একের পর এক দক্ষিণের সিনেমা ব্যাপক হিট হচ্ছে। কিছুদিন আগে বাহুবলি ,তারপর এলো পুষ্পার জ্বর। আর এখন আরআরআর (RRR)। ১৫ দিনে বিশ্বব্যাপী ১০০০ কোটি টাকার বেশি ব্যবসা করে ফেলেছে আরআরআর। দক্ষিণের সিনেমা কিন্তু এখন আর শুধু দক্ষিণ ভারতেই নয়। হাত বাড়াচ্ছে গোটা পৃথিবীর দিকে। জাকিয়ে বসেছে তার ব্যবসা। এই বছর নাকি আরও ৭টি মেগা বাজেটের সিনেমা নিয়ে আসছে দক্ষিণের প্রোডাকশন হাউসগুলি।

কিছুদিন আগে করোনার জেরে বিরাট ধাক্কা লেগেছে সিনেমার জগতে। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হল, শুধু আবেগ দিয়েই এই বির্পযয়ের মোকাবিলা করে চলেছে দক্ষিণ ভারতের সিনেমা।

দক্ষিণের সিনেমা জগৎ বলতে আমরা মূলত পাঁচটি রাজ্যের সিনেমার কথা  বুঝি। অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, তামিলনাড়ু, কেরল ও কর্নাটক। তবে অন্ধ্র ভাগ হয়ে তেলঙ্গানা হওয়ার পরেও তেলুগু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি একই রয়েছে। দক্ষিণের এই পাঁচটি রাজ্যের সিনেমার মধ্যে বৈশিষ্ট কিন্তু একইরকম। সিনেমা ও দর্শকদের এই বিশেষত্বই করোনা ঝড়ের ভিতরেও দক্ষিণী সিনেমার জগৎকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

কেমন বৈশিষ্ট যা অন্যদের থেকে একেবারে আলাদা? একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বলা যেতে পারে। ধরুন, কিছু দিন আগে বাংলা সিনেমার কয়েক দশকের অন্যতম সেরা অভিনেতা সৌমিত্র চট্রোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন। বাংলা কেন দেশবিদেশের সিনেমা জগতে শোকের ছায়া। কিন্তু এই বিষন্নতার মধ্যেও আত্মহত্যা করার কথা মাথায় এসেছে কি বাংলা সিনেমার কোনও দর্শকের? না আসেনি। আর এমন কথা ভাবাটা একেবারে ঠিক নয়। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে দেখুন, এমজিআর, এনটি রামা রাও থেকে রাজকুমার কিংবা জয়ললিতা— এই সব তারকার মৃত্যুকে ঘিরে কত মানুষ হতাশা ও বিষন্নতার শিকার হয়েছেন। আর হামেশাই পাওয়া যাচ্ছে আত্মহত্যা করার খবর।

পুষ্পা ছবিতে আল্লু অর্জুন

তারকাদের নিয়ে এই পাগলামি দক্ষিণী সিনেমার দর্শকদের রক্তে মিশে গিয়েছে যেন। তারকাদের এখানে বিরাট জনপ্রিয়তা। অনুগামীদের সঙ্গে এক অসাধারণ বন্ধনে আবদ্ধ তাঁরা। জনপ্রিয় তারকাদের কার্যত পুজো করেন দর্শকেরা। এখানকার মানুষ শুধু সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন না— তারকাদের সঙ্গে শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালবাসা অনুভব করে। তারকারা দর্শকদের আত্মার সাথে একাত্ম, দর্শক তাঁদেরকে পরিবারের একজন মনে করে। তাই আজও ছবি মুক্তির আগে প্রেক্ষাগৃহের বাইরে  প্রিয় অভিনেতার বিশাল কাটআউট, অনলাইন  টিকেটিং -এর যুগেও মাঝরাত থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে ‘ফার্স্ট ডে ফার্স্ট  শো’ দেখার পাগলামি বোধহয় দক্ষিণেই সম্ভব। রজনীকান্ত, মোহনলাল কিংবা নাগার্জুনার মতো অভিনেতাদের একটা করে নামও দিয়ে রেখেছেন দর্শকেরা। অন্নাভারু রাজকুমার, থালাইভা রজনীকান্ত, যুবসম্রাট নাগ বা কমপ্লিট অ্যাক্টর মোহনলাল—এ ভাবেই পরিচিত।

আসলে দক্ষিণী ছবি অনেকদিন আগে থেকেই নিজের স্টাইল তৈরি করে নিয়েছে। যাকে ভালবাসেন এখানকার দর্শকেরা। সিনেমায় গল্পের বাঁধুনি, অভিনয়, প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে প্রচার— সবমিলিয়ে ঘরানা যাকে বলে। এই পরিস্থিতি দক্ষিণের নিজস্ব। তাই দক্ষিণ ভারতের দর্শক বলিউডের তারকাদের নিয়ে পাগল হয়ে ওঠেন না। বরং নিজেদের হিরো-হিরোইনদের নিয়েই সন্তুষ্টি তাঁদের। পরিবারের সকলে মিলে সিনেমা দেখার রেওয়াজও রয়েছে এখানে। ছবিগুলি অধিকাংশই পরিবার কেন্দ্রিক। আর সপ্তাহে দু’টো-তিনটে সিনেমা দেখা এখানে যেন সাধারণ ব্যাপার।

তবে করোনা ও তার জেরে লকডাউন পুরো পরিস্থিতিকে অনেকটাই বদলে দিয়েছিল। সেই সময়ে দক্ষিণের প্রেক্ষাগৃহগুলি পুরনো ছবি  সম্প্রচার করতে চায়নি। তারা অপেক্ষা করেছে নতুন ছবির মুক্তিরজন্য। লকডাউন শেষ হওয়ার পর থেকে নিয়মিত ভাবে সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালায়ালাম— এই চারটে ভাষাতেই। আর এই কারণে  সিনেমার ব্যবসা এখানে অনেক সহজে  পুনুরুজ্জীবিত হতে পেরেছে। দর্শক নিয়েও চিন্তা করতে হচ্ছে না। করোনা পরবর্তী সময়ে পুষ্পার মতো সিনেমার বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক সাফল্য সেকথাই বুঝিয়ে দিচ্ছে। আর ওটিটি প্ল্যাটফর্মে (OTT Platfrom)র দৌলতে ভাষার সমস্যাও অনেকটা মিটে গিয়েছে। নেটফ্লিক্স বা প্রাইম  ভিডিওতে সব ছবিই  সাবটাইটেল-সহ দেখা যায়। আজকাল ভারতের  বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ইংরাজি ছাড়াও যেমন  অন্য বিদেশী ভাষার ছবি দেখতে অভ্যস্ত, তেমনই  দক্ষিণী ছবিও দেখতে শুরু করেছেন তাঁরা। সব থেকে ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার হল, বহু  হিন্দি সিনেমা এখন দক্ষিণী  ছবির উপর তৈরি হয়েছে। এমনকি, অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার ক্ষেত্রেও তালিকাটা কম দীর্ঘ নয়। ফলে প্রশ্ন উঠছে, দক্ষিণী ফিল্ম ইন্ডাস্টির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বলিউড কি তার জায়গা হারাতে চলেছে? করোনার আগে বাহুবলী বা কিংবা পরে পুষ্পার মতো সিনেমার বাণিজ্যিক সাফল্য চিন্তার বাড়াচ্ছে বলিউডে।

দক্ষিণী সিনেমার এই নিজস্বতাই লড়েছে করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে। মাল্টিপ্লেক্সের দাপটে গোটা দেশে অনেক একক প্রেক্ষাগৃহ এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতেও এই ধাক্কা এসেছে ঠিকই। কিছু একক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হলেও মাল্টিপ্লেক্সের সঙ্গে লড়াই করে আজও অনেকগুলিই টিঁকে রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারগুলির ভূমিকাও অনস্বীকার্য। মাল্টিপ্লেক্সের টিকিটের দাম নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। আর  সরকারি  আইন মেনে  এখানে  প্রাইম  শোতে  শুধু  আঞ্চলিক  ছবি  দেখানো  হয়।   আরও  একটা  গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, দক্ষিণ ভারতের মানুষ  সিনেমা  দেখতে  পছন্দ  করেন।  সিনেমা  দেখাটাই  বড়  কথা, মাল্টিপ্লেক্স  কিংবা  ছোট  প্রেক্ষাগৃহ— কোথায়  গিয়ে দেখবেন—  তা নিয়ে তাঁদের মাথাব্যাথা নেই। আর বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বিরোধও এতে প্রভাব ফেলে না। যেমন, কাবেরী জলবন্টন নিয়ে কর্নাটক ও তামিলনাড়ুর  মধ্যে  যখন বিবাদ তুঙ্গে, তখন কর্নাটকে তামিল ছবি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দর্শকেরা তখন হোসুরে গিয়ে (কর্নাটক সীমানায় তামিল জেলা) সিনেমা দেখে এসেছিলেন।