্যা একই কিন্তু নিউট্রন ভিন্ন। হাইড্রোজেনের একটিই প্রোটন। ডিইটেরিয়ামে আছে একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন। আর ট্রিটিয়ামের একটি প্রোটন দু’টি নিউট্রন। সূর্যের অভ্যন্তরে কোটি কোটি কোটি টন চাপে কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে চারটি প্রোটিয়াম (1H1) মিলে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস (2He4) গঠনের সময় ভর হ্রাস ঘটে, যা আইনস্টাইনের E=mc2 সূত্রে বিপুল শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
সূর্য বা নক্ষত্রের সুবিধা হল, তাদের কেন্দ্রে ওই সুবিশাল চাপ রয়েছে। কিন্তু পৃথিবীতে সেটা কীভাবে সম্ভব? বিজ্ঞানীরা এর সমাধানে তৈরি করলেন টোকামাক— এক বিশেষ ধরনের নিউক্লীয় রিঅ্যাক্টর। বিপুল চৌম্বক ক্ষেত্রের সাহায্যে ডিইটেরিয়াম ও ট্রিটিয়ামের প্লাজমার তাপমাত্রা সূর্যের কেন্দ্রের ১০ গুণ বাড়িয়ে নিউক্লীয় সংযোজন ঘটানো হয়। এই প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করতে
গোটা বিশ্ব ঝাঁপিয়ে পড়েছে। গঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইটার (ITER, International Thermo nuclear Experimental Reactor)। চিনের চেয়ে অনেক বড় এই ইটার-এর টোকামাক ফ্রান্সের মারসিলিতে তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ভারত-সহ ৩৫টি দেশ। মনে করা হচ্ছে, ২০২৫ থেকে টোকামাকের মাধ্যমে নিরন্তর গ্রিন এনার্জি উৎপাদনের কাজ শুরু হয়ে যাবে।
জীবাশ্ম জ্বালানি কয়লা, পেট্রোলিয়াম শেষের পথে। বিরাট ক্ষেত্রফলের জন্য সৌরশক্তির শক্তির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অপরদিকে ডিইটেরিয়াম আমাদের সমুদ্রে অফুরন্ত। ১ টন ডিউটেরিয়াম থেকে ৩ কোটি টন কয়লার শক্তি সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং আগামী দিনে জ্বালানি সঙ্কটের সমাধান করবে ডিউটেরিয়াম-ট্রিটিয়াম ভিত্তিক টোকামাক থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ শক্তি।
মজার ব্যাপার হল, এই বিকল্প পারমাণবিক জ্বালানি নিয়ে বিশ্বের যে ৩৫টি দেশ কাজ করে চলেছে, সেই তালিকায় চিনও রয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে চিন চমক দেখিয়ে বোঝাতে চেয়েছে, টোকামাক গবেষণায় তারা সবচেয়ে এগিয়ে। চিনের জ্বালানি সঙ্কট বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। অনেকে মনে করেন, সেই কারণেই তারা কৃত্রিম সূর্য তৈরিতে তেড়েফুঁড়ে নেমেছে। খরচ করেছে এক ট্রিলিয়ন ডলার। তা সত্ত্বে বিজ্ঞানের এই পথে চিনকে পাইওনিয়ার হিসেবে মানতে কেউই রাজি নয়। বরং পথপদর্শক আমাদের আসল সূর্য, সে-ই পথ দেখাচ্ছে।