পর্ব-১৫

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস- এর পাতায়।)

শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী।

পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি

আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ

সোনার উপমা সূত্রে বুনিছে বসন।

সঁপিয়া তোমার ’পরে নূতন মহিমা

অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।

কত বর্ণ কত গন্ধ ভূষণ কত-না,

সিন্ধু হতে মুক্তা আসে খনি হতে সোনা,

বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার,

চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার।

লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,

তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন।

পড়েছে তোমার পরে প্রদীপ্ত বাসনা-

অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।

         -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

          [মানসী (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)]

            কবির কথা ধার করে বলা যায়, যুগে যুগে পুরুষ নারীকে এই ভাবেই তৈরি করে নিতে চেয়েছে। তাকে দেখতে চেয়েছে সুকন্যা, সুমাতা ও সুগৃহিনী রূপে। অথচ পুরুষ কখনও বলেনি যে, জীবনে সুপুত্র, আদর্শ পিতা, ভালো পতি হওয়াতেই তার সার্থকতা। পুরুষ মুখে যতটা নারীদের সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলেছে, কাজে কিন্তু নারীকে ততটা কদর করেনি।

              সমাজতত্ত্ববিদরা বলেন, পুরুষতন্ত্র শুধু বলপ্রয়োগ করে নারী সমাজকে অধীনে রাখতে চায়নি, তার স্তুতি করে, স্তব করে তাকে বশে রেখেছে। নারীকে বন্দি করার জন্য তৈরি করেছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, অবতারণা করেছে ঈশ্বরের, লিখেছে ধর্মগ্রন্থ, রচনা করেছে দর্শন, কাব্য, মহাকাব্য; সৃষ্টি করেছে অসংখ্য শাস্ত্র।

          সৃষ্টির আদিতে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ এত প্রবল ছিল না। দৈহিক গঠনগত প্রভেদের কারণে যেটুকু বিভেদ ছিল। শারীরিক সক্ষমতাও প্রায় একই ছিল। নারীরা সন্তানসম্ভবা হলে সাময়িক দুর্বল হয়ে পড়তেন। বরং এর জন্য নারীদের সামাজিক স্থান উচুতে ছিল। কারণ সে বংশবিস্তার করছে। নতুন প্রজন্ম আনছে। আগে মনে করা হতো, নারীদের গর্ভে দৈব প্রক্রিয়ায় পূর্বপুরুষেরা পুনরায় শিশু হয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু মানুষ যখন মানব শিশু সৃষ্টির রহস্য জানতে পারল, তখন পুরুষ বুঝতে পারে সন্তান জন্ম দেওয়ার পিছনে তার ভূমিকা। তখন পুরুষ প্রজননে নারীর ভূমিকাকে অস্বীকার করে নিজের ভূমিকাকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে ঘোষণা করে। এই পিতৃত্বের রহস্য উদ্ঘাটনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় পুরুষতান্ত্রিকতা।

          পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় প্রথম শোষক শ্রেণী পুরুষ এবং শোষিত শ্রেণী নারী। মাও সেতুং বলেছিলেন, “বিপ্লবের আগে চীনের পুরুষদের বইতে হতো সাম্যবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের তিনটি পর্বত, আর চীনের নারীদের বইতে হতো চারটি পর্বত- চতুর্থটি পুরুষ।”

           কয়েক হাজার বছর ধরে পুরুষ তার এই সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। শারীরিক ক্ষমতার দিক থেকে পুরুষ নারীর থেকে খানিকটা এগিয়ে, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পিতৃত্বের অধিকার, সবশেষে পরিবারের শৃঙ্খল নারীকে পরাধীন করেছে। এই রচনার প্রথম পর্বে বলা হয়েছিল মানুষ যখন ক্রমশ কৃষিজীবী হল, মানুষের মধ্যে সম্পত্তির ধারণা এল, সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসাবে নিজের সন্তানকেই দেখতে চাইলো, তখন মানুষ পারস্পরিক যৌন সম্পর্ক ছিন্ন করে পরিবারতন্ত্রে আস্থা রাখল। তখন থেকে নারী তার স্বাধীনতা হারালো।

             আর তখন থেকেই পুরুষ নারীকে দাসী রূপে দেখে এসেছে। অর্থাৎ নারী ঘরে থেকে স্বামীর সেবা করবে, সন্তান সামলাবে, পরিবারের মুখে আহার্য প্রস্তুত করে তুলে দেবে। গৃহের বাইরেও পুরুষের এই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়নি। শারীরিক ক্ষমতার দরুণ বল প্রয়োগ করে অবদমিত রাখার চেষ্টা করেছে। এজন্য এখনও নারীকে পথে ঘাটে বেরোলে সম্মুখীন হতে হয় নানা লাঞ্ছনার। তাই আইন যতই কড়া হোক পুরুষ ঠিক খুঁজে নেয় তার ফাঁক-ফোকড়, আড়াল-আবডাল।

            ঘর সংসারের বাইরের কর্মজগৎকে সহজে মহিলাদের কাছে উন্মুক্ত করতে চায়নি পুরুষ। ‘মেয়েদের দিয়ে কি সব কাজ হয়?’ বলে প্রশ্ন তুলেছে নারীদের কর্মকুশলতার। শুধু কর্ম জগৎ নয়, জীবনের যে কোনও প্রাঙ্গন নারীকে খোলা ছেড়ে দেয়নি পুরুষ। নারীকে অনেক লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অপবাদ সহ্য করে, এক কথায় লড়ে জায়গা করে নিতে হয়েছে। এ কাজে পুরুষের সাহায্য সে একেবারেই পায়নি, তা নয়। সেটা নেহাতই ব্যতিক্রম।

ব্যতিক্রম কখনও নিয়ম হতে পারেনা।

           পুরুষ শুধু নারীদের নিন্দা করেছে তা নয়। নারীকে ‘মায়ের জাত’ বলে সম্মান জানিয়েছে, দেবী বলে পূজা করেছে, প্রণয়ী রূপে স্তুতি করেছে। এসবের উদাহরণ পুরাণে, শাস্ত্রে অজস্র আছে। ধর্মগ্রন্থে, শাস্ত্রে শুধু নারী প্রশংসা নয় নিন্দাও প্রচুর আছে। স্তুতি ও নিন্দা পাল্লায় রাখলে নিন্দার পাল্লাই ভারী হবে। অনেক সমাজবিদ বলেন, পুরুষের নিন্দায় সামান্য সত্য থাকলেও, তার স্তব হল সুপারিকল্পিত প্রতারণা।

          এই ভাবে পুরুষতন্ত্র নারীজগৎকে অবহেলা, উপেক্ষা এবং অবদমন করে রেখেছে; যা পক্ষান্তরে নারীপাচারের জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে।

1 COMMENT

  1. স্যার,
    খুবই সুন্দর ll
    ভালো লাগছে এত কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও কি সুন্দর লিখে চলেছেন l
    অসিত কুমার সাউ
    বেলুড়, হাওড়া

Comments are closed.