হৃদয় মহাশয় ঠিক কোথায় থাকেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রায় সকলেই ডান হাত ভাঁজ করে বুকের বাঁদিকটা স্পর্শ করেন। ডাক্তারবাবুরাও বলবেন নির্ভুল উত্তর। কিন্তু গভীরতর উপলব্ধির মানুষেরা (হয়তো মুচকি হেসে) হেডঅফিসের দিকেই আঙুল দেখাবেন। 

‘‘গানা গলেসে বনতি হ্যায় থোড়ি!’’ বলেছিলেন অবিস্মরণীয়া বেগম আখতার। পাঁচ-সাত গজ দূরত্বে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে শুনতে হয়েছিল মন্তব্যটি। জীবনের নানা সময়ে একাধিক গুণীদের কাছে থেকে এই অতুলনীয়া শিল্পীর গান-সহ তাঁর কণ্ঠসম্পদ নিয়েও আশ্চর্য সুন্দর সব মতামত শুনেছি। জেনেছি, কেউ কখনও ওঁর কণ্ঠের ঐশ্বর্য সম্পর্কে ইঙ্গিত করলেই উনি কথাটা বলতেন। হেসে মনে করিয়ে দিতেন, সঙ্গীত বস্তুতপক্ষে নিজস্ব আন্দাজ, বুদ্ধি, শিক্ষা ও হৃদয়বোধের ফসল। কথাটা শতকরা হাজার ভাগ সত্যি। কিন্তু যে শিল্প কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়ে শ্রোতৃমন্ডলীর কাছে নিবেদিত হচ্ছে, সেই কণ্ঠধ্বনির মূল্য কী করে অস্বীকার করা যায়! শুধুই কথার কথা তো নয়, সুতরাং যথার্থ রসিকদের কাছেও শুনতে হয় বৈকি।

লখনউ থেকে ফেরার পথে বেনারসে প্রবীণ শিল্পী পন্ডিত ছুন্নুলাল মিশ্র মধুর হেসে বেগম আখতার সাহেবার কণ্ঠ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘খনকদার।’’ সুর মিলিয়ে পথ চলতে হয় একই সঙ্গে। যন্ত্রসঙ্গীতের সঙ্গে কণ্ঠের সমন্বয় সম্পর্কে পন্ডিত ব্যক্তি হিসেবেই লখনউ বেতার কেন্দ্রের পন্ডিত কে কে শ্রীবাস্তব বলেছিলেন, ‘‘লিটল হাসকি, বাট ডিলাইটফুল টু হিয়ার।’’ তবে বেগম আখতারের কণ্ঠ নিয়ে সবচেয়ে কাব্যময় উক্তি ছিল কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। সহজ আনন্দের হাসি ছড়িয়ে কুমারদা বলেছিলেন, ‘‘ওঁর কণ্ঠে উর্দু ভাষাটাই যেন শিকারায় চড়ে হাজির হয়’’। 

নিঃশব্দ চরণে শুধু প্রেমী নয়, কখনও কখনও কন্ঠস্বরের প্রেমিকরাও আসেন। তো কেউ চুপি চুপি এলে কী করে তা শুনতে পাওয়া যাবে— যদি কেউ নিজের মন, নিজের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে প্রেমে মগ্ন থাকে। এবং ষ্টুডিও চত্বরে কাছে-দূরে, এদিক-ওদিক কিছুক্ষণ বসার জন্য অনেক চেয়ারও ছড়ানো থাকে। নিজের মনে গান গাইতে গাইতে যুবকটি তেমনই একটা চেয়ারে বসে পড়লে তাঁর গলায় গানটির চলনও সুন্দরতর চেহারা নিচ্ছিল। গানটি শেষ হলে, পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় প্রবীণ শ্রোতা আলাপ করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যুবকটি বাংলা গান গাইতে আগ্রহী কি না। কারণ, তিনি যুবকটির কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ।

তা কৌতূহল, আগ্রহ, ভালবাসা এবং গান গাওয়া— সবই ওই হেডঅফিসের নির্দেশেই হয়। এটা কোনও বহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের ছোটগল্প নয়। সুতরাং বলতেই হবে গুনগুন করে আপনমনে গজল গাওয়া যুবকটি কে ও ঘটনাটি ঠিক কী। গান গাইছিলেন সদ্য লখনউ থেকে আসা এক সুদর্শন, দীর্ঘকায় যুবক অভিনেতা, বাংলা ছবিতে অভিনয় করার অভিলাষে যাঁর কলকাতায় আসা। তাঁর নতুন নাম হয়েছে তপন কুমার। আসল নাম তালাত মামুদ। আর যিনি সেই যুবকের কম্পমান মধুর কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ, তিনি সুরকার, সঙ্গীতপরিচালক কমল দাশগুপ্ত। তপনকুমার মহাশয় যে ছবিতে অভিনয় করার জন্য সেই ১৯৪৫-এ কলকাতায় এসেছিলেন, তার নাম ‘পথ বেঁধে দিল’। ছবির পরিচালক ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। ছবির তারকারা ছিলেন কানন দেবী, ছবি বিশ্বাস, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, তুলসী লাহিড়ী প্রমুখ। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তারপর যা অনিবার্য, তা-ই ঘটেছিল।  ১৯৪৬ সালেই তালাত মামুদের বাংলা গানের প্রথম রেকর্ড বের হয়েছিল (ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে। কথা-প্রণব রায়, দু’টি পাখি দুটি দুটি তীরে। কথা-গিরীন চক্রবর্তী।) দু’টি গানেরই সুরকার ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। বাংলা গানের শ্রোতৃমন্ডলীর মধ্যে যাঁরা পুরনো দিনের গান শুনতে চান, তাঁরা প্রায় বাধ্যতামূলক ভাবে যে গানটি শুনতে চাইবেন, সেটি তালাত মামুদের গাওয়া ‘চাঁদের এত আলো’(কথা, কমল ঘোষ, সুর-রবীন চট্টোপাধ্যায়)।

সতীনাথ মুখোপাধ্যায় বলতেন, ‘‘কারও গলা কারও মতো হয় না। কিন্তু দু-একটা পর্দার মিল ঘটতে পারে। মিলতে পারে কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্বর প্রক্ষেপনের ভঙ্গিও।’’ কিন্তু সেই আওয়াজের প্রতি গভীর অনুরাগ বা ভালবাসা জন্মাতে কোনও বাধা নেই। সুরসাগর হিমাংশুকুমার দত্ত দশ-এগারো বছরের শৈলকে চিনেছিলেন একদিন গান শুনেই। পিতৃহীন ওই বালিকাই পরে কিন্নরকণ্ঠী শৈলদেবী হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গীত শিক্ষার যাবতীয় আয়োজন, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সুরসাগর নিজেই। তাঁকে কলকাতায় নিয়ে এসে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সঙ্গীত শিক্ষার যাবতীয় বন্দোবস্ত করেছিলেন হিমাংশুবাবু। যা সহজ সৌন্দর্য্যে আকর্ষনীয় হয়— তা, আবার বলতে হচ্ছে, ওই হেডঅফিসের কাছাকাছি থাকা কণ্ঠসম্পদ। জীবনের নিজস্ব ঐশ্বর্যের এক অনন্য সম্পদ হিসেবে শৈলদেবী শ্রোতাদের বিস্মিত করে দিতেন। উদাহরণ অনেক ক্ষেত্রেই চিত্তহরণ করে। কুমারী শৈল-র অসামান্য কণ্ঠলাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্র দে তাকে কীর্তন শেখাতেন। জীবনরঙের পুনরুক্তি বোধহয় তেমন দোষের নয়। কারণ, সেখানে নানা চরিত্রের অবিশ্বাস্য নাটকীয়তা থাকে। হয়তো তা চিরকালই থাকবে। বেগম আখতারের কথা দিয়েই শেষ করা যাক। তখন তিনি বেগম আখতার তো দূরের কথা, জনপ্রিয় আখতারি বাঈ ফৈজাবাদীও হননি। কিন্তু প্রবল ভালবাসার টানে সঙ্গীত হাজির হয়েছে জীবনে। জীবনের প্রথম গান যা রেকর্ড হয়েছিল, তা তিনি নির্বাচন করেননি, করেছিলেন একজন ভবঘুরে ফকির। একদিন নিত্যকর্তব্য হিসেবে রেওয়াজের পরে কিছু গান গাইছিলেন, যা তিনি প্রতিদিনই করেন। গজলই গাইছিলেন। খেয়ালই করেননি একজন ফকিরসাহেব তাঁর কণ্ঠস্বর ও গায়নভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে কাছে এসে শুনছেন। হারমোনিয়ামের উপরে রাখা ছিল গজলের খাতা। ফকিরসাহেব যেন কাজটা তাঁকেই করতে হবে— এমন ভঙ্গিতে খাতাটা খুলে ‘দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো দিওয়ানা বানা দে’ গানটা বেছে নিয়ে বললেন, ‘এই গানটা করো।’ আখতারি গানটা সবে পেয়েছেন, সুর করাও হয়নি। ফকির সাহেব হুকুম দিলেন, ‘‘এক্ষুনি সুর করো। এটাই হবে তোমার প্রথম জনপ্রিয় গান।’’ কী আর করা যাবে! ফকির সাহেবের হুকুম অনুযায়ী ভবিষ্যতের বেগম আখতার সুর করতে বসে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে কাজটা হয়েও গেল। ফকিরসাহেব শুনে আশীর্বাদ করে আবার রাস্তায় হারিয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁর কথাটা সত্যি হয়েছিল। রেকর্ড হওয়ার পরে এবং আয়োজিত জলসায় বেগমের ‘দিওয়ানা বানানা হ্যায়’ শুনে শ্রোতারা সত্যিই দিওয়ানা হয়ে যেতেন। জীবনরঙেই দিওয়ানা!