শ্রীলঙ্কা— একটি দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা রোজই দেখছে গোটা পৃথিবী। দেশটিতে আজ খাবার নেই, পেট্রল নেই, চাকরি নেই। যেন গোটা ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে  রয়েছে শ্রীলঙ্কা।  আজকের শ্রীলঙ্কার হাল দেখে বিশ্বের তাবড় অর্থনীতিবিদরা কিন্তু বলছেন, এখানেই শেষ নয়। আরও বিপদ আসছে। আর সেটা শুধু শ্রীলঙ্কার জন্য নয়, এমনই বিপর্যয়ের চোরাস্রোতে ডুবে যেতে পারে আরও বেশ কয়েকটি দেশের অর্থনীতি।

সারা পৃথিবীতে ৯৪টি দেশের প্রায় ১৬০ কোটি মানুষ দুবেলা ঠিকমতো খেতে পারছে না, তার মধ্যে ১২০ কোটি লোকের অবস্থা ভয়াবহ। একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় উঠে আসা এমন তথ্য আমাদের চমকে দিচ্ছে।  বিশ্ব খাদ্য সূচক বলছে, সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। কিছুদিন আগেই রাষ্ট্রসঙ্ঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, শুধু ভারতে সঠিক ও সুষম খাদ্য পায় না প্রায় ৯৭ কোটি লোক। শেষ দু’বছরের করোনা মহামারী প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে গোটা পৃথিবীর পর্যটন শিল্পকে। সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব জুড়ে বাড়িয়ে তুলেছে খাদ্য সঙ্কট। প্রতিনিয়ত লাফিয়ে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। দুর্বিষহ হয়ে উঠছে মানুষের জীবন। কি হতে চলেছে আগামী পৃথিবীর অবস্থা? কোন কোন দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে খাদের কিনারায়? একটি প্রথম সারির আন্তর্জাতিক টেলিভিশনের সমীক্ষায় এমনই কিছু দেশের নাম উঠে এসেছে, যাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে। একবার দেখা যাক সেই দেশগুলির বর্তমান পরিস্থিতি।  সমীক্ষায় নিয়ে আসা হয়েছে সেই দেশগুলিকে, যারা ইতিমধ্যেই দুর্নীতি, গৃহযুদ্ধ, অভ্যুত্থান কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত। তালিকার প্রথমেই রয়েছে—

১. আফগানিস্তান

 দেশটি দশকের পর দশক ধরে শুধু যুদ্ধ দেখেছে। কখনও গৃহযুদ্ধ কখনও বৈদেশিক আক্রমণ। ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ক্ষমতায় এসেছে তালিবান। তারপর থেকে সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করেছে। তালিবান কাবুল  দখলের পর থেকে সে দেশে সমস্ত মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।  কিন্তু খবর পাওয়া যাচ্ছে, আফগানিস্তান জুড়ে অর্থনীতি কার্যত স্থবির হয়ে গিয়েছে।  দেশটি শুধু ভরসা করে আছে বৈদেশিক সাহায্যের উপর। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর থেকে থমকে গিয়েছে আফগানিস্তানের বৈদেশিক বাণিজ্যও।  পশ্চিমি দুনিয়া নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে আফগানিস্তানের উপর। যার ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। দেশটির অর্ধেক মানুষ ( প্রায় তিন কোটি নব্বই লক্ষ ) গভীর অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন। মানুষের দুবেলা খাবার জোটানোরও সংস্থান নেই।

২। পাকিস্তান

পাকিস্তানের ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ড (IMF) থেকে নেওয়া ঋণের অঙ্ক ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত ১৩০ বিলিয়ন ডলার। এখন ইসলামাবাদ IMF-এর কাছে আবার ৬ বিলিয়ন ডলার বেল আউট প্যাকেজ দেবার অনুরোধ করেছে। পাকিস্তানের জ্বালানি তেলের দাম এখন আকাশছোঁয়া। এর ফলে পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে প্রায় ২১ শতাংশ। প্ৰধানমন্ত্ৰী শাহবাজ শরিফ আবার দেশের প্রধান শিল্পগুলির উপর ১০ শতাংশ সুপার ট্যাক্স বসিয়েছেন। এ বছরের মার্চ মাসের শেষে দেখা গিয়েছে, পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩.৫ বিলিয়ন ডলার। যার ফলে পাকিস্তানের পক্ষে আর মাত্র দু’মাস আমদানির সুবিধা থাকছে। এই সময়ে পাকিস্তানের প্রায় ৪ কোটি লোকের অন্নসংস্থান নেই। Global Hunger Index বলছে, ১১২টি দেশের মধ্যে ৯২তম স্থান পাকিস্তানের।

৩. আর্জেন্টিনা

আর্জেন্টিনার প্রতি দশজনের চারজন গরিব। ডলারের তুলনায় আজকের দিনে আর্জেন্টিনার মুদ্রার  (Argentine peso) পতন অব্যাহত। তাই  বর্তমানে আর্জেন্টিনার বৈদেশিক মুদ্রায় সংরক্ষণ খুব কম ( 42.7 billion U.S. dollars on June 11, 2021.) মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির সম্ভবনা ৭০ শতাংশ। IMF-এর সাথে আর্জেন্টিনা সরকারের ঋণ পুনর্গঠনের কথাবার্তা চলছে। কিন্তু বর্তমানে এই দেশের অবস্থা অতীব সঙ্কটজনক। এরই মধ্যে আর্জেন্টিনার অর্থমন্ত্রী, বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গুজমান হঠাৎ পদত্যাগ করেছেন। Pontificia Universidad Católica দ্বারা পরিচালিত ২০১৮ সালের জাতীয় গবেষণায় দেখা গিয়েছে, আর্জেন্টিনার ১৩ শতাংশ শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

৪. ইজিপ্ট বা মিশর

এপ্রিল মাসের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মিশরের মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে ১৫ শতাংশ। এর ফলে মিশরের গরিব মানুষেরা সঙ্কটজনক অবস্থায় পড়েছেন।  মিশরে যে মানুষরা দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন, তাঁরা দেশের ওয়েলফেয়ার প্রোগ্রামের উপর নির্ভরশীল। দেশটির পুরোটাই সাবসিডি নির্ভর। মিশরের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য সুদ কমিয়েছে ২ শতাংশ। ফলে মিশরবাসীর জন্য আরও দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে। মিশরে প্রায় ২৯.২ শতাংশ লোক চরম গরিব। দারিদ্র্যের প্রধান কারণ, সরকারি স্তরে দুর্নীতি, কর্মসংস্থানের অভাব এবং অপর্যাপ্ত শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে ব্যাপক বৈষম্য।

৫. লেবানন

লেবানন আর শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি একেবারে একরকম। দু’টি দেশের মিল হল, দেশীয় মুদ্রার অস্বাভাবিক পতন, খাদ্য ও জ্বালানি ঘাটতি, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত মধ্যবিত্ত সমাজ।

সবচেয়ে সমস্যার বিষয় হল, সরকারি স্তরে দুর্নীতি। যা শ্রীলঙ্কার মতো লেবাননকেও অর্থনৈতিক ভাবে শেষ করে দিচ্ছে। লেবাননের এই মানবসৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট ২০১৯ সালে শুরু হয়।  আর আজ দেশটি “একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র’’ (a failing State) হিসাবে সামনে এসেছে। লেবাননের প্রতি পাঁচ জনের চারজন দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন।

৬.  মায়ানমার

এবার এশিয়ার দেশ মায়ানমারের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। সেনাবাহিনী একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে দেশটির সমস্ত ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে। তারপর থেকে দেশটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এই বছর অর্থনৈতিক ভাবে দেশটির কোনও বৃদ্ধি ঘটবে না। 

৭.তুরস্ক

তুরস্কে লিরার (Turkish lira ) পতন অব্যাহত। ডলারের তুলনায় সবচেয়ে নীচে অবস্থান করছে লিরা। সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক দেশের মুদ্রা ঘাটতি মেটানোর জন্য বৈদেশিক ভাণ্ডারের থেকে ঋণ নিয়ে  অর্থনীতির ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা করছে। দেশটির সম্পত্তির ৫৪ শতাংশই বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত। ফলে  চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে তুরস্ক।

আজ যে শ্রীলঙ্কাকে আমরা দেখছি, তা কিন্তু একদিনে হয়নি। সীমাহীন দুর্নীতি ,সেই সাথে ধর্মীয় ভাবাবেগকে খুঁচিয়ে তুলে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি দেশটিকে ধ্বংসের কিনারায় দাঁড় করিয়েছে। তার উপরে লেগেছে করোনার ধাক্কা। শেষ হয়ে গিয়েছে পর্যটন। এসবেরই পথ ধরেই চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটছে আমাদের প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের।

আর শ্রীলঙ্কায় এই সঙ্কট চলছে যখন, তখন আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় রোজই নেমে আসছে নতুন নতুন সমস্যা। যেমন, করোনা অতিমারি,খাদ্য সঙ্কট, বিশ্ব উষ্ণায়ন ইত্যাদি। তাই প্রতিটি দেশেরই এখন সতর্ক হয়ে চলার সময় এসেছে।