পর্ব ৭

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

 সমাজ যত নাগরিক হয়েছে, তত চাহিদা বেড়েছে বারবনিতাদের। যেখানে শহর গড়ে উঠেছে, সেখানেই গড়ে উঠেছে বেশ্যালয়। যেখানে বন্দর, ধর্মস্থান বা ব্যবসার কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, সেখানে বাইরে থেকে লোকজন এসে জড়ো হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের পরিবার থেকেছে দূর দেশে। একাকী পুরুষ জৈবিক প্রবৃত্তি নিবৃত্তির জন্য খুঁজে নিয়েছে স্থানীয় ভাবে প্রাপ্ত নারীদের। এজন্য ওই সব জায়গায় পুরুষদের যৌন চাহিদা মেটাতে গণিকারাও ভিড় করেছে। যে কারণে গ্রামবাংলার ছোট ছোট মফস্বল শহরেও গড়ে উঠেছিল পতিতালয়। যেমন হাওড়া জেলার আমতা, উলুবেড়িয়া, ডোমজুড়ে গড়ে উঠেছিল পতিতালয়। বর্তমানে জনবসতির চাপে এগুলির আয়তন ক্রমহ্রাসমান। উলুবেড়িয়া গঙ্গাতীরে, আমতা দামোদরের তীরে, ডোমজুড় সরস্বতী নদীর তীরে গড়ে ওঠা বাণিজ্য কেন্দ্র। কালীঘাট মন্দিরের কাছে গড়ে ওঠা পতিতাপল্লীর খদ্দের ছিল প্রধানত পূজা দিতে আসা লোকজন।

নগরে কীভাবে যৌনপল্লী গড়ে ওঠে, তার একটা বর্ণনা দিয়েছেন কার্তিকেয় চন্দ্ররায় তাঁর আত্মজীবনীতে। কার্তিকেয় চন্দ্ররায় (১৮২০-১৮৮৫) ছিলেন কৃষ্ণনগরের মহারাজা শ্রীশচন্দ্রের দেওয়ান। মৃত্যুর পর তাঁর আত্মজীবনী ১৯০৪ সালে ‘দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্রের আত্ম-জীবন চরিত’ নামে প্রকাশিত হয়। এঁর পুত্র ছিলেন কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। কার্তিকেয় চন্দ্র লিখেছেন, “তৎকালে বিদেশে পরিবার সঙ্গে লইয়া যাইবার প্রথা অপ্রচলিত থাকাতে, প্রায় সকল আমলা, উকীল বা মোক্তারের এক একটি উপপত্নী অবশ্যক হইত। সুতরাং তাহাদের বাসস্থানের সন্নিহিত স্থানে স্থানে গণিকালয় স্থাপিত হইতে লাগিল।”

বর্তমান যুগেও এই ধারাবাহিকতার কোনও ব্যত্যয় হয়নি। শহরে, নগরে, বন্দরে, ধর্মস্থানে, ব্যবসা কেন্দ্রে নানা কাজে লোকজন আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা একাই আসেন। কাজের জন্য রাতে থাকতে হয়। তখনই প্রয়োজন হয় জৈবিক নিবৃত্তির। তখন তারা খোঁজ করে যৌনপল্লীর। যারা হোটেলে ওঠেন, তারা হোটেল মালিক বা ম্যানেজারের মাধ্যমে বন্দোবস্ত করে শয্যাসঙ্গিনীর। বন্দরে নৌ-যান ভিড়লে নাবিক-সহ অন্যান্য কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের যৌন উপবাস ভঙ্গ করার জন্য পতিতাপল্লীতে আসতেই হয়।

যে সব সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী পরিবার ছেড়ে দীর্ঘদিন কর্মস্থলে থাকেন, তাঁরাও নানা ভাবে উপপত্নী খুঁজে নেয়। অতীতে কলকাতা পুলিশে বাইরের প্রদেশের বা এ রাজ্যের দূর প্রান্তের যে সব ব্যক্তিরা কাজ করতেন, তাঁদের অনেকে কলকাতায় দ্বিতীয় বিবাহ করে নিতেন। কিন্তু সরকারি কর্মচারী হিসাবে দ্বিতীয় বিবাহ বৈধ হতো না। এজন্য অনেক আইনি ও পারিবারিক জটিলতার সৃষ্টি হতো। অনেকে এজন্য বিয়ে না করে কেবলমাত্র বাঁধা উপপত্নী রাখতেন।

অতীতে আমরা দেখেছি, যুদ্ধের সময় বা যুদ্ধের পর সেনারা নারী লুন্ঠন করছে, জোর করে নারী সম্ভোগ করছে। শান্তির সময় তো আর লুন্ঠনের সুযোগ নেই, এছাড়া জৈবিক চাহিদাও মেটাতে হবে, তাই সেনা ছাউনির কাছাকাছি যৌনপল্লীতে সেনাবাহিনী বা আধাসামরিক বাহিনীর কোনও কোনও জাওয়ান গমন করে। দূরপাল্লার লরির ড্রাইভারদেরও এই একই সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বাড়িতে পরিবার রেখে দীর্ঘদিন রাস্তায় থাকতে হয়। এই চালকদের অনেকে রাত্রে যেখানে বিশ্রাম নেয়, সেখানেই খোঁজ করে রমণীর। এই কারণে হাইরোডের ধারে ধাবা গুলিতে অবৈধ ভাবে গড়ে ওঠে ছোট ছোট গণিকালয়।

এই ধাবা বা ছোট হোটেলগুলিতে যেখানে লরি থামে, সেখানে চলে আসে গণিকারা অথবা ধাবা মালিক জোগাড় করে রাখে মহিলাদের। সেই সঙ্গে কিছু অপরাধীও জুটে যায়। যখন লরির চালক ব্যস্ত থাকে মহিলাকে নিয়ে, তখন সেই অপরাধীরা গাড়ি থেকে মাল নামিয়ে নেয়, তেল ট্যাঙ্কার থেকে তেল কেটে নেয়। এই সমস্যা আমি দেখেছিলাম রামপুরহাট থেকে মোরগ্রাম যাওয়ার জাতীয় সড়কের ধারে। আর ছিল বাঁকুড়া থেকে বড়জোড়া যাওয়ার রাস্তায়। এখানের এই ধরনের ধাবাগুলিতে দুর্গাপুর থেকে দেহপসারিনীরা আসতো। যাদের একটু বয়স বেশি হয়ে গিয়েছে কোঠাতে খরিদ্দারের সংখ্যা কম, তারা এই ধাবাতে চলে আসতো খদ্দের ধরতে। তাদের ওপর করুণা দেখাতে গেলে ‘রোড সাইড ক্রাইম’ বেড়ে যাবে; সে এক চরম বিড়ম্বনা।

হোটেলের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। হোটেলে দেহব্যবসা দু’ভাবে হয়। এক, হোটেলের গ্রাহক বা অতিথি সঙ্গে করে মহিলা নিয়ে আসেন। নিজের মতো সময় কাটিয়ে চলে যান। সেক্ষেত্রে হোটেল মালিকের কিছু বলার নাও থাকতে পারে। আবার অনেক সময় হোটেল থেকে মহিলা যোগান দেওয়া হয়। সে সব ক্ষেত্রে হোটেল মালিক বা হোটেল ম্যানেজার ‘নারীপাচার’-এর অপরাধ থেকে পার পেতে পারেন না। তীর্থস্থানে, পর্যটনস্থলে যে অসংখ্য হোটেল আছে, সেসব জায়গায় পর্যটকদের একটা অংশ যায় যৌন পর্যটনের জন্য। এটা দেশ ও বিদেশ দু’টো ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। হোটেলগুলির একাংশের প্রধান আয়ের উৎস এই যৌন পর্যটন।

এত কথা উপস্থাপন করার একটাই কারণ, অর্থনীতি কীভাবে গণিকাবৃত্তিকে উৎসাহিত করেছে, তা বোঝানোর চেষ্টা। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আমাদের দেশান্তরী হতে হয়। রুজি রুটির টানে পরিবার ছেড়ে পরবাসে আশ্রয় নিতে হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, নানা বৃত্তি আমাদের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ। এই অর্থব্যবস্থাই কিন্তু আমাদের নারী পাচারের পথ সুগম করেছে।

(ক্রমশ)