-কি রে এখানে বসে আছিস? সাজগোজ করিস নি? খদ্দের আসার তো সময় হয়ে গেল !

-না আমি সাজবো না। সাজবো না। ওরা বড়ো মারে আমাকে। খুব ব্যাথা হয় আমার।-সুজাতা রুক্মিনীর পায়ের কাছে বসে হাউহাউ করে কেঁদে দিলো। 

-তবে কি করবি তুই! জন্মেছিস যখন এখানে, তোকে তো এ কাজই করতে হবে। না করলে তো মাগী না খেয়ে মরবি! 

– এমনিও কি বেঁচে আছি নাকি?  

-ও সব কথা রাখ ! বিজ্ঞের মতো কথা বললে কারও ভাত জোটে না।খেয়ে বাঁচতে হবে তো। চল আমার সাথে। আজ তোকে আমি রেডি করে দিচ্ছি। শোন, বাঁচতে গেলে আমাদের শরীর বিক্রি করতে হবে, এছাড়া আর উপায় নেই ।যতদিন পারবি দেহটাকে বেচার চেষ্টা কর। যতদিন বেচতে পারবি ততদিনই তোর দাম।

সুজাতাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে গেল রুক্মিণী। 

রুক্মিণী বাঙালি নয়। আর ওর বাড়িটাও বাংলাতে নয়। ওকে নিয়ে আসা হয়েছিল বিহারের সীতামড়ি জেলার ভিট্টামোড় গ্রাম থেকে। সীতামড়ি জেলার নাম শোনেননি ? ওই যে যেখানে সীতামায়ের একমাত্র মন্দির আছে। তখন কতই বা বয়স হবে ওর? বড়ো জোর বারো কি তেরো! একদিন রাতে জোর করে তুলে নিয়ে এসে এই সোনাগাছির এক ঘরে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল রুক্মিণীকে। তারপর থেকে ও এখানে। আর সুজাতার জন্ম এই সোনাগাছিতেই(Sonagachi)। ওরই বা বয়স কত?  বড়জোর পনেরো। কিন্তু মন চায় না বেশ্যাবৃত্তি করতে। পড়াশুনা করতে চায়। তবু সুজাতাকে রোজ দেহ বেচতে হয়। ঘরের লোক বলতে একমাত্র মা। অসুস্থ। ও-ই একমাত্র রোজগেরে। দেহ বেঁচে সংসারের খাবার যোগায় সুজাতা। না শুধু নিজের সংসারের নয়। ওর টাকায় যে ভাগ আছে আরো অনেকের….বাবু আছে , ঘরভাড়া আছে , তারপর ওই পুলিশবাবু আসবেন, তাকেও দিতে হবে। 

পতিতাবৃত্তির ইতিহাস (History Of Prostitution)

এই কাহিনী শুধু সুজাতা কিংবা রুক্মিনীর নয়। হাজার হাজার মেয়ের। আর এই ঘটনা শুধু সোনাগাছিতেই নয়, ছড়িয়ে রয়েছে ভারতের অন্য শহরগুলিতেও। এই কাহিনী দিল্লির জিবি রোডের, মুম্বইয়ের কামাথিপুরার, বেনারসের শিবদাসপুরের, মীরগঞ্জ এলাহাবাদের। কিন্তু মজার কথা, এই মেয়েদের কাহিনীগুলি আলাদা আলাদা কিন্তু ভবিতব্য এক। এক নিষ্ঠুর অন্ধকার।

ভারতের বেশ্যাবৃত্তি সংগঠিত ভাবে শুরু হয়েছিল সেই ষোলোশো শতাব্দীতে। পর্তুগিজরা যখন ভারতে ঘাঁটি গেড়েছিল আর যৌনদাসী(Prostitute) হিসেবে ধরে নিয়ে এসেছিল জাপানি নারীদের, যারা তাদের শরীরের যৌনচাহিদা মেটাবে।পর্তুগিজরাই ভারতে পতিতালয়ের ভিত্তি স্থাপন করেছিল ওই মেয়েদের থাকার জন্য। কিন্তু আজ পতিতাবৃত্তির ব্যবসা শুধু সেই জায়গাগুলিতেই থেমে নেই। ছড়িয়ে গিয়েছে ভারতের কোনায় কোনায়। ২৮টি রাজ্যে আর  ৯টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে, শহরের প্রান্তে ,গলিতে ,পাড়ায় পাড়ায়। হয়তো রাত দশটার বনগাঁ লোকালে আপনি দেখছেন একটি মেয়ে একা চলেছে কলকাতার দিকে। সেজেগুজে। সে নামলো শিয়ালদহ স্টেশনে তারপর কোথায় হারিয়ে গেলো কেউ জানতে পারলো না। 

ভারতে পতিতাবৃত্তির পরিসংখ্যান (Statistics)

২০১৬ সালে এক গণনা বলছে, (UNAIDS) ভারতে ৬৫,৭৮২৯ জন মহিলা পতিতাবৃত্তি (Prostitution Business) পেশায় যুক্ত। সালটা তো ২০১৬! তার মানে কেটে গিয়েছে আরও ছয়-ছয়টি বছর। সংখ্যাটা নিশ্চিত ভাবে বেড়েছে। হয়তো কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। ‘নিউ ইয়র্ক পোস্ট’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মহিলা অধিকার রক্ষায় নিয়জিত আইনজীবী রঞ্জনা কুমারী বলছেন, এই এতো মেয়ের মধ্যে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ নিজের ইচ্ছায় এই পেশায় আসে। বাকিদের জোর করে নিয়ে আসা হয়। 

এবার  দেখা যাক, ভারতে কতটাকা লেনদেন হয় এই যৌন ব্যবসায় (Prostitution Business)? সমীক্ষা বলছে অঙ্কটা অকল্পনীয়! প্রতি বছর প্রায় ৮.২ বিলিয়ন ডলারের কালো টাকা আয় হয় এই ব্যবসা থেকে (হ্যাভোস্কোপ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সমীক্ষা)। এই অঙ্ক পৃথিবীতে যৌনব্যবসায় উপার্জনের নিরিখে সপ্তম। অথচ সে টাকায় ভারত সরকারের কোন ভাগ নেই। তবে কেউ কেউ কটাক্ষ করে বলেন, অধীনস্থ কোনও কোনও কর্মীর পকেটে টাকার অংশ নিশ্চয় যায়।ওই যে মেয়েটিকে নষ্ট মেয়ে বলেন, যে মেয়েটা নিজের দেহকে বিক্রি করে যৌনক্রিয়ার শেষে খদ্দেরের  থেকে টাকা নিয়ে তার ব্লাউজের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখলো। সেই সব টাকাটাই কি তার?  না! এতটা সরল নয়। ও টাকায় অনেক ভাগ। বাবু নেবে , হোটেলওয়ালা বা পতিতালয়ের মালিক নেবে, তারপরও তো আছেন অনেক উপরের বাবু, তারাও নেবেন। বাকি যে টাকা থাকবে সেটা তার। সেই টাকা হয়তো পুরোটাকার কিছু অংশ মাত্র। একদিকে নষ্ট মেয়ের বদনাম অন্যদিকে ঘরের মধ্যে অভাব সবটাই মেনে নিতে হয়। পেটের জ্বালা মানুষকে সবকিছু করিয়ে নেয়।

ভারতীয় পতিতাবৃত্তি আইন

যৌনকর্মী। খুব গর্ব করে বলার মতো বিষয় নয়।যেন তাদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু মিলেছে এটাই ঢের। যৌন ব্যবসা আইনত বৈধ! কিন্তু তারপর! যদি আইনকে পুরোপুরি মেনে  চলতে হয়, তাহলে ভারতে যৌন ব্যবসা অবৈধ। ব্যাপারটা একবার দেখা যাক। কী বলছে ভারতীয় আইন- Prostitution is legal in India. A number of related activities including soliciting, kerb crawling, owning or managing a brothel, prostitution in a hotel, child prostitution, pimping and pandering are illegal.দেখা যাক কী কী করা যাবে না যৌন ব্যবসা করতে গিয়ে? পতিতাবৃত্তির জন্য হোটেল বা পতিতালয় ব্যবহার করা চলবে না।  আবার  সোনাগাছি বা জি.বি রোডের মতো জায়গায় যে পতিতালয়গুলি রয়েছে, সেগুলি বৈধ না অবৈধ আইনে তা-ও বলা নেই।আইন বলছে, পতিতালয়গুলি চালানোটা দন্ডনীয় অপরাধ। একজন পতিতা নিজের বিজ্ঞাপন করতে পারবেন না বা  বিজ্ঞাপন করার জন্য কাউকে নিয়োগ করতে পারবেন না। কোনও ব্যক্তিও পতিতার কাছে গিয়ে যৌন চাহিদা মেটানোর কথা বলতে পারবেন না। এই যে করা যাবে নার তালিকা দেওয়া হলো তা বাদ দিয়ে আদৌ যৌন ব্যবসা চালানো সম্ভব?  তার মানে সরকার কি যৌনব্যবসাকে ঘুরিয়ে অবৈধ বলছে? প্রাচী দর্জি(Prachi Darji) তার Prostitution in India নিবন্ধে এই প্রশ্নই তুলে দিয়েছেন। আর যদি প্রাচী দর্জির প্রশ্নকে ধরে নেওয়া যায়, যদি সরকারি পরিকল্পনা এমনটি হয় যে তারা যৌন ব্যবসাকে বন্ধ করবেন সেই উদ্যোগ বা কোথায়?  নাকি পুরোটাই যেমন চলছে, চলুক। কারন উল্টো দিকে যৌন ব্যবসাকে স্বীকৃতি দিতে গেলে নিতে হবে অনেক দায়িত্ব, তৈরি করতে হবে এমন পরিকাঠামো, যে কাজ করতে হয়তো সরকার আগ্রহী নয়।  

ধরা যাক সরকার চাইছে যৌন ব্যবসাকে বন্ধ করতে। কি করতে হবে তাহলে? সোজা ও সাধারণ একটি কাজ রয়েছে,  যৌনকর্মীদের অন্য কোনও কাজে যুক্ত করতে হবে। কিন্তু যে দেশে বেকারত্ব চরমসীমায় বিশেষ করে গত  কয়েকবছরে হু হু করে বাড়ছে সেখানে যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন কতটা সম্ভব? যৌনকর্মীদের অনেক সংগঠন রয়েছে যারা চান পুনর্বাসন ও এই ব্যবসার সমাপ্তি। কিন্তু সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন এই ব্যবসাকে শেষ করা কি এতোই সোজা হবে?  

নিয়ন্ত্রণ – সুবিধা ও অসুবিধা

আর যদি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হয় ? পতিতাবৃত্তি বৈধ হলে (Legality of Prostitution), রাষ্ট্রকে পতিতালয় পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। যেমনটি রয়েছে জার্মানি কিংবা নেদারল্যান্ডের মতো বহু দেশে। সেক্ষেত্রে ব্যবসার জন্য যৌন কর্মীদের লাইসেন্স নিতে হবে। পতিতাদের বয়স, কারা তার মক্কেলের তার ডেটাবেস, তাদের পারিশ্রমিক এবং চিকিৎসা সুবিধা সংক্রান্ত নির্দেশিকা সরকারকে প্রণয়ন করতে হবে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে পতিতারা কিছু অধিকার অর্জন করতে পারবেন। যেমন চিকিৎসার অধিকার, সন্তানদের শিক্ষার অধিকার, শোষণ ও ধর্ষণের (Sex exploitation) বিরুদ্ধে অধিকার ইত্যাদি। আবার যেসব পতিতা তাঁদের জীবিকা হারিয়েছেন বা যারা পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হয়েছিলেন কিন্তু সেই জীবনধারা বদলাতে চান, তাঁদের জন্য অনত্র ঘর বসাতে হবে। এছাড়াও,সরকারকে এই পতিতাদের প্রশিক্ষণ এবং প্রাথমিক শিক্ষা দিতে হবে যাতে তাঁরা অর্থ উপার্জন ও জীবিকা নির্বাহের অন্যান্য উপায় খুঁজে পান। আর একটা বিষয়, পতিতাবৃত্তির ব্যবসা আজকের দিনে ভারতে সম্পূর্ণ কালো টাকার ব্যবসা। সরকার যদি এর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নেয়, তবে  রাজস্ব-উৎপাদনের একটি বড় সম্ভবনা থাকছে। 

এর উল্টো দিকও রয়েছে। যেমন,পতিতাবৃত্তির বৈধতাকে এই পেশার প্রচার হিসাবে ভুল ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এটি এক শ্রেণির লোকের জন্য সহজ অর্থের পথ প্রশস্ত করতে পারে ও আরও  বেশি নারীকে পতিতাবৃত্তিতে টেনে আনতে পারে । 

কিন্তু কিছু তো একটা করতে হবে। এই তো সেদিন গৌরীর মা গৌরীকে বাড়ি থেকে বের করে দিলো। কী সর্বনেশে রোগ নিয়ে এসেছে মেয়েটা! এডস ! কতবার বলি, ওরে তোর বাবুদের কন্ডোম ব্যবহার করতে বল। কিন্তু ও বলে, খদ্দের কন্ডোম ব্যবহার করতে চায় না। জোর করলে মারতে থাকে।হলো তো ! নিজেকে তো শেষ করলি সেই সাথে অভাবের সংসারের রোজগারটাও গেল।… এই কাহিনী একজন গৌরীর নয়, এ দেশে এই রকম ২১ লক্ষ গৌরী রয়েছে (২০১৯ সালের হিসেবে এডস সংক্রমণে ভারতের স্থান তৃতীয়)। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের একটি রিপোর্টে বলেছে, পতিতাবৃত্তি বৈধ ও নিয়ন্ত্রিত হলে এইচআইভি (HIV) সংক্রমণের হার নাটকীয় ভাবে কমে যাবে। তাদের গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, পতিতাবৃত্তিকে বৈধ ও নিয়ন্ত্রিত করা হলে এডস সংক্রমণ ৩৩ থেকে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।

আরও ভয়ঙ্কর একটি দিক হল, শেষ দশক থেকে ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে শিশু পাচার ও তাদের জোর করে যৌন ব্যবসায় নামানো বিরাট ভাবে বেড়ে গিয়েছে। এই বিষয়ে ভারত, সেক্স টুরিস্ট হাব ফিলিপিন্স বা থাইল্যান্ডকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা নেপালের। সেখানে নারী ও শিশু  পাচারের(Sex Trafficking) সংখ্যা এতই বেড়ে গিয়েছে যে সরকারকে গ্রামে গ্রামে  জায়গায় জায়গায় হোর্ডিং লাগিয়ে প্রচার করতে হচ্ছে, আপনারা দালালের কাছে আপনাদের মেয়েকে বিক্রি করবেন না। ছোট ছোট নেপালি মেয়েদের নেপাল বিহার বর্ডার দিয়ে প্রতিনিয়ত নিয়ে আসা হচ্ছে কলকাতা,মুম্বই, দিল্লি বা জয়পুরে। বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে তাদের। শুধু নেপাল নয়, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এমন ঘটনার খবর মিলবে। 

এখনও কি চুপ করে বসে থাকার  সময় আছে? সময় এসেছে, যৌনকর্মীদের ডেটাবেস তৈরি করার ও রেজিস্ট্রেশন করানোর। অন্তত সেই ডেটাবেস থেকে তো  চিহ্নিত করা যাবে কারা যৌন পেশায় রয়েছেন আর  তাঁদের সঠিক বয়স কত। তারা শিশু যৌন(Child Prostitute) কর্মী কিনা? আর তারা কোথাকার বাসিন্দা ?