নদীটার নাম ছিল বিতস্তা । আবার অনেক দূরের দেশে, গ্রীস দেশে এ নদীর নাম ছিল হাইডাস্পি । অত দূরের দেশের লোক এ নদীকে চিনত কেমন করে ? অতদিন আগে ? তখন তো মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ছিল না । এত আকাশ-জাহাজে চেপে দেশে বিদেশে যাওয়াও ছিল না । পৃথিবী যে এক গ্লোবাল ভিলেজ, সে ভাবনা তো তখন তৈরি হয় নি । তবে ?

ইতিহাস পুরাণ বলছে, আর্যরা ঋগ্বেদে এই নদীকে অত্যন্ত পবিত্র নদী হিসেবে উল্লেখ করেছিল । ঋগ্বেদের অনেক জায়গায় সপ্তসিন্ধু নামে যে শব্দটি পাওয়া যায়, বিতস্তা নদী এই সপ্তসিন্ধুর মধ্যে একটি ।  গ্রীস দেশে এই পবিত্র নদীর কথা ছড়িয়েছিল । কারণ গ্রীক বীর আলেকজান্ডার । এই নদীর ধারে তাঁর অনেক কর্মকাণ্ড । 

তখন অবশ্য নদীটার নাম বদলে গেছে । নাম হয়েছে ঝিলম । পারস্যের রাজা দারিয়াস দ্য গ্রেট এই নদীর তীরে নরম মাটিতে তাঁর পতাকাদন্ড লাগিযেছেন । জা-ই-আলম । পতাকার ভূমি । সেই থেকে অপভ্রংশ । কালে কালে নাম হয়েছে ঝিলম ।

অবশ্য নামে কি-ই বা এসে যায় ! সুন্দর হলেই হল । সে নদীই হোক, বা নারী । তার দিকে নজর পড়বেই । যেমন অমরজিত কাউর । ঝিলম নদীর ধারে ছোট্ট সবুজ মাঠের ধারে একলা বসে আছে অমরজিত । যদিও এ নাম ধরে এখন আর কেউ ডাকে না । বিতস্তার মতই অমরজিত হারিয়ে গেছে ।

নদীতে ছোট ছোট ঢেউ,  মাঝনদীতে পাল তোলা নৌকা । ঢেউয়ের তালে তালে ধেয়ে ধেয়ে চলছে মালবাহী লম্বা লম্বা বৈঠাবাওয়া নৌকো । অমরজিতের উথালপাথাল মনে এখন ওইরকমই ছোট ছোট ঢেউ । এত বছর পরেও যে ঢেউ ওঠে, সেটাই আশ্চর্য ।

উত্তর ও দক্ষিণদিক ঘিরে গ্রেটার হিমালয়, পিরপাঞ্জাল হিমালয়, শিবালিক হিমালয় । লাদাখ পর্বতমালা,  কারাকোরাম পর্বতমালা ৷ উপত্যকার চারপাশ আগলে রেখেছে হিমালয় ৷ পাশাপাশি নদীর মেলা । ঝিলম, লিডার, চন্দ্রভাগা, সিন্ধু, সুরু । নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক রূপের ডালি । অসংখ্য উপত্যকা । মনোরম সরোবর ৷ ঝিলম নদীর সঙ্গে সঙ্গে আছে ডাল হ্রদ, নাগিন হ্রদ । আপেল, আখরোট, চেরি নানা ফলের সম্ভার । জাফরান বা কেশরের অসংখ্য ক্ষেত । চিনার, পপলার, সারি সারি উইলো গাছ ৷ এখানে বছরভরই শীত ৷

আর এখন তো শীতকাল । এখন পাহাড়ের চূড়ায় গাছের পাতা দেখা যাবে না । পাহাড়ের গায়ে গায়ে বরফ আর কুয়াশা । উঁচু উঁচু চূড়ার ওপর ঝিকিমিকি সকালের রোদ । পাহাড়ের পায়ের কাছে সবুজ মখমল ঘাসের ওপর বরফের টুকরো । রোদ পড়ে চিকচিক ।

নদীর গায়ে গায়ে সুদৃশ্য সাতটি ঝুলন্ত সেতু । শান্ত, ঘুমন্ত । নদীর ধারে ধারে বাদাম গাছগুলোর শাখায় শাখায় কুঁড়ি । ফুল ফুটতে অনেক দেরি । নদীর বুকে, ঝিলের বুকে পদ্মপাতা । পদ্ম ফুলগুলো এখনো ঝলমল করে জাগে নি । পাহাড়ের পাকদণ্ডী ধরে ভেড়ার দল নেমে আসছে শান্ত হয়ে । ঝিলের জলে নৌকোগুলো শান্ত । ডাল লেক জুড়ে হাউসবোটগুলো ঘুমন্ত ।

এখন শীতকাল ।

                                **

রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল মেয়েটা । বাসস্টেশনে বসেছিল । এখান থেকে দূর পাল্লার বাস ছাড়ে । অমরজিত বসেছিল বাবার জন্যে । বাবা হোশিয়ারপুর গেছে সকালে । সন্ধেবেলা ফিরবে । বাউজি ফিরলেই অমরজিত মাযের নামে নালিশ করবে ।

কেন মাম্মি হরপ্রীতদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যেতে দিল না ? কেন গুরমিত ভাইয়ার নতুন বউয়ের মতো লিপস্টিক লাগতে দিল না ? মাম্মি খালি পড়াই করতে বলে । আর ঘরের কাজ । অমরজিতের বুঝি সাজতে, বেড়াতে ইচ্ছে করে না ? হরপ্রীত, সিম্মি, পুষ্পিন্দর সবাই গুরমিত ভাইয়ার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেল । মাম্মি কেন যেতে দেবে না ?

ববি ভাইয়া যে অমরজিতকে একটু বেশি পছন্দ করে, সে নিয়ে মাম্মির কত রাগ, ‘ড্রাইভার একটা ছেলে, তাও যদি নিজের গাড়ি হত ! ভাড়ার গাড়ি, আজ বোলেরো কাল ইনোভা নিয়ে আসছে । আর পাড়ার মেয়েগুলো হামলে পড়ছে । খবরদার যদি ওর সঙ্গে মিশবি তুই !’

সুখদেব ভাইয়া যে মেলায় গিয়ে চুড়ি কিনে দিল, তাতেও মাযের রাগ । সুখদেব ভাইয়া তো মায়েরই বাড়ির লোক । হরজিত আন্টির ভাশুরের ছেলে । হরজিত আন্টি মাযের নিজের বোন । সুখদেব ভাইয়া তো আর ড্রাইভার নয় । ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ফরিদাবাদের কলেজে । এত মেয়ে থাকতে সুখদেব ভাইয়া অমরজিতকেই চুড়ি কিনে দিয়েছে । চুড়ি পরাবার সময় হাত দুটো ধরে চোখের দিকে চেয়েছিল ।

মেলায় নাগরদোলায় পাশে বসেছে । পুষ্পিন্দর তো আঠার মতো লেগেছিল, সিম্মি বাড়ি থেকে আচার এনে খাইযেছে । তবু সুখদেব ভাইয়া ওদের সঙ্গে যায় নি । নাগরদোলা ওপর থেকে নামার সময় ভয় পেয়েছিল অমরজিত, দু’হাতে জড়িয়ে রেখেছিল সুখদেব । কি ভালো যে লাগছিল ! বুকের মধ্যে শিরশির কাঁপুনি । একটা শক্ত হাত বুকের ওপর এসে পড়েছে, কাঁপুনি হবে না ? একটু একটু লজ্জাও করছিল । অমরজিতের ছোট্ট বুকে উথালপাথাল ঢেউ । মাম্মি তার কি বুঝবে !

মাম্মির ওপর রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল অমরজিত । কতই বা বয়স হবে তখন ! চোদ্দ ? নাকি আরো কম ! কে জানে । আজকাল আর কিছুই মনে পড়ে না ।

বাসস্টেশনে বসেছিল ছোট্ট মেয়েটা । বাউজি আসবে বলে । দুপুর থেকে বিকেল । কত বাস এল । বাউজি এল না । অনেক সময়ই সন্ধে করে ফেরে বাউজি । মেয়েটা বসেই রইল । পাশেই বসেছিল মহিলা । হলুদ সাটিনের সালোয়ার, সবুজ সিল্কের কামিজ । ঝলমলে বাহারি ওড়না । গলায় হাতে গয়না । মাথায় লম্বা চুলেও গয়না । বিয়েবাড়ি থেকে ফিরছে ? তাহলে একা কেন ? মহিলাই একসময় গল্প জুড়েছিল । সঙ্গীসাথীরা আসছে, বাসের টিকিট নেবে বলে মহিলা আগেভাগে এসেছে । ‘আপ কাঁহা যা রহী হো, বেটা ?’

‘আপ’ শুনে বেশ লেগেছিল মেয়েটার । ‘বেটা’ শুনে ভরসা । ‘না না, আমি কোথাও যাচ্ছি না । আমার বাউজি আসবে, তাই ।‘

‘কোথায় থাকো বেটা ? একা একা এমন এসেছ ? কতরকম লোকজন । বিপদ হয় কত, জানো ? বাউজি কোথায় গেছেন ?’

গল্পে গল্পে সময় কেটে গেল । ফিরোজপুর দিল্লী গুরগাঁও । দুবাই কাতার কুয়েত । কত দেশ, কত জায়গার গল্প । কত ছেলেমেয়েদের চাকরি করে দিয়েছে মহিলা ।

‘আমার লেখাপড়া ভালো লাগে না ।‘ অমরজিত বলে ফেলেছিল ।

খুব হাসল মহিলা । নাম বলেছিল সোনম । সোনম আন্টি । ‘লেখাপড়া না করলেও চাকরি পাওয়া যায় । চাকরি করবে? কারো বাড়িতে ? ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর, হোটেল ? এয়ার হোস্টেস হতে চাও ? রোজগার করবে, নিজের মতো থাকবে, আনন্দ করবে । এই ছোট্ট শহরে থেকে কি করবে ? দিল্লী চলো । চাইলে অন্য দেশেও যেতে পারো ।‘

ভয় পেয়েছিল অমরজিত । অচেনা মানুষ, ছেলেধরা মেয়েধরা নয় তো ? মুখ দেখেই বুঝে ফেলেছিল সোনম আন্টি, ‘তার আগে তোমার বাড়িতে কথা বলতে হবে । বাউজি আসুন । মা বাবা মত দিলে তবে তো ?’ তখন ভরসা হয়েছিল ।

নতুন পাওয়া আন্টি গল্প করেছিল অনেক মেয়ের । অমরজিতের মতোই মেয়েরা সব । এখন শহরে থেকে রোজগার করছে ।  জলন্ধরে এসেছিল তেমনই একটা মেয়ের বিয়েতে । রোজগার করে সংসারে টাকা দিয়ে, বাবার চাষের বন্ধকী জমি ছাড়িয়ে, ভাইবোনের সহায় হয়ে আজ নিজে বিয়ে করেছে মেয়ে । সেই বিয়েতে যোগ দিতে দিল্লী থেকে এসেছিল সোনম আন্টি ।

সন্ধে হয়ে এল । লাড্ডু খেতে দিল মহিলা । মসালা কোল্ডড্রিঙ্ক । ব্যস । জীবননদীর ধারাটাই বদলে গেল ।

                                **

বড় একটা শ্বাস পড়ল অমরজিতের । গত সাতাশ বছর ধরে এমন কত যে গল্প ।

এই তো গত মাসে আঠারো বছরের শরিফা বানো উদ্ধার হল । ভাল কাজের প্রলোভন দিয়ে পাকিস্তানে পাচার হচ্ছিল । মেয়ে পাচারের অভিযোগে এক মা ও মেয়েকে আটক করেছে সদর থানা পুলিশ । শরিফা ছাড়াও আরো সাত সাতটি মেয়ে ছিল দলে ।

বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘর ছাড়া মেয়ে কত । বিক্রী হয়ে গেছে । ভালোবেসে ঘর ছেড়ে আসা মেয়েরা, প্রেমিক পুরুষ বিক্রী করে দিয়েছে । নিজের পরিবারের পুরুষ, মামা কাকা জামাইবাবু, কোথাও সুরক্ষিত নয় মেয়ে ।

বিপুলসংখ্যক নারী পাচার হচ্ছে পাকিস্তান, বাংলাদেশে । সীমান্ত দিয়ে । সীমান্ত ঘেঁষা ভারতের গ্রামগুলোতে রয়েছে পাচারকারী চক্রের ঘাঁটি । অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসা নিরাপদ রাখতে পরিবারের পুরুষদের সঙ্গে রাখছে পাচারকারীরা । চরাঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারগুলো এদের প্রধান টার্গেট । কমবয়সীদের প্রতি ঝোঁক থাকে বেশি । বর্ডার পার হওয়ার পরে রেস্টে রাখা হয় পাচার হয়ে আসা নারীদের । সুযোগ বুঝে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাসে কিংবা রেলে । আগে থেকে ঠিক করে রাখা খদ্দেরদের কাছে । যৌন নির্যাতন করা হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো করে ।

এরপর ভাগ্য ঠিক হয় তাদের । অনেকে পেশাদার যৌনকর্মী হয়ে যায় ।

চোদ্দ বছরের অমরজিত এই নতুন জীবনে এসে পড়েছিল । চোদ্দ থেকে চব্বিশ । হাতবদল, বিছানা বদল, নির্যাতনের ধরণ বদল । তারপর নদীর ধারার দিকবদল । বছর আঠারো আগে প্রথম যে মেয়েটির হাত ধরে আজকের অমরজিত.. না, অমরজিত না.. পারভীন খাতুন নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছিল, সে মেয়েটার নাম ছিল রুনা ।

মামা রহমান মমিন মহেশপুর আকাশী গ্রামে রুনাকে বেড়াতে নিয়ে আসে । তারপর লম্পট মামা তাকে তুলে দেয় স্ত্রীর বড় বোন সাতক্ষীরা গ্রামের আয়েশা খাতুনের হাতে। আয়েশার মেয়ে সালেহা কাশ্মীরে থাকত । রুনাকে কাশ্মীরে নিয়ে যাওয়া হয় । আব্দুর রশিদ নামে এক কাশ্মীরীর কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে যায় রুনা । রুনার তখন তেরো বছর বয়স ।

রুনার অবশ্য ভাগ্য ভালই বলতে হবে । বিয়ে হয়ে এক পুরুষের সঙ্গিনী । যৌন নির্যাতন বলতে কি বোঝায়, তা  চিনতে হয় নি । অমরজিতের মতো, কিংবা আরো অনেক পাচার হওয়া মেয়েদের যন্ত্রণা, যৌন নির্যাতন রুনার কপালে হয় নি ।

আসলে কাশ্মীরে বিয়ে করতে হলে মেয়ের বাবাকে মোটা টাকা দিতে হয় । যে কারণে কাশ্মীরের ছেলেরা বেশি বয়সে বিয়ে করে থাকে । পাচার হয়ে আসা মেয়েদের বেলায় খরচা কম । বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারতের নানা রাজ্য থেকে পাচার হয়ে মেয়ে আসে । দরিদ্র খেটে খাওয়া পুরুষরা পাচার হয়ে আসা মেয়েদের বিয়ে করে ।

বিধবা বেশে দুটি সন্তান সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফিরেছে রুনা । রহমান মমিন, আয়েশা, সালেহা সবাই ধরা পড়েছিল । কিন্তু যেমন হয় । আদালতে এ মামলাগুলোর বিচার হয় ধীরগতিতে । আসল পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িতরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে ।

রুনাকে উদ্ধার করে বাবা মাযের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিল পারভীন খাতুন । দীর্ঘ নয় বছর পর প্রশাসনের সহায়তায় রুনাকে দেশে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে পারভীন । খবরের কাগজ, টিভি থেকে লোক এসেছিল । পারভীনের ইন্টারভিউ বেরিয়েছিল । বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মুক্তি মহিলা সমিতির প্রধান কর্মী পারভীন খাতুন ।

অমরজিত থেকে পারভীন হয়ে ওঠা বিতস্তা থেকে ঝিলম হবার মতই ঘটনা ।

                                **

প্রথমে গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া পতিতাপল্লী । দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দালালরা সাধারণ মেয়েদের লোভ দেখিয়ে এইসব পল্লীতে নিয়ে আসে । পরে বিভিন্ন বাড়িওয়ালির কাছে মোটা অঙ্কের টাকায় বিক্রি করে ।

সোনম আন্টি নামে সেই মহিলার আসল নাম নাজমা বেগম । নারী পাচারকারী নাজমা । দালাল নাজমা । ঘুম ভাঙার পর অমরজিত তাকে আর দেখতে পায় নি । পুলিশের কাছে নামটা শুনেছিল । সেই সন্ধ্যায় দৌলতদিয়া পতিতাপল্লীতে অভিযান চালিয়ে যৌনকর্মী সাজেদার বাড়ি থেকে চোদ্দ বছরের দুই কিশোরীকে উদ্ধার করে পুলিশ । কোন জেলা, কোন শহর, শহর নাকি গ্রাম, কিছুই বলতে পারে নি অমরজিত । বাংলায় কথা বলছিল সবাই ।

নাজমা বেগম ধরা পড়ে নি । কিন্তু দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় কিশোরীরা রক্ষা পেয়েছিল ।

শেষরক্ষা কিন্তু হয় নি । প্রথমে থানায়,তারপর একটা হোমে । সেখান থেকে অমৃতসর সীমান্তে । ওয়াগা সীমান্ত । অমৃতসর থেকে কিছুটা দূরে সীমান্ত চৌকি ওয়াগা হয়ে পথ গেছে লাহোরে । ওয়াগা সীমান্তেই তো ? আজকাল আর কিছুই ঠিকঠাক মনে পড়ে না ।

শুধু মনে আছে, সেই বর্ডারে হিন্দুস্তান আর পাকিস্তানের মধ্যে অপহৃতা বারোজন মেয়ে বিনিময় হল । বারোজন, নাকি চোদ্দজন ? লাজো, সেই দৌলতদিয়া থেকে সঙ্গে সঙ্গে হাতবদল হয়েছে বারবার, শক্ত করে অমরজিতকে ধরে দাঁড়িয়েছিল । মুসকান আর ফারহা দুই বোন, একে অন্যকে ধরে দাঁড়িয়েছিল । অপহৃতা মেয়েদের মধ্যে দুজন বউ, একজন বাঙালি, একজন পাঞ্জাবী.. মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে । আর একজন ছিল । প্রফুল । কারো সঙ্গে কথা বলত না, সবাই বলছিল ও পাগল ।

মেধা দেশাই । ধবধবে সাদা চুল, টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ, লাল লাল গাল, সবুজ পাড় গাঢ় মেরুন শাড়ী । মেয়েদের উদ্ধার করার পর পুনর্বাসনের দাবি নিয়ে সেই সীমান্ত শহরে ।

লাজো বলেছিল, ‘মসীহা ।‘ মনে হয়েছিল, বাঁচলাম । এবার বাড়ি ফেরা হবে ।

মেধা দেশাই বলছিলেন মাইক হাতে, খুঁজে খুঁজে সব্বাইকে বাড়ি পাঠানো হবে ।

অমরজিতের বাড়ি থেকে কেউ আসে নি যদিও, হয়ত খবরই পায় নি । লাজোর মা বাবা এসেছিলেন, বউ দুজনের স্বামী । মুসকান আর ফারহার মামা না চাচা । লাজো চলে যাবে, খুব ভয় করছিল মেয়েটার । খুব কেঁদেছিল লাজোও, ‘ওকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে চলো ।‘

শক্ত চোখে তাকিয়েছিলেন লাজোর বাবা-মা ।

অনেক বছর পর জেনেছিল মেয়েটা, লাজোরও বাড়ি ফেরা হয় নি । অমৃতসরে কোন আত্মীয়ের বাড়ি ছিল কিছুদিন, তারপর বুড়ো একটা লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছিল । মেধা দেশাইই বলেছিলেন একদিন ।

‘কোথায় যাবি তুই? বাড়ি? বাড়িতে ফিরিয়ে নেবে? লাজোর কি হয়েছে জানিস?’

আহা লাজো । তার চেয়ে এখানেই থাকতে পারত । নাহয় অমরজিতের মতই রোজ রাতে খাটতে যেত । তবু তো দুজনে একসঙ্গে থাকতে পারত !

মেধা দেশাই, লাজোর মসীহা । মসীহার নতুন রূপটা তো দেখাই হল না লাজোর । দিনের বেলার মসীহা, হ্যাণ্ডলুমের শাড়ি, চোখে চশমা । টিভির ক্যামেরায়, মাইক হাতে ডায়াসে, ছলছল চোখ, মুখের নরম রেখায় করুণা । নারী উদ্ধার, মেয়েদের হোম, মহিলা মুক্তি সংগঠন, অত্যাচারিতা মেয়েদের পুনর্বাসন, দেশে বিদেশে কত প্রচার । নাম, দেশী বিদেশী অ্যাওয়ার্ড, বিদেশী মুদ্রা, স্বদেশী গ্রান্ট, সরকারী অনুদান ।

সন্ধে নামলেই কঠোর দৃষ্টি, হিংস্র মুখের রেখা । সোনালি তরল, ফোন । অর্ডার মাফিক হোমের মেয়েরা খাটতে যায় । যেতেই হয় । আজ হোটেল, কাল হাউসবোট । বর্ডারে তাঁবুতে ।

বউ দুজনের স্বামী তাদের নিয়ে যেতে চায় নি । নিয়েই যখন যাবে না, তখন কি দেখতে এসেছিল কে জানে । প্রফুল গেল মানসিক রোগীদের হাসপাতালে । মুসকান আর ফারহা যেতেই চায় নি । দু’বোনকে আলাদা আলাদা নিয়ে গেল চাচা আর মামা । কে জানে সেখান থেকে কোন পথে, কোন দেশে ।

বাড়ি ফেরা যে হয় না, সাতাশ বছরের চলমান জীবন থেকে জেনেছে অমরজিত । 

                                **

সন্ধে পেরিয়ে রাত নামলেই সীমানা মুছে যায় ।

নাবালিকা হলে ফুর্তিটা বেশি । এইডসের ভয় নেই, নরম শরীরে মাখনের মতো আরাম । অল্পবয়সী বউ হলে আরো ভালো । ওরা কাম আচরণ শিখেই আসে । অমরজিতের মতো অর্বাচীন মেয়েগুলোকে কামসূত্রের পথ দিত মেধা দেশাই নিজে ।

মিনা নামের একটা মেয়ে, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এসেছিল, কামসূত্র শিখতে ঝামেলা করেছিল । জামাকাপড় খুলে নিয়ে একসঙ্গে তিনটে দালালের কোলে ফেলে দিয়েছিল মেধা দেশাই । অমরজিতদের সবাইকে সার দিয়ে বসে সে দৃশ্য দেখতে হয়েছিল ।

ওই দালালদের একজনের সঙ্গে প্রেম ভালোবাসা করে বাড়ি ছেড়ে এসেছিল মিনা । মিনা না, ওর আসল নাম তুলসী । পারভীন খাতুন যখন মহিলা মুক্তি সংগঠনের প্রধান, মেধা দেশাইয়ের আসল রূপ কুকীর্তি ধরা পড়ে হাজতবাস, তুলসী এসে পাশে দাঁড়িয়েছিল । তুলসী, শবনম, বেলা, তুহিনা, লাজবন্তী, মৌসম ।

‘কিছু হবে না । কোর্টে কেস উঠবেই না । উঠলেও ও প্রমাণ করে দেবে, ওর হাত ছিল না । আবার আরেক জায়গায় এই বেওসা খুলে বসবে দেখো ।‘ তুলসী বলেছিল, ‘দালালগুলোকে দিয়ে প্রেম করাবে, প্রেম ভালোবাসার অভিনয় দেখে আমার মতো আরো পাঁচটা মেয়ে এসেই পড়বে । ওই গুরবক্সকে খতম করলে তবে আমার শান্তি ।‘

দালাল গুরবক্স, প্রেমের অভিনয়ে পোক্ত দালাল । দালালগুলো শেষ না হলে মেয়েদের রক্ষা নেই, শান্তি নেই । দালালগুলোকে ধরে ফেলতে হবে, কঠোর শাস্তি দিতে হবে । ঘাঁটিগুলো ভেঙে দিতে হবে । প্রতিবাদ । প্রতিরোধ । মরে যাবার পর আর ভয় কিসের ! এক মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছে মেয়েরা সবাই । পারভীন খাতুন তাদের নেত্রী ।

পারভীন । ভরা চাঁদের সুন্দর নির্মল রাতে কুমারীর অস্পৃশ্য পবিত্র শরীর জুড়ে নেমে এসেছিল সীমান্তপারের জওয়ানের কঠিন স্পর্শ । ঘুমন্ত ঝিলমের বুকে আকাশের চাঁদের নিথর প্রতিবিম্ব । ঝিলমের জল তীরভূমিকে স্পর্শ করে আছে আবেশে । স্বপ্নিল পরিবেশ । কিন্তু মানুষের জীবনে মানুষের স্পর্শে ভালোবাসা ছিল না । কোনো মন্দির মসজিদ গির্জায় প্রার্থনার মন্ত্র উচ্চারণ হয় নি সে রাতে । রাতের আকাশে উড়ন্ত বাজপাখির শীত্কার ছাড়া কোনো শব্দ ভেসে ওঠে নি ।

কত সন্ধ্যা, কত রাতই না কাটবে এমন । আজকের রাতের পর থেকে । ছোট্ট চোদ্দ বছরের মেয়েটা তখন জানত না । ফুলের অনাঘ্রাত কুঁড়ি কুঁকড়ে উঠেছিল । জগত্‍ব্যাপী সুন্দর মুছে গেল সেই এক রাতে ।

খদ্দের তৃপ্ত । মুগ্ধ । মেধা দেশাইয়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল আগামী পনেরো রাতের যৌবন। নরম মাংস, নোনতা লাল রক্ত, একটু কষা, একটু মিষ্টি । হোমে ফেরার পর আদর করেছিল মেধা দেশাই । নাম বদলে দিয়েছিল, পারভীন ।

বড় শ্বাস পড়ল আবার । চাইলেই কি সব স্মৃতি মুছে ফেলা যায় !

                                **

সেই সুন্দর মানুষটা বলেছিল, ‘যায় । ঝিলাম, চেনার, রাতি, বিপাশা, শতদ্রু । পঞ্চনদের দেশ পাঞ্জাব । পাঞ্জাব দিয়েই শক হুন পাঠান মোগল এসেছিল ভারত নামের দেশটায় । আর্যরাও এসেছিল, হিন্দুকুশ পেরিয়ে এই পাঞ্জাব হয়েই । বারবার খন্ডিত হয়েছে পাঞ্জাব । খন্ডিত হয়েছে পাঁচটা নদী । কিন্তু, তুমি কি জানো যে, এই পাঞ্জাবের নদীর ধারে.. ওই ঝিলম নদীর ধারেই কেমন সুন্দর জীবনের গল্প ? জানো আলেকজান্ডার আর পুরুর কথা ?’

না, জানে না মেয়েটা । যার দিন রাত শুধু শরীর নিয়েই কেটেছে, সে ইতিহাস জানবে কি করে? কবে স্কুলে যেত, কবে হাত দিয়ে বই স্পর্শ করেছিল, সব ভুলে গেছে মেয়েটা ।

গ্রীক বীর আলেকজান্ডার । একের পর এক রাজাকে পরাজিত করে বিজয়গর্বে এগিয়ে এসেছিলেন পঞ্চনদের দেশের মধ্যে দিয়ে । তক্ষশিলার রাজাকে পরাজিত করে ঝিলম নদীর দেশ ঝিলাম রাজ্যের দিকে । তাই বুঝি সুদূর গ্রীসদেশেও ঝিলম নদী সবার আপন ।

ঝিলমের ধারে প্রবল বিক্রমে লড়াইয়ে আলেকজান্ডারকে প্রায় পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল পুরুরাজার বাহিনী । পরাজয় প্রায় ছুঁই ছুঁই অবস্থায় সামলে ওঠেন আলেকজান্ডার । হারানো বিজয় ছিনিয়ে আনেন । অসীম বীরত্বে যুদ্ধ করে পুরু আহত অবস্থায় বন্দী । দুই ছেলে যুদ্ধে নিহত । খাঁচায় বন্দী করে আলেকজান্ডারের সম্মুখে উপস্থিত করা হল পুরুরাজাকে । পরাজিত বন্দী রাজা এমন  ব্যবহারে তীব্র উষ্মা প্রকাশ করলেন ।

গ্রীক বীর অবাক, আহত পরাজিত রাজার এমন উষ্মায় । জানতে চাইলেন, একজন পরাজিত রাজা এর চেয়ে বেশি কি আচরণ আশা করেন ?

উন্নত শির, গর্বে আর আত্মমর্যাদাবোধে বলীয়ান উপমহাদেশীয় বীর বলেন, একজন রাজার কাছে আরেকজন রাজার যে মর্যাদা, তাই তিনি আশা করেন ।

মুগ্ধ আলেকজান্ডার তখনই মুক্তি দেন পুরুকে এবং রাজ্য ফিরিয়ে দেন । শর্ত রইল, পুরুরাজ রাজ্যশাসন করবেন আলেকজান্ডারের নামে । রাজনীতির নিয়মে শর্ত । অপমানের কিছু নেই । আলেকজান্ডার পুরুর অসাধারণ সাহস, বীরত্ব ও স্বদেশপ্রেমে মুগ্ধ । তাঁর সঙ্গে মিত্রতা করলেন । আর পুরু আলেকজান্ডারের বিজয় এবং বন্ধুত্ব স্বীকার করে ঝিলাম নদীর তীরে বুকেফালা ও নিকাইয়া নামে দু‘টি নগরী তৈরি করলেন ।

আচ্ছা, মেধা দেশাই তো লেখাপড়া জানে.. সে এই গল্পটা জানে না ?

ডাল লেকের ওপর হাউস বোটে এসে থাকত এক কবি । নামী কবি, শুনেছে মেয়েটা । অমরজিত, থুড়ি পারভীনকে খুব পছন্দ করেছিল সে । গরমের দিনে এসে হাউসবোটে থাকত ।  শীতের সময় জল যখন বরফ হয়ে যেত, তখনও আসত । হোটেলে থাকত । পাঁচদিন সাতদিন দশদিন । পারভীনকে ছাড়া চলতই না তার । মেধা দেশাই বলত, ‘বুদ্ধু লড়কি, জানিসই না কার সঙ্গে থাকছিস তুই । লাহোর থেকে অমৃতসর, মেয়েরা ওর ভক্ত । না চাইতেই তুই তাকে পাচ্ছিস । বুঝলি ?’

অত নামী সম্মানীয় কবি লোকটা পুরুরাজার গল্পটা জানত না? রাজার প্রতি রাজার, মানুষের প্রতি মানুষের সম্মানের গল্প? যে গল্পটা শুনে অনেকদিন পরে ঝিলমের বুক জুড়ে কান্না নেমেছিল?

                                                **

আর কি আসবে সে ? জীবনের গল্প শুনিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে চলে গেল যে ? আবার আসব আমি, বলেছিল । গত শীতে । এক বছর হয়ে গেল ।

মকাইয়ের ভুট্টা, শুকনো খোবানি, জরদালু । আখরোট, বাদাম । দোপাট্টার মধ্যে জড়ানো একটা থলিতে সব । ঝিলের কিনারে বাদামগাছের আড়ালে পাকদণ্ডী পথ । কোনো গাছ থেকে একটা পাখি ডেকে উঠল । ঝিলম নদীর ধারে একলা বসে রইল অমরজিত ।

ওয়াহে গুরু ! আবার অমরজিত ! না । পারভীন খাতুন ।

বছর তিন আগে খুঁজে খুঁজে গ্রামে ফিরেছিল মেয়েটা । ততদিনে প্রায় সাতজন মেয়েকে বাড়ি ফেরানো গেছে,সুস্থ জীবনে ফেরানো হয়েছে আরো কিছু মেয়েকে । নিজের ওপর বিশ্বাস ফিরছিল। ভরসা জেগেছিল নতুন করে । এবার বাড়ি ফেরার মুখ হয়েছে অমরজিতেরও ।

আহা বাউজি! আহা মাম্মি! না জানি কত খুঁজেছে মেয়েকে ! পরম ভাইয়া, সুখী ভাইয়া, ডলি, রাজো । ভাইবোনদের দেখে কি আর চিনতে পারবে মেয়েটা ?

না, প্রথমে চিনতে পারে নি কেউ । কিন্তু তারপর ? মেয়েটা ভেবেছিল, আকুলিবিকুলি কান্নাকাটি করবে মাম্মি, বাউজি । ভাইবোনেরা জড়িয়ে ধরে হাসবে, হৈ হৈ করবে ।

বাউজি খাটিয়া থেকে ওঠে নি । মাম্মি হাত ধরে টেনে এনেছিল গোয়ালঘরে, ‘চলি যা । নই দুলহন আয়ী, অব বহুত সারী মেহমান হ্যায় ঘর মে । সামনে মত আনা ।‘

বাড়িতে এখন উত্‍সব । সুখী ভাইয়ার বিয়ে । এমন আনন্দের দিনে এ কি উত্‍পাত ! পরমভাইয়া, পরমিন্দর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিল । ছেলেমেয়েদের উঠোন থেকে তুলে ঘরে ঢুকে গেছিল তার বউ । সুখবিন্দর নতুন দুলহন নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল । ডলি, রাজো কাউকে দেখা যায় নি । ওদের বিয়ে হয়ে গেছে । ছেলেমেয়েগুলো নতুন, বিয়ে হয়ে সবার ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে । ওরা এ মেয়ে, মেয়ে না বলে মহিলা বলাই যায়, ওরা এই মহিলাকে চেনে না । বাড়িতে অনেক নতুন মুখ । পাড়ায়ও । সব অচেনা । এই গোটা মহল্লায় আর জায়গা নেই পালিয়ে যাওয়া মন্দ মেয়ের ।

ফেরার পথে গুরুদোয়ারায় ঢুকে বসেছিল মেয়েটা । আর কোনদিন আসা হবে না এখানে ।

গুরুদোয়ারার ঠান্ডা মেঝে, ছোট লোহার গেট, গেটের পাশে শিরীষ গাছের তলায় গোল ঘোরানো বেদী । আর দেখা হবে না কোনদিন ।

পুরোনো মানুষ কেউ নেই । বিল্লু আন্টি থাকত যে, কেউ ছিল না তার, গুরুদোয়ারাই ঘরবাড়ি, কোথায় গেল ? বেঁচে নেই বুঝি আর ? বুড়ো গ্রন্থিবাবা কোথায় গেলেন ?

খানিক পরে অরদাস শুরু হল । অরদাস, কীর্তন । দেখা হয়েছিল নতুন মানুষের সঙ্গে । নতুন গ্রন্থি । তিনবছর পড়াশোনা করে গ্রন্থি হয়ে এসেছেন এই মহল্লায় । গুরদাস সিং ।

‘সত শ্রী অকাল’, হাসিমুখে চেয়েছিলেন মন্দ মেয়ের দিকে ।

                                **

‘ইক ওমকারা । ঈশ্বর কেবলমাত্র একজনই । তিনি পরম সত্য, তিনিই স্রষ্টা । সকল ভয় এবং ঘৃণা থেকে মুক্ত ।  তিনি অমর । স্বয়ম্ভু, মহান এবং দয়াময় ।‘ এই বরফ শীতল সম্পর্কের দেশে এসে আবার বলেছিল মানুষটা, ‘কাকে ঘৃণা করব ? কেনই বা ঘৃণা করব ? তোমার জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম । না ?’

‘কেন এসেছ তুমি ? চলে যাও ।‘ বলেছিল পারভীন ।

‘আমি সব শুনেছি । তোমার বাউজি বলেছেন আমায় ।‘

বাউজি ! একটু চঞ্চল হয়েছিল মনটা । তারপর কঠিন চোখে তাকিযেছে, ‘ওহ । তাই নষ্ট মেয়ের কাছে বেড়াতে এসেছ ?’

বিদ্রুপটা গায়েই লাগে নি ওর ‘আমি তো মাঘি মেলা উত্‍সবে এসেছি । ভাবলাম তোমাকে নিয়ে যাই। কি যে ভালো কাটে সময়টা ! তুমি নিশ্চয় দেখো নি ।‘

অমৃতসরে স্বর্ণমন্দিরে মাঘি মেলা উত্‍সব । শীতের ফসল তোলার পর এ উত্‍সবের আয়োজন করা হয় । ফসল তোলার উত্‍সব হত লোড়ি । ছোটবেলায় মহল্লা জুড়ে হৈহৈ হত লোড়ির সময় । সকালে গ্রন্থসাহেব পাঠ । গুরুদোয়ারায় লঙ্গর, সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া । সন্ধে হলে অরদাস, কীর্তন । তারপর আগুন জ্বেলে উত্‍সব । মেয়েরা লাল লহঙ্গা চোলি, ছেলেরা লম্বা পাগড়ি ।

 আহ, ছোটবেলা !

এদিকে হিমাচল প্রদেশে হয় মাঘা-সাজা,  পাঞ্জাবের লোড়ির মতই । সবার আছে এমন উত্‍সব । ওড়িশায় মকর চাউলা,  বাঙলায় পৌষ সংক্রান্তি । কোথাও মকর সংক্রান্তি, কোথাও অন্য পার্বণ ।

‘তাই তো । কোরআনে বলে আল্লাহ,  তৌরাত বলে জেহোভা,  ইঞ্জিল বলে ঈশ্বর,  আবেস্তা বলে আহুরা-মাজদা,  গুরুগ্রন্থ সাহেব বলে এক-ওমকার । স্মৃতি-শ্রুতি,  সংহিতা-গীতা, বেদ-পুরাণ বলে ভগবান । সবাই এক’, চোখ জুড়ে হাসছিল সেই লোকটা, ‘নিজেকে সবার চেয়ে আলাদা ভাবলেই হবে অমরজিত জি ? সরিয়ে রাখলেই হবে ? তুমি তো আছ এইখানে ।‘ চওড়া বুকের ওপর হাত রেখেছিল সে ।

কেঁপে উঠেছিল মেয়েটা । বুকের মধ্যে শিরশির । অগুনতি পুরুষের শয্যা সঙ্গিনী হয়েও এমন অনুভুতি হয় নি ।

‘হরেক গ্রন্থে হরেক স্রষ্টার নাম । কিন্তু সবখানেই একক স্রষ্টার জয়গান । শুধু কি তাই ? আরো শুনবে ? গীতাতে আছে আহমদের নাম । তৌরাত তাকে বলছে মেউদ মেউদ, হিব্রু ভাষায় প্যারাক্লিতোস । ইঞ্জিলে তাকে বলা হচ্ছে সহায়,  পুরানে কল্কি । ত্রিপিটক বলছে মৈত্তেয়, এ্যানালেক্ট বলছে সাধু, জেন্দাবেস্তা তাকে আহমদ বলে, আর কোরআনে বলে মুহাম্মদ । তবু মানুষ এক হয় না । এই আলাদা আলাদা নাম নিয়ে লড়াই । মানুষে মানুষে দূরত্ব । ভালোবাসা নেই । মানুষ নিজেকে ভুলে থাকছে । গুরমুখী ভাষা শিখেছিলে তুমি ছোটবেলায়, না জি ?’

এই কথায় কথায় ‘জি’ সম্বোধন, বড্ড এলোমেলো করে দেয় বুকের মধ্যে । এত সম্মান পাবার কথা নয় নষ্ট মন্দ মেয়ের ।

‘নিজেকে খারাপ ভাবতে নেই । যা হয়েছে, তোমার ইচ্ছেয় হয় নি । নিজের ইচ্ছেমতো একবার চেষ্টা করবে না ? জীবনটা সাজিয়ে নেবে না ? আমি তো আছি ।‘

‘কেন ? তুমি কেন ? তুমিই কেন ?’

‘আমি কেন ?’ হাসিমুখে গভীর চেয়েছিল মানুষটা, ‘বারো বছর বয়স থেকে গ্রন্থ সাহেব আমার সঙ্গী । আমার বয়সের ছেলেরা যখন কেরিয়ার আর জীবন নিয়ে ব্যস্ত, আমি তখন আকাডেমি তে ধর্মগুরু হবার পাঠ নিচ্ছি । গ্রন্থি হয়েছি মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে । কত জায়গায় কত গুরুদোয়ারায় ঘুরেছি, থেকেছি । কত মানুষ ভালোবেসে ঘরে নিতে চেয়েছেন, কত মেয়েরা..’ এইখানে একটু লজ্জা লজ্জা মুখে চেয়েছিল ।

‘আমি তোমার মতো একজনের অপেক্ষা করেছি । খাঁটি মানুষের অপেক্ষা । তুমি নিজেই জানো না, জীবনের আগুনে পুড়ে পুড়ে শুদ্ধ হয়েছ তুমি । তোমাকে যেদিন প্রথম দেখলাম.. পবিত্র দুই চোখ । তোমার বাউজি যখন সব বললেন আমায়, আমি তোমার জন্যে খুব কষ্ট পেয়েছি । জানো ?’

                                                **

খাঁটি মানুষ ! জীবনের কষ্টকর যন্ত্রণাময় চল্লিশ বছর পার করে এসে, নানা ঘাটের নানা রূপের পরশ পেয়ে নদী পলকের জন্যে থমকে দাঁড়িয়েছে ।

যদি মেয়ের সব গোপন কথা অন্য কেউ জেনে ফেলে, কোনো না-জানা রত্নের খোঁজে লুঠ হয়ে যায়, সে মেয়ে কি করে ? লুকিয়ে থাকে লোকচক্ষুর আড়ালে । এই মেয়ের জীবনে মাণ্ডীতে জিনিস বিক্রী হবার মতো সওদা হয়েছে । শরীর টিপে টিপে দেখে, বুকের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে সওদা । জোর করে গোপন অঙ্গে উল্কি ।

আহ ! কোন মুখে খাঁটি মানুষের কথা বলে সে ! কাকে খাঁটি বলে ?

সেদিন দূরের ওই জরদালু গাছটা সাদা ফুলে ভরে ছিল । বসন্ত আসছে কিনা । ক’দিন পরেই সবুজ সবুজ জরদালু হয়ে উঠবে । সেই দিকে চেয়ে বলেছিল মানুষটা, ‘প্রকৃতির জগতে দেখেছ? কিছুই থেমে থাকে না । এই গাছ, ওই নদী, ওপরের মস্ত আকাশের ওপারে সূর্য.. যুগ যুগ ধরে একইভাবে দিয়ে চলেছে । সব লুঠ হয়ে যাচ্ছে, মানুষ নিংড়ে নিচ্ছে প্রকৃতির সবটুকু রস । আবার জেগে উঠছে গাছ, নদী । নতুন শক্তি নিয়ে । তাহলে ? মানুষ কেন পারবে না ? একটাই তো জীবন মানুষের । সোনার মতো শুদ্ধ খাঁটি হয়ে উঠতে পেরেছ তুমি, আর এটুকু পারবে না ? কেমন অবলীলায় ঘরে ফিরিয়ে দিচ্ছ মেয়েদের, আর নিজের ঘর গড়ে নিতে পারবে না ?’

সবুজ সবুজ জরদালু । ক’দিন পরেই পেকে উঠে হলুদ, সোনালি, লাল হয়ে উঠবে । লাল লাল জরদালু হোমের খোলা উঠোনে বিছিয়ে দিয়ে শুকিয়ে রাখে লাজবন্তী । ওর ভাই খুব খেতে ভালোবাসে । সেই ভাই, যে লাজবন্তীকে বাড়ি নিয়ে যায় নি । কত কেঁদেছিল মেয়েটা, ‘তোকে আমি কোলে নিয়ে খেলা দিতাম, হাত ধরে ইশকুলে নিয়ে যেতাম, সেই তুই ভাই ? তুইও আমাকে ঘেন্না করবি ? বাড়ি নিয়ে যাবি না ?’

ঘেন্না করে বাড়ি নিয়ে না গেলেও ভাই আসে মাঝেসাঝে, মন্দ দিদির টাকায় তার ঘেন্না নেই । আর সেই ভাইয়ের জন্যে শুকনো জরদালু সংগ্রহ করে রাখে লাজবন্তী ।

লাজবন্তী পেরেছে । অমরজিত পারবে না ?

‘আবার আসব আমি ।‘ ফিরে যাবার সময় এই নদীর ধারে, এই বাদাম গাছের ছায়ায় বলেছিল সে, ‘আগামী বছর মাঘী মেলায় আমার সঙ্গে অমৃতসর যাবে তুমি ?’

গত একবছর ধরে ভালো করে গুরুমুখী শিখেছে অমরজিত । রোজ সকালে গ্রন্থসাহেব পাঠ । আদি গ্রন্থসাহেব । বারবার পড়েছে মূল কথাটা, এই প্রলোভনে ভরা জগতে পবিত্র জীবনই ধর্ম । একা একাই অরদাস করেছে রোজ । প্রার্থনা । আর অপেক্ষা ।

শীত তো এসেই গেল । আর কদিন পরেই লোড়ি । এই ঝিলম নদীর ধারেই আসবে সে । আনন্দ, বেদনায, মিলন, বিরহ, সঙ্কটে সঙ্গী ঝিলম ।

অবারিত সবুজের প্রান্ত ছুঁয়ে নির্ভয় নীলাকাশ ছায়া ফেলেছে নদীর নির্মল বুকে । নদী মিশে গেছে জীবনের টুকরো টুকরো অনুষঙ্গের মধ্যে তার বিচিত্র গতিধারা নিয়ে ৷ নদী আর কেবল নদী মাত্র নয় ৷ নদী আজ অনেক মেয়ের জীবনের উপমা, চিত্তের প্রতীক ৷ ঝিলম আর এই সব লুণ্ঠিতা মেয়েদের ইতিহাস মিলেমিশে একাকার ৷

মকাইয়ের ভুট্টা, শুকনো খোবানি, জরদালু । আখরোট, বাদাম । একবছর ধরে জমিয়ে রেখেছে মেয়েটা । সে আসবে ।

হেরে যেতে যেতে, লুঠ হয়ে অপমানে কষ্টে যন্ত্রণায় মানুষ মরে যায় । কিন্তু জীবন মরে না । এক শীত পার হয়ে শীতল ঋতু আসে । কিন্তু মাঝখানে আসে বসন্ত, গ্রীষ্ম, ঘনঘোর বর্ষা । তখন তৈরি হতে হয় শীতের মোকাবিলা করার জন্যে ।  শীত আসবেই, কিন্তু তারপরেই আসবে বসন্ত । সেই উজ্জ্বল মানুষটার দিকে উজ্জ্বল চোখে চাইবে অমরজিত, ‘এসো । তোমার জন্যেই তো অপেক্ষায় আছি ।‘ তারপর শুধুই বসন্ত । পাকদণ্ডী পথ ধরে জীবনের চলা শুরু।