যেন রূপকথার গল্প। দারিদ্র ও অপমানে আত্মহত্যা করতে চাওয়া একটি মেয়ে আজ ৭০০ কোটি টাকার কোম্পানির মালিক। 

এক দিকে চরম দারিদ্র অন্যদিকে স্বামী পরিত্যাগ করে বাপের বাড়ি ফিরে আসা মেয়েটি প্রতিবেশীদের কু-কথা সহ্য না করতে পেরে একদিন খেয়ে ফেলেছিল তিন বোতল ইঁদুরের বিষ। কেউ ভাবেনি বেঁচে ফিরতে সে। কিন্তু ফিনিক্স পাখির মতো ছাইয়ের গাদা থেকে জেগে উঠলো মেয়েটি। আজ সে ছ’টি সংস্থার মালিক যার বাজার মূল্য  প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এই রূপকথার গল্প ভারতের দলিত কন্যা কল্পনা সরোজের।

জীবনের বিষ

কল্পনা মহারাষ্ট্রের বিদর্ভে একটি দলিত পরিবারে জন্মেছেন। বাবা পুলিশ কনস্টেবল। কল্পনা ও তাঁর দুই  বোন এবং দুই ভাই থাকতেন পুলিশ কোয়ার্টারে। কিন্তু দলিত হওয়ার জন্য ছোটবেলা থেকেই কল্পনাকে প্রচুর অপমান সহ্য করতে হয়েছে। কল্পনা একজন মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। কিন্তু স্কুলে পাঠ্য বহির্ভূত কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারতেন না তিনি। অনেক শিশুর বাবা-মায়েরা আবার কল্পনার সঙ্গে তাঁদের সন্তানদের মিশতে দিতেন না। ক্লাসের এক কোণে বসে থাকতো মেয়েটি।

মাত্র বারো বছর বয়সেই কল্পনার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল মুম্বইয়ের এক বস্তিবাসী একটি ছেলের সঙ্গে। অভিযোগ, শ্বশুরবাড়িতে কল্পনাকে দাসীর মতো আচরণ করা হতো। নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হতো কল্পনাকে। বিয়ের ছ’মাস পর কল্পনার বাবা গেলেন মেয়েকে দেখতে। কিন্তু চেহারা দেখে মেয়েকে চিনতে পারছিলেন না। একেবারে কঙ্কালসার চেহারা হয়েছে মেয়েটার। তিনি আর দেরি করলেন না। তৎক্ষণাৎ মেয়েকে নিয়ে এলেন বাড়িতে। কিন্তু বাড়ি ফিরে আরও বিড়ম্বনা। মেয়ের কোনও দোষ না থাকলে বাবা মেয়েকে নিয়ে চলে এলেন কেন? শুরু হল সমাজের গঞ্জনা। কেউ ভাল চোখে দেখলো না কল্পনাকে। একদিকে দারিদ্র তার উপরে নিত্য অপমান। সহ্য করতে না পেরে নিজের জীবনটাকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন কল্পনা। একদিন তিন বোতল ইঁদুরের বিষ খেয়ে নিলেন। কল্পনাকে বিষ খেতে দেখে দৌড়ে এলেন তাঁর এক আত্মীয়া। তাড়াহুড়ো করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল স্থানীয় হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে ফিরলেন কল্পনা। পেলেন দ্বিতীয় জীবন। আর ওই ঘটনার পর থেকে নিজের জীবনকে একেবারে বদলে ফেললেন তিনি। আর কোনও কিছুকে ভয় নয়। অপমান গায়ে মাখা চলবে না। কিছু করে দেখাতে হবে। মনটাকে শক্ত  করলেন কল্পনা। না, এ বার ঘুরে দাঁড়াতে হবে। 

স্বপ্নের উড়ান

কল্পনা মামার পরিবারের সঙ্গে মুম্বইয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে পোশাক কারখানায় সহকারী দর্জির চাকরি শুরু করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই একজন দক্ষ দর্জি হয়ে ওঠেন। তাঁর কাজে খুশি হয়ে বেতন বাড়িয়ে দেন কারখানার মালিক। পরিস্থিতি একটু একটু করে ভাল হতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেই সময়েই জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ। পয়সার অভাবে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় কল্পনার ছোট বোনের। আর সেটাই হয়ে ওঠে কল্পনার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। অর্থ লাগবে। কল্পনা ভাবেন, দর্জির কাজ করে কত টাকা পাওয়া যাবে! না, আর চাকরি নয়, ব্যবসা করতে হবে। নিজের ব্যবসা। কল্পনা একদিন দলিতদের অবস্থার উন্নতিতে সরকারি প্রকল্পের কথা জানতে পারে। তিনি ঋণের জন্য আবেদন করেন। ৫০,০০০ টাকা ঋণও মিলে যায়। সেই টাকা দিয়ে বাড়িতে কয়েকটি সেলাই মেশিন নিয়ে আসেন। শুরু করে দেন জামাকাপড় বানানোর কাজ। সেই সময় এক একদিনে প্রায় ১৬ ঘণ্টাও কাজ করতেন কল্পনা। অল্প সময়ের মধ্যেই চাকা  ঘুরতে শুরু করে। টেলারিং-এর ব্যবসার লাভ দিয়ে শুরু করেন ফার্নিচারের ব্যবসা।  

একদিন পরিচিত একজন কল্পনার কাছে এলেন একটি জমির খবর নিয়ে। জমিটি আইনি জটিলতায় জড়িয়ে রয়েছে। খুব কম দামে জমিটি বিক্রি হবে মাত্র আড়াই লক্ষ টাকায়। কোনো দিকে না তাকিয়ে কল্পনা সেই  জমিটি কিনে নেওবার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর জমির সমস্ত আইনি জটিলতা কাটিয়ে শুরু করেন আবাসনের ব্যবসা। উত্তরণ শুরু হয় কল্পনা সরোজের। 

এরপর তিনি দায়িত্ব নেন কামানি টিউব কোম্পানির। একরকম বাধ্য হয়েই। আজ কামানি টিউব ভারতের একটি নামকরা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু একদিন সংস্থাটি ছিল ঋণে জর্জরিত। কোম্পানিকে চালানো যাচ্ছে না। সেই সময় ওই সংস্থার কয়েকজন কল্পনার কাছে আসেন। তাঁকে অনুরোধ করেন, আপনি এই কোম্পানির হাল ধরুন। টেকওভার করুন কোম্পানিটিকে। কল্পনা ওই কোম্পানির দায়িত্ব নিয়ে প্রথমে একটি দশ সদস্যের দল গঠন করেন। তারপর ধীরে ধীরে বদলে ফেলেন কোম্পনির পরিচালন পদ্ধতি। লাভের মুখ দেখতে শুরু করে কামানি।

কল্পনা সরোজ আজ কামানি টিউব-সহ  ছ’টি কোম্পানির মালিক। মূলধন ৭০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেছে। ‘স্বপ্ন শুধু রাতে ঘুমিয়ে দেখার জন্য নয়। বরং স্বপ্ন হল সেটাই, যা ঘুমোতে দেয় না।’ কল্পনা সরোজ তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।