সৈয়দ রেজাউল করিম

ছোটগল্প কেমন হবে, বা কেমন হওয়া দরকার, তার উপমা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:

       “ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা    ছোট ছোট দুঃখ কথা  

                     নিতান্তই সহজ সরল।

        সহস্র বিস্মৃতিরাশি    প্রত্যহ যেতেছে ভাসি

                     তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।

        নাহি বর্ণনার ছটা     ঘটনার ঘনঘটা

                      নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ।

        অন্তরে অতৃপ্ত রবে   সাঙ্গ করি মনে হবে

                      শেষ হয়ে হইল না শেষ।”

       কর্মজীবনে মানুষজনের সংস্পর্শে এসে নিত্য নতুন কত যে ছোট বড় ঘটনা ঘটতে দেখেছি, তার ইয়ত্তা নেই। তার মধ্যে কিছু ঘটনা নিয়ে “থানার দুয়ারে ভালোবাসা” শিরোনামে একটা উপন্যাসও লিখেছি। এখন চাকরি জীবন সাঙ্গ করেও মনে হচ্ছে, শেষ হয়েও বোধ হয় হইল না শেষ।

          ন’তারিখ সকালে সেই কথাটা মনে পড়ল আবার। শিয়ালদহ স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে বিকেলে। শিয়ালদহ-বালুরঘাট ট্রেন। ১০তারিখ সকাল ১০টায় বালুরঘাট জজ কোর্টে সাক্ষী দেওয়ার কথা

আমার। তাই দেরি না করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নিলাম। ওখানে তিন-চার দিন থাকতে হবে। সাক্ষী দিয়ে, সাধনবাবুর মেয়ের বিয়ে, বউভাত অ্যাটেন্ড করে তবেই বাড়িতে ফিরতে হবে। সুচরিতাদি অবশ্য বলে রেখেছে তার কোয়ার্টারে থাকতে। কিন্তু ওখানে থাকা কি উচিত হবে? একা মহিলা থাকে। হয়তো কাজের মেয়েটা সঙ্গে থাকে। কিন্তু লোকজন কী ভাববে? সংশয়, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরি হল আমার মনের মধ্যে। একসময় মনে হল,এত ঝুট ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে সোজা হোটেলে গিয়ে ওঠাই উচিত হবে। পরক্ষণে সুচরিতাদির অসহায় মুখটা ভেসে ওঠে মনের মধ্যে। সুচরিতাদি বারবার অনুরোধ করেছে তার ওখানে উঠতে। তার কোয়ার্টারে না গেলে সুচরিতাদিও মনে অনেক কষ্ট পাবে। সেটা করা কি আমার পক্ষে উচিত হবে? দোটানায় দুলতে থাকল আমার মন।

        চাকরি জীবনের শুরুতেই সুচরিতাদির সঙ্গে আমার আলাপ। বালুরঘাট থানায় প্রথম সাক্ষাৎ। দীর্ঘ দু’টো বছর সহকর্মী বন্ধু হিসেবে একসাথে কাটানো। একসঙ্গে তদন্ত করতে যাওয়া, হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব, শলা পরামর্শ করা— সেসব দিনের কথা কি ভোলা সম্ভব? না কি কখনো ভোলা যায়? সুচরিতাদি কতদিন আমাকে তার কোয়ার্টারে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছে তার ঠিক ঠিকানা নেই। তার মনে আঘাত দেওয়াটা বোধহয় উচিত হবে না আমার। লোকজন যা খুশি বলুক, যা কিছু ভাবুকগে, তাতে কী যায় আসে আমাদের? আমরা জোর গলায় বলতে পারি, আমরা ষাটোর্দ্ধ। সিনিয়র সিটিজেন। সুচরিতাদি আমার ভাল বন্ধু। অন্য কিছু নয়।

          তবুও মনটা কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। শেষবেলা বুড়ো বয়সে মাথায় কলঙ্ক নিয়ে ঘুরব! কে আমায় মাথার দিব্যি দিয়েছে, সুচরিতার বাড়িতেই রাত কাটাতেই হবে। একসাথে খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজব করা পর্যন্ত ঠিক আছে, তার বেশি কিছু নয়। অবশেষে মনে মনে একরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, হোটেলে গিয়েই উঠব।

          দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া করে, ব্যাগপত্তর নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। শিয়ালদহে পৌঁছলাম সময় মতো। তারপর চেপে বসলাম বালুরঘাটের ট্রেনে। গ্রাম শহর, নদী-নালা অতিক্রম করে নির্দিষ্ট পথে দুরন্ত গতিতে ট্রেনটা এগিয়ে চলল নির্দিষ্ট পথের লক্ষ্যে।

           অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে গায়ের উপর দিয়ে। সুচরিতাদির সাথে সাক্ষাৎ হয়নি বহুদিন। এতদিন আমরা যে যার কাজে ব্যস্ত ছিলাম।এখন দুজনেই বেকার। রিটায়ার্ড পার্সন। আমি না হয় ব্যস্ত আছি লেখালিখি নিয়ে। কিন্তু সুচরিতাদি কী ভাবে তার দিনগুলো কাটাচ্ছে? কেন বালুরঘাটের মতো জায়গায় পড়ে আছে? কিসের টানে, কে জানে? ইচ্ছে করলে তো ফিরে যেতে পারে দেশে, নিজের বাড়িতে। নিজের জন্মস্থানের ভিটেতে। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনদের কাছে।

           এসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হল, এতদিন একসাথে চাকরি করলাম, কিন্তু কোথায় সুচরিতাদির বাড়ি তা জানা হয়নি কোনওদিন। ছুটি নিয়ে সুচরিতাদি যে নিজের বাড়িতে গিয়েছে সে কথা স্মরণ করতে পারলাম না। তবে দু’ একবার দার্জিলিংয়ে গিয়েছে সে কথা আমি জানি। কেন গিয়েছে, তা কোনওদিন সুচরিতাদি খুলে বলেনি। আগবাড়িয়ে আমিও জিজ্ঞাসা করিনি কোনওদিন। আদৌ কি সুচরিতাদির বাবা-মা বেঁচে আছেন? তার কি কোন ভাই-বোন আছে? সেকথাও জানা হয়নি। সুচরিতাদিও আমার সম্বন্ধে তেমন কিছু জানতে চায়নি। অথচ দু’জন দু’জনকে কত কাছ থেকে দেখেছি, দু’জন দু’জনকে একান্ত ভাবে চিনেছি। অথচ সেই চেনার মধ্যে কতটা ফাঁক থেকে গেছে। কতটা..

            সেই ভাবনার তাল হঠাৎ কেটে গেল। পকেটের মোবাইল ফোনটা মিস্টি সুরে বেজে উঠল। বার করে দেখি সুচরিতাদির ফোন। বিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরে বললাম–হ্যালো সুচরিতাদি! তুমি ভালো আছো তো?

           সেকথার কোন জবাব না দিয়ে সুচরিতাদি বলল— তুই গাড়িতে উঠেছিস?

       প্রশ্নের ধরন আর গলার স্বর শুনে বুঝে গেলাম আমার উপর খুব রেগে আছে সুচরিতাদি। অনুভব করলাম রাগের কারণটা। সেটা অমূলক নয়, তা-ও বুঝলাম। সকাল থেকে একবারও ফোন করে বলিনি যে আমি রওনা হচ্ছি। তাই এই গোঁসা। তাই এই রাগ। তাই এই অভিমান। কিন্তু মনে মনে আমি চাইছিলাম না ব্যাপারটা সুচরিতাদিকে বলতে। আগে গিয়ে হোটেলে উঠব, তারপর জানাবো ভেবেছিলাম। কিন্তু কেঁচিয়ে গেল ব্যাপারটা। অগত্যা সুচরিতাদিকে ঠান্ডা করতে একটু মিথ্যার আশ্রয় নিলাম। মনে খুব দুঃখ পেয়েছি, এমন ভান করে করে বললাম—  আমাকে ক্ষমা করো সুচরিতাদি! সকাল থেকে না হলেও দশবার চেষ্টা করেছি তোমাকে ধরার, কিন্তু প্রতিবারই তুমি আউট অফ রেঞ্জ থেকে গেছো। এতে আমার দোষটা কোথায়?

— রাতের খাবার কিছু খেয়েছিস?

— না, এখনও কিছু খাইনি।

— খাবার সঙ্গে আছে তো ? না থাকলে বিস্কুট, ফল টল নিয়ে খাস। কোন বাইরের জিনিস….।

— সেকথা আর বলতে হবে না সুচরিতাদি! চাকরি জীবনের সূত্রপাতে যে ঘা আমি খেয়েছিলাম, সেকথা আজও আমার মনে আছে।

— ঠিক আছে। ভোরবেলা গাড়ি থেকে নেমে সোজা চলে আসবি আমার কাছে।

—ঠিক আছে সুচরিতাদি!

         একথা বলে ফোনটা রাখলাম। ঘর থেকে নিয়ে আসা খাবার উদরস্থ করলাম। তারপর নবকল্লোল পত্রিকাটা হাতে নিয়ে উঠে পড়লাম ব্যাঙ্কে। পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম কে জানে?

        সেই ঘুম ভাঙলো সকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। প্যাসেঞ্জারদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে। পরের স্টেশন বালুরঘাট। বাঙ্ক থেকে নেমে জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিলাম। ঢিমেতালে গাড়ি চলছিল। একসময় ট্রেন পৌঁছে গেল বালুরঘাট স্টেশনে। ব্যাগপত্র কাঁধে নিয়ে ট্রেন থেকে নামলাম। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বার করে রিং করলাম কস্তুরী হোটেলে। হোটেল ম্যানেজার ফোন ধরল। পরিচয় দিয়ে বললাম— একটা রুম চাই।

ম্যানেজার বলল—  চলে আসুন স্যার! অসুবিধা হবে না।

      ব্যাগপত্র নিয়ে আমি স্টেশন থেকে বার হবো, দেখি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুচরিতাদি। আমি বিস্ময়ে হতবাক। যেন প্রচলিত প্রবাদ বাক্যের মতো ঘটে গেল ব্যাপারটা। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। আমাকে দেখে খুশিতে ভরে উঠল সুচরিতার চোখ-মুখ। আমি হতবাক হয়ে গেলাম সুচরিতাদিকে দেখে। কেমন যেন পাল্টে গেছে সুচরিতাদি। তার মুখের চামড়া এখনো টান টান থাকলেও সামনের বেশ কিছুটা চুলে পাক ধরেছে। সেই পাকা চুলগুলো একেবারে ইন্দিরা গান্ধী স্টাইলের। দেখে অপূর্ব লাগছিল সুচরিতাদিকে। ঘোর কাটল তার কথায়।

 — আমাকে কী এত দেখছিস? বুড়ি হয়েছি বলে চিনতে পারছিস না? আমি তোর সেই সুচরিতাদি।

 — কী যে বলো না! তোমাকে চিনতে পারব না, একথা ভাবলে কি করে ? বরং তুমি আরও বেশি সুন্দরী হয়েছ। তোমার মধ্যে একটা গাম্ভীর্য এসেছে। তাতে আরও মিষ্টি লাগছে তোমাকে।

—       থাক থাক! তোকে অত প্রশংসা করতে লাগবে না। চল, বাইরে রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখেছি।

     দেরি না করে সুচরিতাদির সঙ্গে রিক্সায় উঠলাম। যেতে যেতে সুচরিতাদির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা সব ভালো আছো তো ?

 — নারে, খুব একটা ভালো নেই। কেমন যেন একটা মানসিক অবসাদে ভুগছি। একাকিত্বের নরক যন্ত্রণা যে কী, তা এখন ভালো মতো বুঝতে পারছি। প্রতিটা মুহূর্তে, প্রতিটা পদক্ষেপে।

— তুমি একদম ভেবো না। এটা একটা মানসিক ব্যাপার। নিজেকে সবসময় এনগেজ রেখো। তাহলে দেখবে খারাপ লাগছে না। এই পৃথিবীতে মানুষ এসেছে একা। যাবেও একা। এটাই বিধির বিধান। মন খারাপ লাগলে বই পড়ো, ফোনে কথা বল, টিভি দেখো, গান শোনো, দেখবে মনটা ভালো লাগছে।

কথা বলতে বলতে আমরা চলে এলাম বালুরঘাট চৌপথিতে। রিক্সা থেকে নেমে কয়েক কদম এগোতেই সুচরিতাদির ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটটি বেশ বড়, সুন্দর। পরিপাটি করে সাজানো। দু’টো বেড রুম। একটা বড় ডাইনিং স্পেস। কিচেন রুম, বাথরুম। পুরোটা সাড়ে সাতশ’ স্কোয়ার ফিটের।

         সুচরিতাদি বলল— জামাকাপড় খুলে স্নানটা আগে সেরে নে। কোর্টে সাক্ষী দিতে উঠলে কখন ছাড়া পাবি  তার কোন ঠিকঠিকানা নেই। তেল-সাবান, গামছা সব বাথরুমে রাখা আছে।

আমি বললাম, ঠিক আছে দিদি! আমি স্নান করে নিচ্ছি। তুমি আমার জন্য অত ভেবো না।

সুচরিতাদি বলল, তোর জন্য লুচি তরকারি করব, না হাতরুটি খাবি?

 আমি বললাম— তুমি যা খাবে, আমার জন্য তাই কর। আদিখ্যেতা দেখাতে যেও না। আমার খুব খারাপ লাগবে।

—       আগে তো তুই এরকমটা ছিলি না। এই স্বভাবটা তোর এল কোথা থেকে? বয়সটা বাড়লে বোধ হয় এমনই হয়।

           বুঝতে পারলাম আমার কথায় কিছুটা রুষ্ট হয়েছে সুচরিতাদি। তাই জবাব না দিয়ে সোজা গিয়ে ঢুকলাম বাথরুমে। সুচরিতাদি চলে গেল নিজের কাজে।

          ভালো ভাবে স্নান-টান করে বার হলাম বাথরুম থেকে। ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বার করে পরে নিলাম। মাথাটাও আঁচড়ে নিলাম। ঠিক সেই সময় ঘরের কলিং বেলটা মধুর সুরে বেজে উঠল। জলখাবার তৈরি করতে তখনও ব্যস্ত ছিল সুচরিতাদি। আমাকে উদ্দেশ করে বলল— দেখ তো কে এসেছে?

             দরজা খুলে আমি হতবাক। দেখতে পেলাম বছর চল্লিশের এক সুন্দরী মহিলা, সঙ্গে দশ বারো বছরের এক কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে। চিনে উঠতে পারলাম না তাদের। ভাবলাম প্রতিবেশী কেউ হবে। মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কাকে চান ?

            মহিলাও আমাকে দেখে হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। আমার প্রশ্ন শুনে ঘোর কাটল তার। চাপা গলায় শুধালো—মা আছে ?

           আমি তো আরও অবাক হয়ে গেলাম তার কথা শুনে। এই মহিলা কাকে চাইছে বুঝে উঠতে পারলাম না। সুচরিতাদি তো বিয়ে-টিয়ে করেনি। তার মেয়ে আসবে কোথা থেকে? অবশ্য গ্রামাঞ্চলের মহিলারা একটু বয়স্কা মহিলাদের ‘মা’ বলে সম্বোধন করে থাকে। ব্যাপারটা সঠিক ভাবে বুঝতে আমি জানতে চাইলাম— আপনি কি সুচরিতাদির কথা বলছেন?

            মেয়েটা হাঁ সূচক মাথা নাড়ল। আর ঠিক তখনই কিচেন থেকে সুচরিতাদি বার হয়ে এল। মেয়েটিকে দেখে বলল— আয়, ভিতরে আয়।

          আমি দরজার একপাশে সরে দাঁড়ালাম। ভদ্রমহিলা তার মেয়েকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। আমার অবাক ভাবটা তখনও কাটেনি দেখে সুচরিতাদি বলল— ওকে বোধহয় এখনও চিনতে পারিসনি। ও আমাদের মিনি। আর ওটা হল ওর মেয়ে চিন্ময়ী, ওরফে চিনি।

           সুচরিতদির কথা শুনে আমার ঘোর কাটল। মনে পড়ে গেল সেই পুরনো কথা। মিনিকে আমি প্রথম দেখেছিলাম সুচরিতাদির কোয়ার্টারে। সে হল সুচরিতাদির পালিত কন্যা। কিন্তু এখন তো দেখছি পাকা গৃহিণী। কবে মিনির বিয়ে হল, কবে তার কন্যা সন্তান হল, কিছুই তো জানি না আমি। তাই একরাশ বিস্ময়ের দৃষ্টিতে মিনির দিকে তাকিয়ে বললাম— ভালো আছিস মা? কবে তুই এতটা বড় হয়ে গেলি? তোর মেয়েকে দেখে তো আমি ভাবছিলাম, আমাদের সেই ছোট্ট মিনি এসেছে।

            মিনি ততক্ষণে আমাকে চিনতে পেরেছে। আমার চোখে চোখ রেখে বলল— কাকু! তোমরা সবাই ভালো আছো তো ?

           আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। চিনিকে ডেকে পাশে বসালাম। তার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে অনেক কথা জিজ্ঞেস করলাম। মিনিকে তার মা সুচরিতাদি ডেকে নিয়ে গেল কিচেনরুমে। আমার মনে পড়ে গেল হাই স্কুলে ছেলেবেলায় পড়ে আসা এস.ওয়াজেদ আলীর লেখা ‘ভারতবর্ষ’ গল্পের কথা। যেখানে লেখক ২৫ বছর পর দেশে ফিরে সেই একই  দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখেছিলেন। দোকানি যুবক তার বৃদ্ধ বাবাকে রামায়ণ পাঠ করে শোনাচ্ছে। সেদিনের সেই দোকানি যুবকই যে আজকের বৃদ্ধ বাবা, চলমান জীবনে সে কথা ভুলে যাই আমরা।

মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের লেখা কাবুলিওয়ালা গল্পটার কথা। ছোট্ট মিনিকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে দেখে কাবুলে নিজের মেয়ের কথা মনে পড়েছিল কাবুলিওয়ালার। এ ঘটনা হরহামেশাই ঘটে চলেছে আমাদের সমাজে। আজ নতুন করে মিনি আর তার মেয়ে চিনিকে দেখে মনে পড়ল। ইতিমধ্যে কতগুলো বছর কেটে গেছে সে হিসাব যেন মন মেনে নিতে চায় না। মন ভুলে যায়, গোলমাল করে ফেলে।

         সেই সময় হঠাৎ করে ভাবনার ছন্দপতন ঘটল। দুটো খাবারের প্লেটে লুচি তরকারি সাজিয়ে নিয়ে হাজির হল মিনি। একটি আমার, অন্যটি চিনির জন্য। প্লেট দুটি ডাইনিং টেবিলের উপর সাজিয়ে দিয়ে মিনি বলল— কাকু! মা বলল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে। ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না।

           আমি খাওয়া দাওয়া সেরে সুচরিতাদির সাথে গল্পগুজব করে সাড়ে ন’টা নাগাদ বার হলাম। পৌনে দশটা নাগাদ জজ কোর্টে পৌঁছে হাজিরা দিলাম। সাড়ে বারোটা নাগাদ ডাক পড়ল আমার। জজ কোর্টের কাঠগড়ার ডকে গিয়ে দাঁড়ালাম। ডকের সামনে ঝোলানো ছিল চিরাচরিত সেই বাণী। হাল্কা সুরে তা পড়লাম। যা বলিব, সত্য বলিব। সত্য ছাড়া মিথ্যা বলিব না।

           দেখতে পেলাম প্রকাশ অন্য কেসের আসামীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে সামনের কাঠগড়ায়। বিধ্বস্ত তার চেহারা। চোখ মুখ বসে গেছে। শরীর হয়ে গেছে অর্ধেক। নিষ্প্রভ দুই চোখের তারায় যেন ক্ষমা করে দেবার আকুতি ঝরে পড়ছে।

(ক্রমশ)

অলংকরণ: রাতুল চন্দরায়