বেদ ব্যাস রচিত হিন্দু মহাকাব্য ‘মহাভারত’-এর উপর ভিত্তি করে, রবি চোপড়া পরিচালিত টিভি সিরিয়াল ‘মহাভারত’ ভারতীয় টেলিভিশনের ইতিহাসে একটি অন্যতম বিখ্যাত অনুষ্ঠান। বি আর চোপড়ার প্রয়োজনায় এই সিরিয়ালের প্রথম পর্বটি দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হয়েছিল আজ থেকে ঠিক ৩৪ বছর আগে, ১৯৮৮ সালের ২রা অক্টোবরে। মহাভারতের সম্পূর্ণ গল্পটি ছিল ৯৪ পর্বের। ১৯৯০ সালের ২৪ জুন, শেষ পর্বটি যখন প্রচারিত হয়, মহাভারতের আন্তর্জাতিক রেটিং ৮.৯। এই ধারাবাহিক সে সময় সমস্ত  প্রজন্মের উপর  প্রভাব ফেলেছিল। প্রতি রবিবার সকাল নটা থেকে দশটা—‘মহাভারত’ চলাকালীন গোটা দেশে অঘোষিত বনধ পালিত হতো, রাস্তাঘাট জনশূন্য। ওই এক ঘণ্টা স্তব্ধ হয়ে যেত গোটা ভারত । ২০২০ সালে যখন ‘মহাভারত’ পুনঃপ্রচার করা হয়, সেই সময়েও প্রায় ৭.৬ কোটি দর্শক সিরিয়ালটি দেখেছেন। মহাভারত সমস্ত টিআরপি রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। আজকের ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দিনে, এই ধরণের ব্যাপক জনপ্রিয়তা কেবল কল্পনা করা যায়। শুধু ভারত নয় এটি ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশেও সুপারহিট হয়েছিল। ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর প্রতিবেদন অনুসারে, মহাভারত টিভি সিরিজ শনিবার বিকেলে বিবিসি-২-এ ৫০ লক্ষ দর্শককে আকর্ষণ করেছিল ।

এ বার জেনে নেওয়া যাক ‘মহাভারত’ সিরিয়ালটি তৈরির কিছু অজানা কথা। 

যে মুহূর্তে বলদেব রাজ চোপড়া  বা বি আর চোপড়া ঠিক করলেন, ‘মহাভারত’ মহাকাব্যকে তিনি ধারাবাহিক হিসাবে মানুষের কাছে নিয়ে আসবেন, সেই সময় তিনি আরও একটি  জিনিস ঠিক করেছিলেন। সেটা হল, কে এই মহাকাব্যকে গল্পের রূপ দেবেন বা সংলাপ লিখবেন। তিনি ধারাবাহিকটি পরিচালার দায়িত্ব দিলেন তাঁর ছেলে রবি চোপড়ার উপরে। তারপরেই বি আর চোপড়া ছুটলেন রাহি মাসুম রেজার কাছে। রাহি মাসুম রেজা ছিলেন হিন্দি ও উর্দু কবি, একজন লেখক  ও হিন্দি ছবির গীতিকার। রেজা সাহেবকে চোপড়া সাহেব বললেন, মহাভারত মহাকাব্যকে টিভি উপস্থাপনযোগ্য করতে হবে আপনাকে। সব ডায়লগ আপনিই লিখবেন। রেজা সাহেব তখন একসঙ্গে অনেকগুলি সিনেমার কাজ করছিলেন।  তিনি ফিরিয়ে দিলেন চোপড়া সাহেবকে। বি আর চোপড়া সেই সময় কিছু বললেন না। রেজা সাহেবের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়ে দিলেন, `মহাভারত’-এর স্ক্রিপ্ট লিখবেন রাহি মাসুম রেজা। ব্যাস! বিতর্ক শুরু হয়ে গেল, একজন মুসলিম কেন হিন্দু মহাকাব্যের স্ক্রিপ্ট লিখবে? সমস্ত হিন্দুরা কি মরে গেছে নাকি যে একজন মুসলিমকে দিয়ে মহাভারত লেখাতে হবে। চারিদিকে সমালোচনার ঝড়। চারদিক থেকে চিঠি আসতে শুরু করল বি আর চোপড়ার কাছে। না, মাসুম রেজাকে দিয়ে ‘মহাভারত’-এর স্ক্রিপ্ট লেখানো চলবে না। চোপড়া  সাহেব একটাই কাজ করলেন, ওই সব চিঠি পাঠিয়ে দিলেন রেজা সাহেবের কাছে। চিঠিগুলি পড়ে ভীষণ ক্ষেপে লেগেন রেজা সাহেব। কি? আমার বাড়ি গঙ্গার পাশে, আমি গঙ্গাপুত্র। ক’জন আছে যাঁরা আমার থেকে ভাল ভাবে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে জানে? আমি ভারতমাতার সন্তান। খবর দাও চোপড়াকে, আমি মহাভারতের স্ক্রিপ্ট লিখবো। ব্যাস! বি আর চোপড়ার অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে গেল সেখানেই। কেরামতি দেখিয়েছিলেন বটে রেজা সাহেব। ‘মহাভারত’-এর পর্বের শুরুতেই তিনি দিলেন প্রথম চমক। এর আগে ‘হামলোগ’ বা ‘বুনিয়াদ’ সিরিয়ালগুলিতে একটা ধারা তৈরি হয়েছিল। পর্বের শুরুতে একজন অ্যাঙ্কার  থাকতেন, যিনি গল্পটি ধরিয়ে দিতেন। অভিনেতা অশোককুমার সেই কাজটি করেছিলেন। বি আর চোপড়া চেয়েছিলেন, দিলীপ কুমার বা এনটি রাম রাওকে দিয়ে কাজটি করাতে। কিন্তু বাধা দিলেন রেজা সাহেব। না, ওখানে ‘সময়’ কথা বলবে। মহাভারত শুরু হতো  “ম্যায় সময় হু ‘ কথাটি দিয়ে। তারপর পুরো গল্প এগিয়ে নিয়ে যেত সময় নিজে। রেজা সাহেব পুরো ‘মহাভারত’ জুড়ে এমন কিছু ছোট ছোট কাজ করলেন,যা সিরিয়ালটিকে  অনবদ্য সৃষ্টিতে পরিণত  করেছিল। যেমন প্রতিটি সম্বোধনেই সাথে তিনি শ্রী জুড়ে দিলেন— পিতাশ্রী, মাতাশ্রী ,তাতশ্রী। এই সম্বোধনগুলি ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। মাসুম রেজা পরে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি ‘মহাভারত’-এর স্ক্রিপ্ট লেখার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন— কারণ, জানতেন যে এর মাধ্যমে ভারতের অতীতকে বর্তমানের সাথে যুক্ত করাবেন।

বি আর চোপড়ার মহাভারত প্রযোজনা দলের সদস্য কিশোর মালহোত্রা পরে জানান, ধারাবাহিকটি  তৈরি করতে সেই সময় প্রায় ৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। সতীশ ভাটনগর ও তাঁর টিমকে রাখা হয়েছিল দেশে যত রকমের মহাভারত রয়েছে— সে সব অধ্যয়ন করে তা সম্মিলিত করার জন্য। মহাভারতে অভিনয় করার জন্য ১৫০০০ আবেদনপত্র এসেছিল। এর মধ্য থেকে বিভিন্ন চরিত্রের অভিনেতাদের বেছে  নেওয়ার কাজটি করেছিলেন কাস্টিং ডিরেক্টর গুফি পেন্টাল। কিন্তু একটি চরিত্রে কিছুতেই মনমতো  লোক পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে গুফি পেন্টাল নিজেই ওই চরিত্রে অভিনয় করলেন। অবশেষে পাওয়া গেল শকুনিকে। বি আর চোপড়ার মহাভারত-এ সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্রের একটি কৃষ্ণ হলে অন্যটি শকুনি। রাজ বব্বর কিংবা দেবশ্রী রায়দের বাদ দিলে মহাভারতের প্রায় সব চরিত্রেই অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছিলেন একেবারে নবাগত। কিন্তু এই সিরিয়ালের মাধ্যমে তাঁরা বিখ্যাত হয়ে যান। ফিরোজ খান ছিলেন অর্জুনের চরিত্রে। পরে তিনি নিজের নাম পাল্টে অর্জুন করে নেন। কৃষ্ণের চরিত্রের জন্য বহু অভিনেতার অডিশন নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নীতীশ ভরদ্বাজ নির্বাচিত হন শুধু তাঁর হাসির কারণে। ‘মহাভারত’-এ অভিনয় করেছিলেন এশিয়ান গেমসে সোনাজয়ী একজন তারকা। তিনি প্রবীণ কুমার, ভীমের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।      

মহাভারত-এর শুটিংয়ের রবি চোপড়াকে প্রায়ই বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। যেখানেই শুটিং থাকতো, জনতা এসে জায়গাটা  ঘিরে ধরতো।একটাই দাবি, কৃষ্ণকে তাঁরা একবার দেখবে আর প্রণাম করবে! তাই নীতীশ ভরদ্বাজকে প্রায় প্রতিদিন শুটিং-এ আসতে হতো তারপর কৃষ্ণ সেজে জনতার সামনে দাঁড়াতে হতো।   

দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ সিকোয়েন্সের জন্য ২৫০ মিটার লম্বা শাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল। রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের পরা শাড়িটিও ছিল ৬ মিটার লম্বা।

একেবারে শেষে মহাভারত নিয়ে আরও একটি তথ্য। সিরিয়ালটির সব চরিত্রের জন্য পারিশ্রমিক ছিল এক। প্রতি এপিসোডে তিন হাজার টাকা। সেই সময়ের তিন হাজার আজকের দিনে খুব কম নয়।