শহর কলকাতার এক আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে। তার সড়কের ধারে কোথাও মাটি ফুঁড়ে অচিরাৎ নতুন কোনও চোখ-ধাঁধানো অট্টালিকা গজিয়ে উঠলে সেখানে আগে কী ছিল, তা বেমালুম ভুলিয়ে দেয়। সেই ইমারত যদি হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মতো নয়নাভিরাম স্থাপত্যকর্ম, আর তার চারপাশ ঘিরে থাকে বিস্তীর্ণ সবুজের চোখ-জুড়োনো সমারোহ, তাহলে পর্যটকের বিস্মরণকে দোষ দেওয়া অন্যায়। এই কারণেই এই সঙ্গত প্রশ্নটি সচরাচর কারোকে ভাবায় না যে বিশ শতকের গোড়া অবধি সেখানে আদৌ কিছু ছিল কিনা!
বাংলা অভিধানের পৃষ্ঠা উল্টে যদি কেউ কৌতুহলবশত ‘হরিণবাড়ি’ শব্দটি খোঁজেন, অনায়াসেই পেয়ে যাবেন এবং অবাক হবেন। সেখানে এই শব্দটির অর্থ লেখা রয়েছে, ‘প্রাচীন কলকাতার এক অতি প্রসিদ্ধ জেলখানা’। যে বিস্তীর্ণ জমিতে আজ ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখানেই ছিল এই জেলখানাটির অস্তিত্ব। মেমোরিয়ালের নির্মাণকাজ ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে শুরু হবার কয়েক বছর পর স্বাভাবিক কারণেই পাততাড়ি গুটিয়ে স্থানান্তরিত হয় কয়েদখানাটি। কথা হল হল, ‘হরিণবাড়ি’ নামটির উৎস হিসেবে কোনও কোনও ইতিহাস-অনুরাগী দাবি করেন যে এখানে একটি বিরাট জঙ্গল ছিল। সেখানে নবাব সিরাজদ্দৌলা হরিণ শিকার করতে আসতেন। কিন্তু এই দাবি কতদূর তথ্যভিত্তিক, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ইংরেজদের উচ্চারণে এবং তৎকালীন সরকারি নথিপত্রে এ জায়গাটির নাম ছিল হ্যারিংব্যারি’(Harringbarry)।

আলিপুর জেল গড়ে ওঠার আগে কলকাতায় দুটি জেলখানা ছিল– লালবাজার ও হরিণবাড়ি। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে দু’টিকে জুড়ে দিয়ে একটি বড় জেলখানা গড়ে তোলা হয়, তার নাম ‘ময়দানের জেল’। সেটিই ছিল প্রেসিডেন্সি জেল। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাজ চলাকালীন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি জেল সেখান থেকে উঠে যায়। এই সময় পুরোনো আলিপুর জেল(১৮৬৪) প্রেসিডেন্সি জেলে রূপান্তরিত হয়। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই হরিণবাড়ি জেলের অস্তিত্ব ইতিহাসের কোটরে ঢুকে পড়তে বাধ্য হয়।
এই হরিণবাড়ি জেলের প্রশাসন সহ যাবতীয় দায়িত্বে ছিলেন কলকাতার শেরিফ। কলকাতার ইতিহাসে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের অগ্নিকাণ্ড একটি ভয়াবহ ঘটনা। শহরের পাঁচটি জায়গায় ব্যাপক এলাকা জুড়ে আগুন লাগে— শোভাবাজার, বৌবাজার, মেছুয়াবাজার, কুলিবাজার ও ধর্মতলা। বৌবাজারে ৭০০ খড়ের ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কুলিবাজার ও ধর্মতলায় ২০জন স্থানীয় মানুষ মারা যায়। এই ঘটনা মার্চ মাসের। পরের মাসেই আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এবারে ১৫০০০ খড়ের বাড়ি ভস্মীভূত হয়। মারা যায় ১৯০ জন। যে দুষ্কৃতীরা আগুন লাগিয়েছিল তাদের কয়েকজন ধরা পড়ে গেলে হরিণবাড়ি জেলে তাদের ঠাঁই হয়। এক বাঙালি দুষ্কৃতী আগুন লাগানোর সময়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলে গরুর গাড়ির পিছনে বেঁধে তাকে চাবুক মারতে মারতে শহরের পথে পথে ঘোরানো হযেছিল। চাবুক মারার এই শাস্তির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ কারওকেই রেয়াত করা হতো না। এই শাস্তি দেবার দায়িত্বভারও শেরিফের ওপরেই ন্যস্ত ছিল। হরিণবাড়ি জেলের কয়েদিদের একটি বড় সুবিধা ছিল এই যে সেখানে তাদের পরিবার-সহ থাকার বন্দোবস্তও ছিল।


১৮৬০-৭০ দশকের “ওয়াহাবি’ মতবাদী মুসলমান সম্প্রদায়ের ইতিহাসও জড়িয়ে রয়েছে হরিণবাড়ির সঙ্গে। এই আন্দোলনের ঢেউ দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঔপনিবেশিক সরকার বেশ কিছু ভারতীয় মুসলমানের বিরুদ্ধে উত্তর-পশ্চিম ভারতে জেহাদি আন্দোলন সমর্থন করার অভিযোগ এনে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। অভিযুক্তদের মধ্যে একজন ছিলেন কলকাতার এক খানদানি ব্যবসায়ী পরিবারের বয়স্ক সদস্য আমীর খান। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে গ্রেপ্তার করে হরিণবাড়ি কয়েদখানায় বন্দি করে রাখা হয় প্রকাশ্য বিচারের তোয়াক্কা না করেই। তাঁর বিচার ঘিরে দীর্ঘসূত্রিতা ও ব্রিটিশ সরকারের গা-জোয়ারি কাজকর্ম ব্যাপক বিতর্ক ও উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। আবার, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ বরুণ দে-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসিও হয়েছিল এই হরিণবাড়ি জেলখানাতেই।

কলকাতাকে নিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘শহর’ কবিতায় লিখেছিলেন: ‘আমার শহর নয়কো তেমন বুড়ো/ অতীতকালের অস্থি, মুদ্রা, চৈত্য-বিহার কিছু/ পাবে না তার কোথাও মাটি খুঁড়ে’।
সত্যিই আজ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরের মাটি খুঁড়লে কোথাও আর সেই হরিণবাড়ি কয়েদখানার চিলতে চিহ্নও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু তার ভূমিকাকে উপেক্ষা করলে কলকাতা শহরের প্রশাসনিক ইতিহাসও অনেকটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আজকের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের তোরণদ্বারে দাঁড়িয়ে কারও কি মালুম হয় সেখানকার দৃষ্টিনন্দন সবুজ গালিচার তলায় অনেক গভীরে চাপা পড়ে রয়েছে কত শত কয়েদির দীর্ঘশ্বাস?

তথ্যসূত্র
১. A Short History of Calcutta : A.K. Roy (Rddhi-India)
২. Glimpses of The Justice System of Presidency Town 1687-1973 : Mrinmoya & Mina Choudhuri (Regency Publications)
৩. Calcutta in Colonial Transition : Ranjit Sen (Routledge)
৪. স্মৃতি-রেখা : দেবপ্রসাদ সর্ব্বাধিকারী (গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ)
৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২

2 COMMENTS

  1. কাছেই রয়েছে হ্যারিঙটন স্ট্রিট । কে তিনি?

    • জন হারবার্ট হ্যারিংটন (১৭৬৫-১৮২৮)। ইস্ট ইণ্ডিয়া কম্পানিতে চাকরি করতেন। ১৮২৫ থেকে ১৮২৮ অবধি এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

Comments are closed.