এই বড় বড় বাড়ির মাথায়, এই গাঢ় নদীর উপরে, এই জটিল সেতুর শিয়রে— মেঘৈর্মেদুরমম্বরং! কিন্তু সমস্ত জল ঝরিয়ে অচিরেই যে নিঃশেষ হতে হবে এই মেঘকে। বাতাসমহিমায় ভুলে চলে এসেছে সে এ পথে। জল ঝরিয়েই তার মৃত্যু। কিন্তু সেই মৃত্যুর মধ্যেই তো জীবন! গ্রীষ্মের অকরুণ শাসনের হাত থেকে রেহাই। বহুদিনের ওপারে হারিয়ে-ফেলা-মুখের স্মৃতি-কাতরতা থেকে রেহাই। রোজকার প্রাণ-ঘষটানো কাজকর্ম থেকে রেহাই। বৃষ্টির এই জল কি শুধুই জল? বৃষ্টিভেজা এই মাতাল বাতাস কি বাতাসের চেয়ে বেশি নয়?

কতদিন আগে-পাওয়া মেঘ-ডাকবার বইটা এ সময়ে হাতে নিয়ে খুললেই এক-কোমর জল সেখানে। সেই জল পরের পাতায় নদী হয়ে কত দূর বয়ে গিয়েছে। গভীর সবুজ গাছে ভরে গিয়েছে ময়দান। হাওয়ায় কোন দূরের নদীর ছোঁয়া। জোলো পাখিদের ডানায় বৃষ্টিগান। ভেজা মাটি, ঘাস, শামুকের গন্ধ প্রতিনিয়ত আরও দূর বর্ষণের বার্তা এনে দিচ্ছে মনে। মাঠে গোড়ালি-জল। সেই জলে ছায়া ফেলে ডানা ভাসিয়ে উড়ে যাচ্ছে চিনেবাদামের মতো বিশুষ্ক বক। এক বর্ষার ভিতরেই পরত খুলে যাচ্ছে বহু বর্ষার। ভাঁজে ভাঁজে তার অচিন মেঘদূত আর চেনা কৃষ্ণচূড়া।

মেঘদূতের প্রসঙ্গেই মনে পড়া স্বাভাবিক আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের দ্বিধা-থরোথরো কৃষ্ণমেঘচূড়া! (আচ্ছা, যক্ষও কি সেদিন রামগিরিতে আসলে ‘কোয়ারান্টাইন’ই ছিলেন না? যাঁর সমস্ত অস্তিত্বই ছিল প্রিয়াবিরহ নামক এক ‘কন্টেনমেন্ট জ়োনে’ মেদুর? যেখান থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছিলেন না তিনি!) বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কালিদাসের মেঘদূত’ গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, ‘‘বিরহের সঙ্গে বিশেষভাবে বর্ষাঋতুকে সংশ্লিষ্ট করেন কালিদাসই প্রথম।’’ ঠিকই বলেছেন। আকাশশীর্ষে নিবিড়নীল মেঘের প্রথম ছায়াঘন মাধুর্যের মধ্যেই তো চিরবিরহের অশ্রুসংকেত। এই মেঘ আর বিরহের এমন অমোঘ জোটবন্ধন যে গীতগোবিন্দের প্রথম শ্লোকেই স্বয়ং জয়দেবও তমালশ্যামল বনভূমির সঙ্গেই অনায়াসে গেঁথে নেন মেঘমেদুর আকাশকে। বিরহ আর বর্ষার এই স্বপ্নবিবাহের যেন আর অন্য কোনও লগ্নে উত্তীর্ণ হওয়া চলে না। বুদ্ধদেব বসু তাঁর ওই রচনাতেই এই বিষয়টিও যেন একটু ছুঁয়ে গিয়েছেন। লিখছেন, ‘‘…যক্ষ পয়লা আষাঢ় তারিখে রামগিরিতে দাঁড়িয়ে এই শতাধিক শ্লোক আবৃত্তি করে গেলো হয়তো মেঘের উদ্দেশে, কিন্তু আসলে তার আপন মনে— তার একটি দীর্ঘ স্বগতোক্তি এটি, এ থেকে অন্য কিছুতে পৌঁছনো যাবে না, আর-কিছুই থাকতে পারে না এর পরে।’’

হ্যাঁ, সত্যিই, আর কিছুই তো থাকতে পারে না এর পরে! মেঘের পরে তো মেঘই! আর আঁধার-করে-আসা। সেই আঁধার-করে-আসা ট্রেনপথের পাশে উঁচু-উঁচু গাছের মাথায় বর্ষা ফিরি করতে আসা মেঘ আটকে রয়েছে। একটু পরেই ঝরবে জল। পথ-ঘাট কাদা হবে। জলও জমবে। স্কুল-কলেজ-অফিস-দোকান-বাজার এক তরল লকডাউনের শিকার হয়ে পড়বে। সকলেই তখন ‘সেল্ফ কোয়রান্টাইনে’। একান্ত সেই নির্জনবাস ভেঙে কোথাও বেরোলেই হাপুস ভিজতে হবে সকলকে। দমকা হাওয়ায় ভেঙে যাবে পলকা ছাতার শিক। আরও পুরনো ছাতা দিয়ে নিরুপায় জীবনের ভিতর চুঁইয়ে পড়বে বিষণ্ণ জল। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে বা ছাদে-উঠানে-বারান্দা-দাওয়ায় যেতে গেলেও ভিজতে হবে। তবু গণ্ডিবন্ধ জীবনে সেই অনিবার অবিশ্রান্ত ভিজে যাওয়ার মধ্যে দিয়েই যেন গন্ডিভাঙা এক মহা-বৃষ্টির দিকে হেঁটে যাওয়া শুধু।

সেই যে কবে এক মহা-বৃষ্টি পতন ঘটেছিল পৃথিবীতে, মনে পড়ে? চার বছর এগারো মাস দু’দিন ধরে ঝরে পড়েছিল। জন্ম দিয়েছিল এক মহাপ্লাবনের। মাকোন্দোকে তা পরিণত করেছিল এক ধ্বংসস্তূপে। ঘূর্ণি হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছিল ঘরের চালা। ভাঙছিল দেওয়াল। কলাবাগান হয়ে গিয়েছিল তছনছ। চারণভূমি জলের নীচে। জলমগ্ন রাস্তায় আসবাবপত্রের ভগ্নাবশেষ। লাল ফুলে ঢাকা পশুকঙ্কাল। ট্রেন তো বন্ধই। বন্ধ ডাকব্যবস্থাও। ভেজা কাপড়ে জন্মাচ্ছিল ছত্রাক। যন্ত্রে মরচে। সে যেন করোনাজাত লকডাউন আর বঙ্গোপসাগরজাত ঘূর্ণিঝড়ের যুগলবন্দিরই এক রূপ। টাইমলাইন ভেঙে তা হয়তো সেদিন কোনও ভাবে জাগরূক ছিল সেই জনপদেও।

নষ্ট আত্মা ভাঙা টালি

কিন্তু এই মহাপ্লাবনের মধ্যেই কেউ কেউ জীবনের রসদও খুঁজে ন‌েয়। বাস্তবতাকে পেরিয়ে পরাবাস্তবতার দিকে যেন চলে যায় তারা। সময়কে তাদের অখণ্ড নিরবচ্ছিন্ন বলে মনে হয়। এই বর্ষণ মাকোন্দোকে তো শুধু বিপর্যস্তই করেনি, তাকে পুনর্জন্মেরও সুযোগ করে দিয়েছে। বৃষ্টি তো সেখানে এক অলৌকিক নৈসর্গিক আয়না, যেখানে ভাঙাচোরা মানুষগুলি নিজেদের নষ্ট আত্মার ছায়া দেখে আর চমকে ওঠে।

চমকে-ওঠা ছাড়া উপায়ই-বা কী? নুন-তেল-হলুদ ফুরনো, ভিজে-ছেঁড়া পোশাক পরিহিত ক্রমাগত ক্লান্ত ব্যর্থ অবসন্ন কিন্তু জীবনের ছোট-ছোট দুঃখে-শোকে আনখশির প্রীত এই নগণ্য মানুষগুলি মহাপ্লাবনময় বর্ষার সঙ্গে কীসের জোরেই-বা লড়বে? তাদের কি কবিতা আছে? কল্পনা আছে? গান আছে? অবসর আছ‌ে?

না। তা নেই। তবু তারা লড়ে যায়। ফাটা টালির নীচে তালপাতার গোঁজা দিতে-দিতে, ফুটো ছাদের নীচে অ্যালুমিনিয়ামের তোবড়ানো হাঁড়ি বসাতে-বসাতে, জলঝাপটায় ভিজে-যাওয়া দালান মুছে হাতে-পায়ে হাজা ধরিয়ে ফেলতে-ফেলতে তারা বর্ষার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। ভাঙা সাইকেল, আকাট বেকারত্ব আর পাতলা খিচুড়ির মধ্যে দিয়ে নাগাড় ‘স্যানিটাইজ়ড’ হতে-হতে জীবনে-মননে দুঃসহ সাহসের ‘মাস্ক’ পরে তারা বৃষ্টির মৌতাতে মজে মহেশ্বর হয়।

ছলছল রাত্রিজল

অন্য দলও আছে। তারা বোঝে, এই বর্ষায় হরিণশরীরের ভিতর দিয়ে ছলছল করে উঠবে শাশ্বত জল— নদীর, রাত্রির; সেখানে সূর্য নেই। তারার ফাঁকে-ফাঁকে নিটোল অন্ধকার। আর সেই আঁধারকে ভিজিয়ে দেবে সকরুণ বৃষ্টিজল।

এমন বৃষ্টিকে পেয়েও অবশ্য হারিয়ে ফেলে কেউ কেউ। তারা কল্পনায় পেতে চায়, স্বপ্নে, হাতের মুঠোয়, নখদর্পণে, যন্ত্রণায়, শোকেও। বৃষ্টিকে পায়ও তারা। আবার ফুরিয়েও ফেলে। বৃষ্টিও অনেক সময়ে তাদের কাছে আসতে গিয়েও পথ ভোলে। পথ হারায়। গোটা জীবনে বৃষ্টিকে আর তাই পাওয়াই হয় না তাদের। কিন্তু ফসলবিলাসী বৃষ্টি যখন এসেই পড়ে তাদের কাছে, তখন হয়তো তারা জীবন আর ভাগ্যের ছন্নছাড়া মাঝপথে।

ঘোড়ার পিঠে ধাবমান ঝাঁসির রানিকে তাড়া করেছে ব্রিটিশবাহিনী। সে রাতের মতো রানি আশ্রয় নিলেন কাল্পির এক গুদামঘরে। পরদিন ভোরে নিজেকে ঋতুমতী আবিষ্কার করে রাগে-দুঃখে কান্নাবৃষ্টিতে সে যে কী অতল আকুল রানি! তাঁর শরীরবৃষ্টি যে তাঁকে সাময়িক ভাবে সংকল্পচ্যুত করে দিল!

বৃষ্টিকে আসলে বোঝা যায় না। বন্ধুর মেয়েকে জ্যোৎস্না ব্যাপারটা বোঝাতে গিয়ে বিঠোফেন তৈরি করেছিলেন ‘মুনলাইট সোনাটা’। এমনই কাউকে বৃষ্টি বোঝাতে গিয়েই কি তানসেন অবগাহন করেছিলেন মেঘমেদুর বিরহশ্যামল মল্লারে?