সারাদিন মানে সেই সকাল ছ’টা থেকে আমি পরিশ্রম করি। আমি একজন দায়িত্ববান স্বামী— দিনের শেষে তোমার কাছে ওইটুকু চাই। আমি তো তোমাকে ভালবাসতে চাই, তোমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে চাই। আর হ্যাঁ, সেটা তুমি না চাইলেও… আমি জোর করে নেব। কারণ, এটা আমার অধিকার আর তোমার দায়িত্ব। একজন বেশ্যার অধিকার আছে ‘না’ বলার কিন্তু তোমার নেই। কারণ, বৈবাহিক ধর্ষণ বা ম্যারিটাল রেপ (Marital Rape ) ভারতে অপরাধ নয়।

না, দুঃখিত— একটু ভুল আছে কথাটায়। ভারতে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবেও গণ্য করা হয়েছে। Exception 2 to Section 375 of the Indian Penal Code, 1860 (IPC) বলছে, কোনও ব্যক্তি যদি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেন সেটি ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে। যদি সেই স্ত্রী-র বয়স ১৫-র নীচে হয়। সেক্ষেত্রে স্ত্রী-র সম্মতি থাকলেও সেটা ধর্ষণ।

সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে

ব্যাপারটা নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলবেন না। ভারতের মেয়েদের আইনত বিয়ের বয়স ১৮। একে বাড়িয়ে ২১ করার জন্য নতুন বিলও এসে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াচ্ছে যে ১৫ বছরের বেশি বয়সি কোনও মহিলার স্বামীকে বৈবাহিক ধর্ষণের জন্য দায়ী করা যাবে না। ঘুরিয়ে বললে, একটাই কথা মেনে নিতে হয়—  ভারতে বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনও আইন নেই। যেটা আছে, তা হল, Section 498A IPC যা দিয়ে পারিবারিক হিংসার জন্য স্বামীর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জানানো যাবে।

কিছুদিন আগে ছত্তিশগড় হাই কোর্ট একজন স্বামীকে অপরাধমুক্ত ঘোষণা করেছে। কারণ, যৌন সম্পর্ক করার জন্য স্ত্রী-র অনুমতির প্রয়োজন নেই। স্বামী একজন স্ত্রীকে যৌন সম্পর্ক করতে বাধ্য করতেই পারেন, বলপ্রয়োগ করতেই পারেন! স্বামীর-স্ত্রী মধ্যে যৌন সম্পর্ক জোর করে হলেও সেটা ধর্ষণ নয়। ভারত হল দুনিয়ার সেই ৫৫টি দেশের মধ্যে একটি, যেখানে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কিন্তু পাশের দেশ নেপাল, ভুটানে বৈবাহিক ধর্ষণ একটি অপরাধ।

২০১৭ সালের ২৯ অগস্ট কেন্দ্রীয় সরকার দিল্লি হাই কোর্টে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছিল, স্বামী যদি স্ত্রীকে তাঁর সম্মতির বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করেন, তবুও তাকে ধর্ষণের মতো অপরাধ বলে চিহ্নিত করা উচিত নয়। কেন্দ্রের যুক্তি, এমন হলে বিয়ে নামের পবিত্র প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা তৈরি হবে। বিশিষ্ট আইনজীবী স্বরাজ কৌশল যুক্তি দিয়েছেন, বৈবাহিক ধর্ষণ বলে কিছু হয় না। আমরা আমাদের ঘরগুলিকে পুলিশ স্টেশন বানাতে পারি না। সেটা করলে বেশির ভাগ স্বামীকেই ঘরের থেকে জেলে বেশি সময় কাটাতে হবে।

কেন্দ্রের মহিলা ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের প্রাক্তন মন্ত্রী মেনকা গান্ধী আবার বিষয়টিকে নিয়ে নিজের অবস্থান বদলে ফেলেছেন। ইউপিএ জমানায় তিনি বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসাবে দেখার পক্ষে ছিলেন। পরে মত পাল্টে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে গোটা দুনিয়ার থেকে ভারতকে আলাদা ভাবে বিচার করতে হবে। কারণ, ভারতে এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য, সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ ,ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিয়ে সম্পর্কে সমাজের পবিত্র ধারণা…। বৈবাহিক ধর্ষণ আইন হলে এই বিষয়গুলিতে আঘাত আসবে। ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদের পর্যবেক্ষণ— স্বামী যতই নৃশংস হোক…যখন দু’জন মানুষ স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করেন…তাঁদের মধ্যে যৌন মিলনকে কি ধর্ষণ বলা যায়? 

তবে বৈবাহিক ধর্ষণ আজকের দিনে ভারতের কত বড় সমস্যা, সেটা একবার দেখা যাক। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর রিসার্চ অন উওমেন (ICWR) এবং ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড (UNFPA)  ২০১৪ সালে ভারতের ৮টি রাজ্যে একটি সমীক্ষা করেছিল। তাতে দেখা যায়, এই রাজ্যগুলির এক-তৃতীয়াংশ পুরুষ স্ত্রী-র সঙ্গে জোর জবরদস্তি করেন ও যৌন মিলন করতে বাধ্য করেন। ভারতে ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভেও জানাচ্ছে, বিয়ের পর বেশির ভাগ মেয়ের উপরেই যৌন অত্যাচার হয়।

নির্ভয়ার মৃত্যুর পরে বিচারপতি জে এস ভার্মার নেতৃত্বে যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তারা Section 375 এর ব্যতিক্রমটি তুলে দিতে বলেছিলেন। বিচারপতি ভার্মা বলেছেন, নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতা অর্জনের জন্য অবশ্যই ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের যৌথ প্রচেষ্টা জরুরি । কিন্তু তাঁর সুপারিশকে গ্রাহ্য করা হয়নি।

তবে দিল্লি হাই কোর্টে রিট ফাউন্ডেশন ও সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি আর্জি জানিয়ে বলেছে, বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা হোক। আবেদনকারীদের যুক্তি, ভারতের ৩১ শতাংশ বিবাহিত মহিলা, যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে তাঁরা বর্তমান স্বামীকে অপরাধী হিসাবে উল্লেখ করেছেন। আইনের অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, শুধু বিবাহিত হবার জন্য কোনও মহিলার সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলি খর্ব করা যায় না।

এই বিতর্কের মধ্যেই কেরল হাই কোর্ট বলেছে, বৈবাহিক ধর্ষণ শারীরিক ও মানসিক হিংস্রতার নমুনা এবং একে বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্র হিসাবে দেখা যেতেই পারে। ওই মামলায় আদালতে স্ত্রী-র পক্ষে জানানো হয়েছিল, তিনি অসুস্থ থাকলেও তাঁর স্বামী জোর করে যৌনমিলনে বাধ্য করতেন। ইচ্ছার বিরুদ্ধেও তাঁর সঙ্গে বিকৃত ও অপ্রাকৃতিক যৌন সম্পর্ক (unnatural sex) স্থাপন করতেন। এমনকি, মায়ের মৃত্যুর দিনেও ছেলে জোর করে যৌনসম্পর্ক করেছেন। কন্যা সন্তানের সামনেও স্ত্রীকে যৌন মিলনের জন্য জোর করতেন স্বামী।

বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে কর্নাটক হাই কোর্টের সাম্প্রতিক রায় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। গত ২৩ মার্চ কর্নাটক হাই কোর্ট এক মহিলার আবেদনে সাড়া দিয়ে বলেছে,  ওই মহিলার স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের আইন প্রযোজ্য হোক। হাই কোর্ট বলেছে, বিয়ের প্রতিষ্ঠান পুরুষদের বন্যজন্তুর মতো আচরণের বিশেষ অধিকার দেয় না। কোনও আচরণ পুরুষের ক্ষেত্রে যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়, তা হলে সেই পুরুষ স্বামী হলেও তার শাস্তি হওয়া উচিত। আদালত বলেছে, ধর্ষণ ধর্ষণই। স্বামীর দ্বারা হলেও সেটা ধর্ষণই হয়।