কলিম শরাফী মুসলমান, এটা মৃণাল সেন জানতে পারলেন ১৯৪৭-এর পর, মানে দেশ যখন ভাগ হল এবং স্বাধীন হল, তার পর৷ খুবই নিকটজন ছিলেন তাঁরা পরস্পরের, চিন্তা ও কাজের সূত্রে৷ মৃণাল সেন জানতেন কলিম শরাফী গায়ক, রবীন্দ্রসংগীতের অনন্য শিল্পী, মুক্ত মনের মানুষ, দেবব্রত বিশ্বাস-সলিল চৌধুরী-শম্ভু মিত্রের আপনজন৷ তখন এভাবেই পরস্পরকে জানার সংস্কৃতি ছিল৷ ধর্ম-পরিচয় পরিচায়ক-চিহ্ন হয়ে উঠতে পারেনি৷ সেটাই ঘটল দেশ টুকরো তথা স্বাধীন হবার পর৷ বীরভূমের মানুষ কলিম শরাফীকে চলে যেতে হল পাকিস্তানে– ঢাকায়৷ মুসলমান বলে ইন্ডিয়ায় কাজ পাচ্ছিলেন না৷ দু-বেলা দু-মুঠো খবার জোটানোর মতো উপার্জন করা সম্ভব হচ্ছিল না৷ 

   ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের মার তখন ‘মানুষ” পরিচয়টা অর্থহীন করে দিতে শুরু করেছে, আমরা ভেতরে ভেতরে টুকরো হয়ে যাচ্ছি, কলিম শরাফী ‘মুসলমান’ আর দেবব্রত বিশ্বাস ‘হিন্দু’৷ ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তানে কেমন ছিলেন তিনি? ধর্ম-পরিচয় কি দিতে পেরেছিল জীবনধারণে স্বাচ্ছন্দ্য আর কর্মজীবনে মর্যাদা? না, পারেনি৷ তিনি বারবার লাঞ্ছিত হয়েছেন, উপেক্ষিত হয়েছে তাঁর শিল্পীসত্তা, নিষিদ্ধ হয়েছে তাঁর গান গাওয়া৷ আসলে তিনি ছিলেন মানবধর্মের মানুষ, অন্ধ ধর্মাচারের মরুব্বিরা তাঁকে বরদাস্ত করে কীভাবে?  

   কলিম শরাফীর জীবনের একটি পর্ব বাংলার ইতিহাসের মৃত্যুসমাকীর্ণ রক্তপ্লাবিত চল্লিশের দশক৷ গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে বিয়াল্লিশের আন্দোলনে অংশ নেন তিনি৷ “একদিন ভোর রাতে পুলিশ এসে আমাদের গ্রামের বাড়ি ঘেরাও করল৷ উদ্দেশ্য আমাকে গ্রেপ্তার করা৷ খবর ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত গ্রামে৷ মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেল গ্রামে বিরাট জনতা এ্কত্রিত হয়ে নানা রকমের শ্লোগান দিয়ে আমাকে সংবর্ধনা জানাচ্ছে৷ স্বভাবতই এই ঘটনা আমাকে উৎসাহিত করল এবং নিশ্চিত হলাম যে, জনগণ এই আন্দোলনের সমর্থক এবং তাঁরা আমাকে ভালোবাসেন৷ আমি গৌরববোধ করতে লাগলাম যে, দেশপ্রেমের কারণেই আমাকে পুলিশের হাতে বন্দি হতে হচ্ছে৷” তখন সবে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন৷ 

  সিউড়ি জেলে বহু বিশিষ্টজনের কাছাকাছি এসেছেন৷ বিশেষ করে শান্তিনিকেতন থেকে গ্রেপ্তার হওয়া রাজনৈতিক বন্দি রানী চন্দ, নন্দিতা কৃপালনী, সুহাস দে, দীনকর কৌশিক, প্রণব গুহঠাকুরতা প্রমুখের৷ প্রণব ছিলেন তাঁর সমবয়সী৷ তাঁর গায়ক হয়ে ওঠার মূলে বড়ো অবদান প্রণব গুহঠাকুরতার৷ ‘জেলে সে সবসময়ই রবীন্দ্রসংগীত গাইত এবং আমাকে গাওয়ার জন্য প্রবল ভাবে উৎসাহিত করত৷” প্রণবের মাধ্যমেই “দক্ষিণী’-তে আসা এবং গান শেখা৷

   জেল থেকে বেরিয়ে দেখলেন ক্ষুধা জর্জর মানুষের মৃত্যুমিছিল৷ পঞ্চাশের মন্বন্তর৷ আগস্ট আন্দোলনের পরের বছর, ইংরেজি ১৯৪৩৷ খাঁটি মানুষ সত্যি বলেন অকপটে, লাভ-ক্ষতির হিসেব কষেন না৷ এই মন্বন্তর সম্পর্কে বলেছেন, ‘অনেক পণ্ডিতের মন্তব্য শুনে বিশ্বাস করতে পারিনি যে, শুধু যুদ্ধের কারণে বার্মা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এই দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি৷ সারা ভারতবর্ষে পঞ্চাশ লক্ষ লোককে বাঁচানোর মতো খাদ্যশস্য কি ছিল না? ছিল, তবে তা এমন এক লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছিল যে অন্তত পঞ্চাশ লক্ষ লোক না মারলে মহাজন ও চোরা ব্যবসায়ীরা অর্থের পাহাড় গড়তে পারত না৷ এই ব্যবসায়ে প্রতিষ্ঠিত কিছু ধনকুবেরকে আজও এই বাংলাদেশের মাটিতে দেখতে পাওয়া যায়৷ [কথাগুলো বলছেন ১৯৯৩ সালে, পঞ্চাশের মন্বন্তরের পঞ্চাশ পূর্তির বছরে] অবিভক্ত বাংলায় তখন মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা বিরাজ করছিল৷ এই ধনকুবেররা তাদেরই স্নেহস্পর্শে লালিত-পালিত৷ দুর্ভিক্ষে মানুষ-ব্যবসায়ে এঁরাও অংশীদার ছিলেন৷ পরে অবশ্য বহুবার হজ করে, দান-খয়রাত করে, হাসপাতাল-এতিমখানা-স্কুল বানিয়ে তারা মানুষ হত্যার শুদ্ধি করেছেন৷ 

   কলিম শরাফীর রাজনৈতিক শিক্ষা মার্কসবাদী ৰউফ ভাইয়ের কাছে৷ “তিনি ইসলামিয়া কলেজে পড়তেন৷ তাঁর কাছ থেকেই আমরা প্রথম জানতে পেরেছি মার্কসইজম কাকে বলে, সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র কী, কী ভাবে দেশের মেহনতি জনসাধারণকে সজাগ করে তুলতে পারলে এদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে ইত্যাদি৷” এই রাজনৈতিক শিক্ষা তাঁদের সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প থেকে দূরে রেখেছিল৷ তিনি বলছেন, ‘রাজনৈতিক এই চেতনাই আমাদের বুঝতে শিখিয়েছে যে, সাম্প্রদায়িকতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য দায়ী কে? এবং যারা এই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব যাঁরা রাখছেন তাঁরা প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেমিক তো ননই, তাঁদের অন্যভাষায় বলা যেতে পারে যে, সাম্রাজ্যবাদের দালালিই করছেন তাঁরা৷” খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এই উচ্চারণ সেই সময়ের নিরিখে৷ 

    ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের আওয়াজ যখন “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ গোছের উগ্র শ্লোগানে ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬ কলকাতায় দাঙ্গা হয়ে আছড়ে পড়ছে, সেদিন কলিম শরাফী ময়দানে মুসলিম লিগের ডাকা সভায় যেতে চেয়েছিলেন৷ নিজের কানে শুনতে চেয়েছিলেন ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ নিয়ে নেতাদের বক্তব্য৷ এইরকম নামকরণকে তিনি বলেছেন “সুপরিকল্পিত”৷ অনেকদিন ধরেই তার প্রচার চলছিল কলকাতার “আজাদ’, ‘মর্নিং নিউজ’ ও কয়েকটি দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী পত্রপত্রিকায়৷ শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি৷ রামরাজাতলা থেকে রওনা হবার আগে পেতে থাকেন চারদিকে দাঙ্গার খবর৷ তিনি বলেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার স্বার্থপ্রসূ সা্ম্রাজ্য ভারতবর্ষকে দখলে রাখতে অদৃশ্য হাতে আশীর্বাদ দান করল ওই “ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’-র উদ্যোক্তাদের৷”

   সেদিন বাইরের অবস্থা এত ভয়াবহ, ভাবতে পারেননি তিনি৷ পথে পথে মৃতদেহ ছড়ানো—নিরীহ মানুষজনের দেহ, শিশুদের দেহ৷ মর্মান্তিক সে অভিজ্ঞতা৷ কোনোক্রমে পৌঁছন রাসবিহারী এভেনিউয়ে দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে৷ সেখানে তখন হাজির শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র৷ কলিম শরাফীকে দেখেই চিৎকার করে ওঠেন দেবব্রত বিশ্বাস, “শা… বাঁইচা আছে৷” তাড়াতাড়ি একটা কামরার দরজা খুলে তাঁকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়৷ শুয়ে থাকতে বলা হয় খাটের নীচে৷ বাড়ির কাজের লোকের চোখের আড়ালে রাখতে এই ব্যবস্থা৷ খবর যেন বাইরে না যায় কোনওভাবেই৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এসে বলেছেন, একজন দেখেছে, কলিম নাকি এদিকে এসেছে৷ দেবব্রত বিশ্বাস জবাব দিয়েছেন, ‘সারছে, ব্যাটায় মরব নির্ঘাত৷” সাতদিন লুকিয়ে রাখার পর বাসে চাপিয়ে দেবব্রত বিশ্বাস কলিম শরাফীকে পৌঁছে দেন মুজফফর আহমেদের কাছে৷ খবর গোপন থাকেনি৷ “হিন্দু’ দাঙ্গাবাজরা এতদিন চড়াও হল দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে৷ সেই সময় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজন সংখ্যায় ছিলেন বেশি এবং সাহসী৷ তাই দাঙ্গাবাজরা সুবিধে করতে পারেনি৷ দেবব্রত বিশ্বাস গর্জে উঠেছিলেন, শাট আপ ইউ মিডল ক্লাস৷ 

   কলকাতার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি, দাঙ্গা-হানাহানি, ঘৃণা-বিদ্বেষ “মুসলমান’ কলিম শরাফীর জন্য কোনো জায়গা রাখল না৷ আ্র্থিক অনটন চরম পর্য়ায়ে পৌঁছনোর আগে বন্ধুবান্ধব সহ সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ঢাকা চলে যাবার— দেশতাগের৷ পাকিস্তানেও জায়গা যথাযথ জায়গা হয়নি তাঁর৷ কারণ তিনি আদর্শ “মুসলমান” নন৷ সাম্প্রদায়িক চিন্তার বিরুদ্ধে কথা বলেন, মানুষের ধর্মে বিশ্বাস করেন, আরো বড়ো বিষয়, তিনি রবিঠাকুরের গান নিজে করেন এবং অন্যদের শেখান৷ অসাধারণ কণ্ঠস্বরের অধিকারী কলিম শরাফী যথেষ্ট গান রেখে যেতে পারলেন না৷                      

2 COMMENTS

  1. কলিম শরাফী সম্পর্কে কিছুই জমাতাম না। পড়লাম। এ এক অনাস্বাদিত অনুভবন। ধন্যবাদ মধুময় পালকে। বাকি লেখাগুলো ক্রমশ পড়বো।♥♥♥♥♥

    • নিশ্চয় পড়বেন। ধন্যবাদ আপনাকে। আর মূল্যবান মতামত দেবেন।

Comments are closed.