বাঙালির পিকনিক

সীমান্ত গুহঠাকুরতা

দর-মফস্বলের যে সমস্ত পাড়া একসময় উদ্বাস্তু কলোনী ছিল, ইদানীং সেগুলো প্রায় সবই ফ্ল্যাট-শোভিত এবং তাদের গ্যারেজে রঙ-বেরঙের প্রাইভেট কার দণ্ডায়মান। গত বছর ১ জানুয়ারি কমবেশি তিরিশ কিলোমিটার দূরে একটা বাগানবাড়িতে পিকনিক (Picnic)। লাক্সারি বাসে যাওয়া এবং ফেরা। বাসেই শুকনো টিফিনের ব্যবস্থা। পাড়ারই কয়েকজন বয়স্ক মানুষ উদ্যোক্তা। তাঁরা ভেবেছিলেন বেশ গান-টান বাজবে বাসে, সকলে হইহই করতে করতে যাওয়া যাবে। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, বেশিরভাগই ফোনে জানিয়ে দিলেন যে তাঁরা নিজেদের গাড়িতে যাচ্ছেন, ‘সময়মতো স্পটে পৌঁছে যাবেন’। সেই দু-চারজন উদ্যোক্তা এবং দু-চারটি পরিবার নিয়ে ফাঁকা বাস রওনা দিল পিকনিক স্পটের দিকে। কেক-কমলালেবু-প্যাটিস-ভরা জলখাবারের বাক্সগুলো পড়ে রইল বাসেই।


বাকিরা অবশ্য তাঁদের কথার খেলাপ করেননি। এক্কেবারে ‘সময় মতোই’ তাঁরা পৌঁছে গিয়েছিলেন ছিলেন পিকনিকের (Picnic) জায়গায় — দুপুরের খাবার পরিবেশনের আধ ঘণ্টাটাক আগে। পৌঁছেই প্রবল উদ্যমে নেমে পড়েছিলেন সেলফি তোলার সুমহান কর্মযজ্ঞে। গ্রামের সাজানো-গোছানো বাগানবাড়ি, ছবি তোলার মত ব্যাকগ্রাউন্ডের অভাব নেই। পুকুর, ফুলের বাগান, গাছের গায়ে টাঙানো দোলনা, বাগান থেকে বেরুলেই চারধারে সবুজ সবজির ক্ষেত, হেলান দিয়ে কেত মেরে দাঁড়ানোর মত ছোট বাঁকা খেজুর গাছ…আর কী চাই! ছবিতে ছবিতে মোবাইল ভরে উঠতেই তারা বসে গেলেন পেট ভরাতে। তার আগে অবিশ্যি হকের পাওনা টিফিনের প্যাকেটটা আদায় করে নিতে ভোলেননি এবং নিয়েই ঝোলায় ভরেছিলেন। সন্ধের দিকে খিদে পেলে কাজে লেগে যাবে।


খাওয়ার সময়ও তাদের হাবভাব অনেকটাই এমন যেন বিয়ে বাড়িতে খেতে বসেছেন। বিয়ে বাড়িতে যেমন যতক্ষণ আমরা খাই, ততক্ষণই উপহারের অঙ্কটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে, এখানেও অবিকল তেমনই ব্যাপার। টাকা দিয়েছি, অতএব লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে, ডানদিক-বাঁদিক না তাকিয়ে নিজের পেট ভরিয়ে যাব। কে আগে খেয়েছেন আর কে বা কারা বাকি আছেন — সেসব খোঁজ নেবার বালাই নেই। আর খাওয়া শেষ হতেই টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বাড়ির পথ ধরা।


হাতে হঠাৎ করে প্রচুর টাকা আসায় আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া শহুরে মধ্যবিত্তদের জন্য সম্প্রতি এরকম প্রচুর সাজানো-গোছানো পিকনিক (Picnic) স্পট তৈরি হয়েছে গ্রামের দিকে। বেশ কয়েক বিঘে জমিতে ইতস্তত ছড়ানো কিছু আম-কাঁঠালের গাছ থাকলেই হল। তারপর সামান্য কিছু ইনভেস্টমেন্ট, ব্যস। জমিটা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে তার ভিতরে পরস্পর বেড়া দিয়ে বিচ্ছিন্ন করা স্পট তৈরি করা হয়। ‘স্পট’ মানে ওই রান্নার জন্য ছোট্ট একটা ছাউনি, জলের কল আর একটা পরিচ্ছন্ন টয়লেট। এর সঙ্গে বাচ্চাদের জন্য একটা স্লিপ আর দোলনা। ব্যস, আয়োজন সম্পূর্ণ। এর সঙ্গে যদি নিজস্ব ডেকরেটার্স আর ক্যাটারার এর ব্যবসা চালু করা যায় তো সোনায় সোহাগা। আজকাল সব পিকনিক (Picnic) পার্টিই চায় রেডিমেড আয়োজন। তার জন্য বিয়েবাড়ির মত প্লেট প্রতি ‘মূল্য ধরে দিতে’ সকলেই রাজি। তাতে দু-পয়সা বেশি খরচ হলেও কুছ পরোয়া নেহি। ওই আলাদা আলাদা জায়গা থেকে সব্জি বাজার করো রে, মুদি মাল, মাংস, মিষ্টি কেনো রে, তারপর রান্নার ঠাকুর জোগার করা, নিজেরা জামা-কাপড় নষ্ট করে পরিবেশন করা — সে সবে প্রচুর হ্যাপা। আমরা শুধু আনন্দ করব। কাজ করবে কাজের লোকেরা।


মুশকিল হল, আনন্দ ব্যাপারটা যে আসলে কী — সেটাই মধ্যবিত্ত বাঙালি আজকাল ঠিক করে উঠতে পারছে না। এই রকমই একটি বনভোজনের আসরে বসে মনে পড়ে যাচ্ছিল বছর তিরিশেক আগেকার কথা। পাড়ার জনা পনেরো শিশু-কিশোর মিলে হঠাৎ হিড়িক তুলে বনভোজনের আয়োজন। ‘স্পট’ স্থির হল এলাকারই এক জঙ্গলে ঢাকা পরিত্যক্ত বাড়ি। প্রবল উৎসাহে, সাপখোপের ভয় তুচ্ছ করে নেমে পড়ল ভৈরব বাহিনী। দাঁ-কোদাল-ঝাঁটা-ঝুড়ি চলে এল এর-তার বাড়ি থেকে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই জঙ্গল সাফ হয়ে সেই ঘর দিব্য চকচকে। তারপর সেই ঘরের মেঝেতে গর্ত করে তার চারধারে ইট সাজিয়ে তৈরি হল উনুন। চাঁদা তুলে কেনা হল তেল, নুন, হলুদ, আলু, ফুলকপি আর ডিম। কিন্তু চাল? চাল কেনার যে আর পয়সা নেই। অগত্যা আবার সদস্যদের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষেয় বেরুনো। মায়েরা দু-মুঠো করে চাল দিয়েও দিলেন হাসতে হাসতে। আর সব থেকে বড় প্রাপ্তি পাড়ার এক সদ্য চাকরি পাওয়া কাকুর কাছ থেকে। তিনি দিলেন নগদ দশটি টাকা — শেষপাতে মিষ্টির জন্য। (কী আশ্চর্য, এমনও হয়? যে লোকটা নিজে খাবেন না, তিনিও নগদ চাঁদা দিচ্ছেন বনভোজনে)।


সব জোগাড়যন্ত্র সারতেই সকাল গড়িয়ে গেল। তারপর সারা দুপুর আগুনের সামনে চলল প্রবল ধ্বস্তাধ্বস্তি। মাঝে মাঝে উঁকি মেরে পাড়ার মা-কাকিমারা রান্নার নানা টোটকাও বাতলে দিয়ে গেলেন। সূর্যদেব যখন সারাদিনের ডিউটি সেরে পশ্চিমে বাড়ির পথ ধরেছেন, তখন পাত পেড়ে খেতে বসল ছেলের দল। মাটির মেঝেতে কলাপাতা পেতে তাতে গরম গরম পাতলা খিচুড়ি আর ডিমভাজা। তার স্বাদ… থাকগে, কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!


কাজ কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, পিকনিকে (Picnic) ব্যবহৃত প্রত্যেকটা হাঁড়ি-থালা-বাটি ছাই দিয়ে মেজে, পাশের পুকুরে ধুয়ে পরিষ্কার করে যার যার বাড়িতে ফেরত দিয়ে তবে শেষ হয়েছিল পিকনিক। আর সেদিন দেখলুম শেষ বিকেলে সেই পিকনিক স্পটের বেড়ার ধারে, কলপাড়ে বসে ঢাউস ঢাউস লোহার কড়া, গামলা মাজছেন স্থানীয় কয়েকজন মহিলা। চেহারায়-পোশাকে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। আয়োজকদের জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, এই বাসনগুলো মাজার বিনিময়ে ওরা পাবেন নগদ একশো টাকা আর বেঁচে যাওয়া খাবার-দাবারগুলো।


স্মৃতিমেদুরতা, সর্বক্ষণ অতীতের পানে চেয়ে ‘আহা কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলাটা খুব একটা কাজের কথা নয়, জানি। দিন তো বদলাবেই। মানুষ প্রতিনিয়ত আরও আরও আধুনিক হবে, নিত্য-নতুন প্রযুক্তিও আসবে। কিন্তু সব মিলিয়ে তা যদি মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতাকেই বাড়িতে তোলে, তাহলে কী লাভ দলবেঁধে বনভোজন করে? কী-বা লাভ গাদা গাদা সেলফি তুলে আর সোশ্যাল মিডিয়ায় তা পোস্ট করে! যতক্ষণ কোনও ‘কাজে’ নিযুক্ত করা যায় নিজেদের, সেই কাজকে সফল করে তোলার দায় অনুভব করা যায়, ততক্ষণ কি আদৌ কোনো যৌথতার আনন্দ পাওয়া সম্ভব?


থিয়েটার ওয়ার্কশপে একটা খুব ইন্টারেস্টিং খেলা শেখানো হয়। ঘরের মেঝেতে একটা শতরঞ্চি পেতে তার ওপর রীতিমত ঠাসাঠাসি করে দাঁড় করানো হয় দলের সমস্ত ছেলেমেয়েকে। তারপর তাদের একটা গল্প বলা হয়। গল্পটা কতকটা এই রকম — মনে করো, তোমরা সকলে একটা জাহাজে করে সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়েছিলে। মাঝসমুদ্রে প্রবল ঝরে জাহাজ উল্টে গেছে। তোমরা সবাই হ্যাঁচোর-প্যাঁচোর করে উঠে এসেছ সেই উল্টোনো জাহাজের উপর। এখন জাহাজটা সোজা না করলে তো ঘরে ফেরা যাবে না। এদিকে সমুদ্রে নামার উপায় নেই, কারণ শিকারের গন্ধ পেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঙর এসে হাজির হয়েছে। কারোর পায়ের ডগাটুকুও জলে ছোঁয়ালেই নিশ্চিত মৃত্যু। এখন উপায় একটাই, উল্টোনো জাহাজের উপর দাঁড়িয়েই জাহাজটাকে সোজা করতে হবে। সোজা কথায়, শতরঞ্চি থেকে কারোর পা মেঝেতে না ফেলে, তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই সেটাকে উলটে আবার তার ওপর দাঁড়াতে হবে।


ও হ্যাঁ, বলতে ভুলেছি আরেকটা জরুরি কথা। এ খেলায় কিন্তু ‘আউট’ বলে কিছু নেই। যদি একজন কারোর পা-ও জলে পড়ে (অর্থাৎ শতরঞ্চির বাইরে যায়) তাহলেই আমরা আমাদের মিশন ব্যর্থ বলে ধরে নেব এবং বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা বাতিল করে দেব। কারণ আমরা এসেছি দলবেঁধে, ফিরবও দলবেঁধে। কেউ পিছনে পড়ে থাকবে না।


বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বহুবার এই খেলাটা খেলিয়েছি — শুধু দলবেঁধে কাজ করার আনন্দটুকু কেমন হয় তা বোঝাবার জন্য। প্রতিবারই ওরা এই আপাত-অসম্ভব কাজটাকে সম্পূর্ণ নিজেদের চেষ্টায় সম্ভব করে দেখিয়েছে। বাইরে থেকে কোনও ইনস্ট্রাকশনের প্রয়োজন হয়নি। হয়তো একবারের জায়গায় দুই বা তিনবার লেগেছে। কিন্তু প্রতিবারই দেখা গেছে শেষ পর্যন্ত ওরা পরস্পরকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থেকেছে, কেউ কারোকে ধাক্কা মেরে শতরঞ্চির বাইরে ঠেলে দেয়নি। আরও মজার ব্যাপার হল, প্রতিবারই দেখা যায়, ওদের মধ্যে থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনও না কোনও নেতা উঠে এসেছে। বাকিরা বিনা আপত্তিতে তার নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে তার নির্দেশমত এগোচ্ছে বা পিছোচ্ছে। আর তার থেকেও বড় ব্যাপার হল, ওই সময়টুকুতে ওদের মনেই থাকে না যে ওদের মধ্যে কে পড়াশুনায় ভাল আর কে তথাকথিত ব্যাকবেঞ্চার, মাথায়ও থাকে না, কে হিন্দু আর কে মুসলমান। এমনকী ওরা এও বেমালুম ভুলে যায় যে টালমাটাল হয়ে পড়ে যেতে থাকা যে সহপাঠীটিকে ও দু’হাতে জড়িয়ে ধরে টেনে রেখেছে ভিতরের দিকে, গতকাল খেলার মাঠে তার সঙ্গেই তুচ্ছ কারণে প্রবল মারামারি হয়েছিল ।


তারপর যে মুহূর্তে মরণপণ লড়াইয়ের শেষে ওরা সফল হয়, একটা প্রবল উল্লাসের সমবেত চিৎকার ওঠে। সে উল্লাস জয়ের উল্লাস। এই জয় কোনো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় নয়, এ জয় যৌথতার। দুঃখের ব্যাপার হল, জাহাজটা যে ডুবছে এবং ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থ, আত্মসুখের গণ্ডি ছেড়ে পরস্পরের হাত না ধরতে পারলে আর যে সত্যিই রক্ষে নেই, সেই কথাটুকু আমরা কেউ-ই বুঝতে পারছি না। বনভোজনের মত একটা দারুণ উদ্দীপনা এবং আনন্দময় ব্যাপারকেও যারা এমন নিষ্প্রাণ, এমন নাগরিক স্বার্থপরতায় আচ্ছন্ন করে দিতে পারেন, আনন্দ পাবার প্রশ্নেও যাদের এতখানি পরনির্ভরশীল, এতখানি পরিশ্রম-বিমুখ হতে দেখা যায়, জাতি হিসেবে তাদের জায়গা ক্রমশ নীচের দিকে যেতে থাকবে, তাতে আর সন্দেহ কি! তা সে পকেট যতই ফুলে উঠুক না কেন!

অলংকরণ: রাতুল চন্দরায়