কল্পতরু রামকৃষ্ণ

প্রতিমা সাহা

গলায় বাসা বেধেছে ক্যান্সার। শরীর ভেঙে পড়েছে। চিকিৎসার জন্য দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে প্রথমে উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর বাটী, তারপর কাশীপুর উদ্যানবাটীতে বসবাস শুরু করেছেন রামকৃষ্ণ (Ramakrishna)। কলকাতার জনকোলাহল থেকে দূরে, প্রায় চোদ্দ বিঘা জমির উপর অবস্থিত কাশীপুরের এই বাগানবাড়িটি শ্যামপুকুর বাটীর থেকে অনেক প্রশস্ত, নির্জন। দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ির মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখানে নেই ঠিকই। তবে চারমাস কলকাতা বাসের পর কাশীপুরের বাড়িটিতে এসে অনেকটাই স্বস্তি মিলেছে রামকৃষ্ণের।

দোতলা বাড়ি। উপরের একটি ঘরে থাকেন তিনি। ঘরটির দক্ষিণে ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে বাগানের সৌন্দর্য অনুভব করেন রামকৃষ্ণ (Ramakrishna)। সঙ্গে এসেছেন সারদা দেবী আর যুবক ভক্তের দল। এসেছেন নরেন্দ্রনাথও। আইন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নরেন্দ্র। কলকাতায় থাকাটা জরুরি ছিল। কিন্তু রামকৃষ্ণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন ভেবে কাশীপুরে এসে পৌঁছেছেন তিনি। আর বাগানবাড়িতে এসেই রামকৃষ্ণ ও অন্যদের থাকার বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন।

কাশীপুরের বাগানবাড়ির মাসিক ভাড়া ৮০ টাকা। সেই সময়ের হিসেবে অঙ্কটা অনেক। কী ভাবে এত টাকা জোগাড় হবে, তা নিয়ে ভাবতে বসেছেন ছাপোষা ভক্তরা। শেষ পর্যন্ত জটিলতার সমাধান করতে নিজেই উদ্যোগী হয়ে উঠলেন রামকৃষ্ণ (Ramakrishna)। তাঁর পরম ভক্ত, ডষ্ট কোম্পানির মুৎসুদ্দি সুরেন্দ্রনাথকে কাছে ডেকে বললেন, ‘‘দেখ সুরেন্দর, এরা সব কেরানী-মেরানী ছাপোষা লোক। এরা অত টাকা চাঁদা তুলিতে কেমন করিয়া পারিবে, অতএব ভাড়ার টাকাটা সব তুমিই দিও।’’ সুরেন্দ্রনাথও করজোড়ে ‘যাহা আজ্ঞা’ বলে ভাড়ার টাকা দিতে সম্মত হয়ে গিয়েছেন। আর বাগানবাড়ির ভাড়া নিয়ে জটিলতা যখন মিটে গিয়েছে, তখন আর সমস্যা কোথায়? ক্রমে ক্রমে সব বিষয়েই সুবন্দোবস্ত হতে লাগল। আর রামকৃষ্ণের সেবার সময় ছাড়া বাকি সময়টা নরেন্দ্রনাথ যুবক ভক্তদের নিয়ে ধ্যান, ভজন, পড়াশোনা, আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। একদিকে রামকৃষ্ণের প্রতি প্রবল আকর্ষণ, অন্যদিকে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গ — গভীর আনন্দে দিন কাটতে লাগল ডজনখানেক যুবক ভক্তের।

কাশীপুরে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই রামকৃষ্ণ (Ramakrishna) একদিন উপরের ঘর থেকে নীচে নেমে বাড়ির বাইরের বাগানে কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করেছিলেন। ভক্তরা ভেবেছিলেন, রোজ এ ভাবে করলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন তিনি। কিন্তু বাইরের ঠান্ডা হাওয়ায় দুর্বল বোধ করলেন রামকৃষ্ণ। নীচে নেমে হাঁটাহাটি করার চেষ্টা থেকে বিরত রইলেন। তবে দুর্বলতা না কাটায় ডাক্তারেরা তাঁকে কচি পাঁঠার মাংস খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। পথ্যের জন্য মাংস আনতে আর রামকৃষ্ণের শারীরিক অবস্থার কথা জানাতে যুবক ভক্তদের রোজই কলকাতায় ছুটতে হতো। তবে খাবারের সঙ্গে পাঁঠার মাংস যোগ হওয়ায় রামকৃষ্ণের শারীরিক দুর্বলতা অনেকটা কেটে গেল। একদিন কাশীপুরে এসে সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারও বিষয়টি দেখে আনন্দিত হলেন।

গৃহী ও ব্রহ্মচারী ভক্তরা গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে একযোগে সেবা করছিলেন ঠিকই। কিন্তু রামকৃষ্ণের সার্বিক শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেকটাই উদ্বিগ্ন ছিলেন নরেন্দ্রনাথ। একদিন বেশি রাতে ঘুমহীন চোখে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি। দু-একজন যুবক তখনও জেগে আছেন দেখে নরেন্দ্র বললেন, ‘‘চল্, বাহিরে উদ্যানপথে পদচারণা ও তামাকু সেবন করি।’’ পৌষের রাতে বাগানের পথে বেড়াতে বেড়াতে সঙ্গীদের তিনি বললেন, ‘‘ঠাকুরের যে ভীষণ ব্যাধি, তিনি দেহরক্ষার সংকল্প করিয়াছেন কি না, কে বলিতে পারে? সময় থাকিতে তাঁহার সেবা ও ধ্যান-ভজন করিয়া যে যতটা পারিস আধ্যাত্মিক উন্নতি করিয়া নে, নতুবা তিনি সরিয়া যাইলে পশ্চাত্তাপের অবধি থাকিবে না।’’

এ ভাবেই কাটছিল রামকৃষ্ণ ও তাঁর ভক্তদের জীবন। একদিন কিছুক্ষণের জন্য বাগানে হাঁটার পর থেকে কাশীপুরের বাগানবাড়ির দোতলার ঘরে নিজেকে বন্দি করেই রেখেছিলেন রামকৃষ্ণ। দিন পনেরোর মধ্যে তাঁর চিকিৎসকেরও পরিবর্তন হয়েছিল। মহেন্দ্রলাল সরকারের সঙ্গে মিলে রামকৃষ্ণকে সুস্থ করতে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার রাজেন্দ্রনাথ দত্ত। কাশীপুরের বাগানবাড়িতে এসে রাজেন্দ্রনাথও দেখে গেলেন রামকৃষ্ণকে। হোমিওপ্যাথ ওষুধ দিলেন তিনি। আগের তুলনায় অনেকটাই সুস্থ বোধ করলেন রামকৃষ্ণ। ভক্তেরাও ভাবছিলেন, তিনি বোধহয় আগের মতোই সুস্থ, সবল হয়ে উঠবেন।

কাশীপুর উদ্যানবাটী

আর এই সময়েই ঘটে গেল ঘটনাটা। ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি। কিছুটা সুস্থ বোধ করায় রামকৃষ্ণ (Ramakrishna) ঠিক করলেন, বাগানবাড়ির রাস্তায় আবার বেড়াবেন তিনি। ইংরেজি নববর্ষের দিনটিতে কাশীপুরের বাগানবাড়িতে একে একে আসতে শুরু করেছেন গৃহী ভক্তরা। বাগানের গাছগুলির নীচে আর ঘরের ভিতরে প্রায় জনা তিরিশেক লোক উপস্থিত রয়েছে। দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। ভক্তরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছেন। এমন সময় তিনটে নাগাদ উপরের ঘর থেকে নীচে নেমে এলেন রামকৃষ্ণ। তাঁকে দেখেই ভক্তদের মধ্যে আবেগ সঞ্চারিত হল। উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম করলেন তাঁরা। নীচের হলঘরের পশ্চিমের দরজা দিয়ে বাগানে নেমে পড়লেন রামকৃষ্ণ। তারপর এগিয়ে চললেন ডানদিকের ফটকের দিকে। ঘর থেকে বেরিয়ে ভক্তরা কিছুটা দূর থেকে তাঁকে অনুসরণ করতে লাগলেন। বসতবাটী ও ফটকের মাঝখানে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছেন নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও অন্য কয়েকজন ভক্ত। তাঁদের দেখতে পেলেন রামকৃষ্ণ। তাঁরাও হঠাৎ রামকৃষ্ণকে দেখতে পেয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছেন।

কেউ কোনও কথা বলার আগেই গিরিশচন্দ্রকে সম্বোধন করে রামকৃষ্ণ বললেন, ‘‘গিরিশ, তুমি যে সকলকে এত কথা (আমার অবতারত্ব সম্বন্ধে) বলিয়া বেড়াও, তুমি (আমার সম্বন্ধে) কী দেখিয়াছ ও বুঝিয়াছ?’’ বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না গিরিশচন্দ্র। রামকৃষ্ণের পায়ের নীচে বসে পড়ে তিনি বললেন, ‘‘ব্যাস-বাল্মিকী যাঁহার ইয়ত্তা করিতে পারেন নাই, আমি তাঁহার সম্বন্ধে অধিক কী আর বলিতে পারি!’’ তাঁর প্রতি গিরিশের এই বিশ্বাস দেখে মুগ্ধ হলেন রামকৃষ্ণ। তাঁকে এবং সমবেত ভক্তদের উপলক্ষ করে বললেন, ‘‘তোমাদের আর কী বলিব, আশীর্বাদ করি, তোমাদের চৈতন্য হউক!’’

রামকৃষ্ণের এই কথা শুনে এবং তাঁদের প্রতি প্রেম ও আশীর্বাদ অনুভব করে আত্মহারা হয়ে উঠলেন ভক্তরা। সেই দিন ঠিক কী হয়েছিল, পরে তার বর্ণনা দিয়েছিলেন স্বামী সারদানন্দ। তিনি নিজে ওই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। ‘শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’ বইটিতে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম সম্পাদক সারদানন্দ লিখেছেন— উদ্বেলিত ভক্তেরা আশপাশের অবস্থার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁরা ঠিক করেছিলেন, রামকৃষ্ণের ব্যাধি আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে ছুঁতে যাবেন না। কিন্তু নিজেদের সেই প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গেলেন তাঁরা এবং ভাবতে লাগলেন, তাঁদের দুঃখে ব্যথিত হয়ে কোনও অপূর্ব দেবতা তাঁর হৃদয়ের করুণা নিয়ে মায়ের মতো তাঁদের স্নেহের আশ্রয় দান করছেন। ফলে রামকৃষ্ণকে প্রণাম করতে ও পায়ের ধুলো নিতে ব্যাকুল হয়ে পড়লেন ভক্তরা। জয়রবে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠতে লাগল। ভাবে বিভোর রামকৃষ্ণও প্রত্যেককে স্পর্শ করতে লাগলেন। যা ভক্তদের আরও উদ্বেলিত করে তুলল। তাঁদের মনে হল, রামকৃষ্ণ তাঁর দেবত্বের কথা আর অপ্রকাশিত রাখবেন না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো রামকৃষ্ণকে দেখতে লাগলেন তাঁরা। ঘরের ভিতরে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ডেকে আনার জন্য অনেকে চিৎকার শুরু করলেন। কেউ কেউ ফুল ছিড়ে রামকৃষ্ণের গায়ে ছুড়ে দিতে লাগলেন। কিছুক্ষণ এই অবস্থা চলার পর রামকষ্ণকে শান্ত হতে দেখে ভক্তরাও প্রকৃতস্থ হলেন। আর তার পরেই বাগান ছেড়ে উপরের তলায় উঠে গেলেন রামকৃষ্ণ।

পয়লা জানুয়ারির এই ঘটনা নিয়ে রামকৃষ্ণের শিষ্য রামচন্দ্র দত্ত ব্যাখ্যা দেন, রামকৃষ্ণ সেদিন পুরাণে বর্ণিত কল্পতরুতে পরিণত হয়েছিলেন। রামচন্দ্র নিজে ওই দিন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ওই দিনটির নাম দেন ‘কল্পতরু দিবস’। পরে যা ‘কল্পতরু দিবস’ হিসেবে পালিত হতে শুরু করে। তবে সেদিন সেখানে উপস্থিত আর এক ভক্ত সারদানন্দ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘‘… রামচন্দ্র প্রমুখ কোন কোন ভক্ত অদ্যকার এই ঘটনাটিকে ঠাকুরের ‘কল্পতরু’ হওয়া বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। কিন্তু আমাদিগের বোধ হয়, উহাকে ঠাকুরের অভয়-প্রকাশ অথবা আত্ম-প্রকাশপূর্ব্বক সকলকে অভয়-প্রদান বলিয়া অভিহিত করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। প্রসিদ্ধি আছে, ভাল বা মন্দ যে যাহা প্রার্থনা করে কল্পতরু তাহাকে তাহাই প্রদান করে। কিন্তু ঠাকুর ত ঐরূপ করেন নাই, নিজ দেব-মানবত্বের এবং জনসাধারণকে নির্ব্বিচারে অভয়াশ্রয়প্রদানের পরিচয়ই ঐ ঘটনায় সুব্যক্ত করিয়াছিলেন।’’

যাই হোক, ইংরাজি নববর্ষের দিনটিতে এখনও সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে কল্পতরু দিবস। হ্যাঁ, আর একটি তথ্য, পয়লা জানুয়ারির ওই ঘটনার সময় রামকৃষ্ণের সামনে উপস্থিত ছিলেন না প্রিয় শিষ্য নরেন্দ্রনাথ। সেদিন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে থাকলেও তিনি রামকৃষ্ণের সেবার কাজ সেরে বেশি রাত পর্যন্ত সাধন-ভজন করায় দুপুরের পর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

কাশীপুরের এই বাগানবাড়িতেই সাড়ে ছয় মাস পর, ১৬ অগস্ট মৃত্যু হয়েছিল রামকৃষ্ণের।

অলংকরণ: রাতুল চন্দরায়