গৃহস্থ ও তমোগুণ 

শ্রীরামকৃষ্ণ- লোকের সঙ্গে বাস করতে গেলেই দুষ্ট লোকের হাত থেকে আপনাকে রক্ষা করবার জন্য একটু তমোগুণ দেখান দরকার! কিন্তু সে অনিষ্ট করবে বলে, উল্টে তার অনিষ্ট করা উচিত নয়।

“এক মাঠে এক রাখাল গরু চরাতো। সেই মাঠে একটা ভয়ানক বিষাক্ত সাপ ছিল। সকলেই সেই সাপের ভয়ে অত্যন্ত সাবধানে থাকতো। একদিন একটি ব্রহ্মচারী সেই মাঠের পথ দিয়ে আসছিল। রাখালেরা দৌড়ে এসে বললে, “ঠাকুর মহাশয়! ওদিক দিয়ে যাবেন না। ওদিকে একটা ভয়ানক বিষাক্ত সাপ আছে। ব্রহ্মচারী বললে, “বাবা, তা হোক; আমার তাতে ভয় নাই, আমি মন্ত্র জানি। এই কথা বলে ব্রহ্মচারী সেই দিকে চলে গেল। রাখালেরা ভয়ে কেউ সঙ্গে গেল না। এদিকে সাপটা ফণা তুলে দৌড়ে আসছে, কিন্তু কাছে না আসতে আসতে ব্রহ্মচারী যেই একটি মন্ত্র পড়লে, অমনি সাপটা কেঁচোর মতন পায়ের কাছে পড়ে রইল। ব্রহ্মচারী বললে, “ওরে, তুই কেন পরের হিংসা করে বেড়াস; আয় তোকে মন্ত্র দিব। এই মন্ত্র জপলে তোর ভগবানে ভক্তি হবে, ভগবান লাভ হবে, আর হিংসা প্রবত্তি থাকতে না। এই বলে সে সাপকে মন্ত্র দিল। সাপটা মন্ত্র পেয়ে গুরুকে প্রণাম করলে আর জিজ্ঞাসা করলে, ‘‘ঠাকুর, কি করে সাধনা করব, বলুন।’’ গুরু বললেন, ‘‘এই মন্ত্র জপ কর, আর কারও হিংসা করিস না।’ ব্রহ্মচারী যাবার সময় বললে, “আমি আবার আসবো।’’ এইরকম কিছুদিন যায়। রাখালেরা দেখে যে সাপটা আর কামড়াতে আসে না। ঢ্যালা মারে তবুও রাগ হয় না, যেমন কেঁচোর মতন হয়ে গেছে। একদিন একজন রাখাল কাছে গিয়ে ল্যাজ ধরে খুব ঘুরপাক দিয়ে তাকে আছড়ে ফেলে দিল। সাপটার মুখ দিয়ে রক্ত উঠতে লাগলো, আর সে অচেতন হয়ে পড়লো। নড়ে না, চড়ে না। রাখালেরা মনে করলে যে সাপটা মরে গেছে। এই মনে করে তারা সব চলে গেল।

“অনেক রাত্রে সাপের চেতনা হলো। সে আস্তে আস্তে অতি কষ্টে তার গর্তের ভিতর চলে গেল। শরীর চুর্ণ-নড়বার শক্তি নেই। অনেকদিন পরে যখন অস্থিচর্মসার তখন বাহিরে আহারের চেষ্টায় রাত্রে এক একবার চরতে আসতো; ভয়ে দিনের বেলা আসতো না , মন্ত্র লওয়া অবধি আর হিংসা করে না। মাটি, পাতা, গাছ থেকে পড়ে গেছে এমন ফল খেয়ে প্রাণধারণ করতো।’’

“প্রায় এক বৎসর পরে ব্রহ্মচারী সেই পথে আবার এলো। এসেই সাপের সন্ধান করলে। রাখালেরা বললে, সে সাপটা মরে গেছে। ব্রহ্মচারীর কিন্তু ওকথা বিশ্বাস হলো না! সে জানে, যে মন্ত্র ও নিয়েছে তা সাধন না হলে দেহত্যাগ হবে না। খুঁজে খুঁজে সেইদিকে তার দেওয়া নাম ধরে ডাকতে লাগলো। সে গুরুদেবের আওয়াজ শুনে গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো ও খুব ভক্তিভরে প্রণাম করলে। ব্রহ্মচারী জিজ্ঞাসা করলে, ‘তুই কেমন আছিস? সে বললে, “আজ্ঞে ভাল আছি। ব্রহ্মচারী বললে, তবে তুই এত রোগা হয়ে গিছিস কেন?’ সাপ বললে, “ঠাকুর আপনি আদেশ করেছেন— কারও হিংসা ক’রো না। তাই পাতাটা ফলটা খাই বলে বোধ হয় রোগা হয়ে গিছি!” ওর সত্ত্বগুণ হয়েছে কি, তাই কারু উপর ক্রোধ নাই। সে ভুলেই গিছলো যে রাখালেরা মেরে ফেলবার যোগাড় করেছিল! ব্রহ্মচারী বললে, ‘শুধু না খাওয়ার দরুন এরূপ অবস্থা হয় না, অবশ্য আরো কারণ আছে, ভেবে দেখ। সাপটার মনে পড়লো যে রাখালেরা আছাড় মেরেছিল। তখন সে বললে, ঠাকুর মনে পড়েছে বটে, রাখালেরা একদিন আছাড় মেরেছিল। তারা অজ্ঞান, জানে না যে আমার মনের কি অবস্থা; আমি যে কাহাকেও কামড়াব না বা কোনরূপ অনিষ্ট করবো না, কেমন করে জানবে? ব্রহ্মচারী বললে, ছি! তুই এতো বোকা আপনাকে রক্ষা করতে জানিস না; আমি কামড়াতেই বারণ করেছি, ফোঁস করতে নয়! ফোঁস করে তাদের ভয় দেখাস নাই কেন?

“দুস্টু লোকের কাছে ফোঁস করতে হয়, তাদের ভয় দেখাতে হয়, পাছে অনিষ্ট করে তাদের গায়ে বিষ ঢালতে নাই, অনিষ্ট করতে নাই।