ঘূর্ণিঝড়, বন্যা কোথাও খরা। কোনও দেশে আবার শাসন ক্ষমতা দখল করেছে নতুন কোনও শক্তি। কোথাও জ্বলছে যুদ্ধের আগুন। এই সব মিলিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘরছাড়া ৫ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ।
এটা গতবছর, অর্থাৎ ২০২১ সালের হিসাব। এক বছরেই প্রায় ছয় কোটি মানুষের ঘর ছাড়ার (Homeless) ঘটনা দুনিয়ার সর্বকালের রেকর্ড। তবে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ যেহেতু থামার নাম নেই, তাই বাস্তুচ্যুত এই মানুষের সংখ্যাটা আরও অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গত দু’বছর ধরে কোভিড মহামারীর ধাক্কায় বিশ্বের ধনী দেশগুলি যখন নিজেদের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, তখনই দুনিয়ার বাস্তুচ্যুত মানুষের এমন পরিসংখ্যান সামনে নিয়ে এসেছে ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার (IDMC) এবং নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (NRC) এর যৌথ রিপোর্ট। সেখানে বলা হয়েছে, শুধু ২০২১ সালে পৃথিবী জুড়ে ৫ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আশঙ্কা করা হয়েছে, ২০২২ সালে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউক্রেনের বিরাট সংখ্যায় ঘরছাড়াদের সংখ্যা সমস্ত রেকর্ডকে ছাপিয়ে যাবে। ২৪ শে ফেব্রুয়ারিতেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে ৮০ লক্ষ মানুষ ইউক্রেনে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সেই সাথে প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে চলে গেছেন। তবে রিপোর্টে যুদ্ধের পাশাপাশি দায়ী করা হয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়কেও।
এবার দেখে নেওয়া যাক, এই দুনিয়ার আমজনতার হাল।
গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো এবং আফগানিস্তানে গত বছর অভূতপূর্ব ভাবে বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতায় ফেরার কারণে অনেককেই বাড়িঘর ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে হয়েছে। আমেরিকার সামরিক বিভাগের তথ্য অনুসারে, আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় আসার পর ১২৩০০০ জন দেশত্যাগ করেছেন। মায়ানমারে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেছে সামরিক বাহিনী জুন্টা। তারপর থেকে সেখানে রেকর্ড সংখ্যায় মানুষ ঘর ছেড়েছেন।
তবে আশার কথা, গতবছর মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে এক দশকের মধ্যে সবথেকে কম বাস্তুচ্যুতি দেখা গিয়েছে। এর কারণ, সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকের সংঘাত কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। সিরিয়ায় ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। সেই সময়ে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। শুধু ২০২১ সালে সিরিয়া ছেড়েছেন ৬৭ লক্ষ মানুষ। এছাড়া, কঙ্গো থেকে ৫৩ লক্ষ, কলম্বিয়া থেকে ৫২ লক্ষ এবং ইয়েমেন থেকে ৪৩ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন।
রাজনৈতিক ও সামরিক কারণে তৈরি অস্থিরতার পাশাপাশি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও ঘরছাড়া করেছে বিশ্বের বহু সংখ্যক মানুষকে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বিশ্বে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ঘরছাড়া হয়েছেন ২ কোটি ৩৭ লক্ষ মানুষ। আর এর পিছনে রয়েছে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও খরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার চরম পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চিন, ফিলিপিন্স ও ভারত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। এই দেশগুলিতে শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ৭০ শতাংশের বেশি বাস্তচ্যুতি ঘটেছে। ২০২১ সালে শুধুমাত্র ইথিওপিয়াতেই ৫০ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বিধংসী খরার কারণে। এছাড়া, মোজাম্বিক, মায়ানমার, সোমালিয়া ও সুদানে অর্থনৈতিক সঙ্কট তীব্র। সেখানে চলছে খাদ্যের সঙ্কট যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের (NRC ) সেক্রেটারি জেনারেল জ্যান এগল্যান্ড সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন, ‘‘পৃথিবীর অবস্থা খুব জটিল। এতটা খারাপ অবস্থা কখনও হয়নি। বিশ্ব ভেঙে পড়ছে। একদিকে রাজনীতি সেই সাথে প্রকৃতির সমস্যা— দুয়ে মিলে মানুষকে ঠেলে দিয়েছে অনিশ্চিয়তার মধ্যে, পালিয়ে বাঁচতে চাইছে মানুষ।” তাঁর মতে, এই ক্রমবর্ধমান যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে বিশ্ব নেতাদের চিন্তাভাবনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন দরকার।” আর IDMC পরিচালক আলেকজান্দ্রা বিলাক বলেছেন, ‘‘শান্তি স্থাপনে বিশ্বনেতৃত্বের অক্ষমতা দুঃখজনক ঘটনা।’’