দীপংকর ঘোষ

অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। ভেজা পিচ রাস্তা ধরে ছাতা মাথায় লোটাকম্বল কাঁধে আমরা পাঁচজন হেঁটে চলেছি হোটেলের খোঁজে। রাস্তায় লোকজন খুব একটা চোখে পড়ছে না। আমাদের ডানদিকে ছাতিম আর ইউক্যালিপটাসের বন পেরিয়ে দেখা যায় সবুজ শুশুনিয়ার মাথা। গতকাল রাত এগারোটা পাঁচ-এর আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারে চেপে ভোর সাড়ে চারটেয় নেমেছি বাঁকুড়া স্টেশনে। অত ভোরে শুশুনিয়া (Susunia pahar) যাবার বাস পাওয়া মুশকিল। দলে আমরা পাঁচজন। আমি, গোরা, শানু, টুটুদা আর সর্বকনিষ্ঠ রূপণ।

স্টেশন চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা নানা ধরনের গাড়ির মধ্যে টাটা সুমোর ড্রাইভার আমাদের শুশুনিয়া (Susunia pahar) নিয়ে যেতে রাজি, কিন্তু সে ভাড়া আটশো টাকা হেঁকে বসে আছে। আটোও কম যায় না। চারশো। একটু ভাবনাচিন্তা করার জন্য রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে এসে চায়ের অর্ডার দিলাম। ওখানেই শুনলাম এখনি বাস আসবে। ওতে করে বাঁকুড়া চলে গেলে সেখান থেকে শুশুনিয়ার (Susunia pahar) বাস পেয়ে যাবো। একটু পরে চলে এলো বাস। আমাদের নামিয়ে দিলো বাঁকুড়া বাস স্ট্যান্ডে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরই শুশুনিয়া যাওয়ার বাস পেয়ে গেলাম। নামলাম ছাতনা-শুশুনিয়ার মোড়ে। এখনও কিছুটা দূর বাকি। একটা ট্রেকার যাচ্ছিল। তাতে চড়েই আমরা অবশেষে এসে পড়লাম শুশুনিয়ায়।

পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে আমি গেছি। কিন্তু শুশুনিয়া (Susunia pahar) আমার এই প্রথম। কেন জানি না, শুশুনিয়া নামটার মধ্যেই কেমন একটা রহস্যময় আদিমতার গন্ধ পাই। এই গন্ধই বোধহয় শেষ পর্যন্ত টেনে এনেছে আমাকে এখানে। কয়েকটা লজ, কিছু খাবার হোটেল আর ছোটখাটো দোকান নিয়ে এই শুশুনিয়া মোড়। ট্রেকার থেকে নেমে রাস্তার পাশেই একটা লজে জায়গা আছে কিনা খোঁজ করা হোল। রাধাকৃষ্ণ লজের মালিক দু’টো ঘর খুলে দেখালেন। খুব অপরিচ্ছন্ন আর ড্যাম্প পড়ে যাওয়া ঘর দু’টে। এমনকি এক তলার ওই ঘরগুলিতে আলো-হাওয়া চলাচলেরও কোনও জায়গা নেই। স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের পছন্দ হয়নি। লজের মালিককে জানালামও সেই কথা। তিনি আমাদের একটু অবাক করেই বললেন, ‘‘এখান থেকে একটু এগোলেই দেখবেন একটা টাওয়ার রয়েছে। তার কাছেই আছে গেস্ট হাউস। আপনারা ওখানে চেষ্টা করে দেখতে পারেন।’’

হোটেলওয়ালা হয়ে নিজের হোটেলের গুণকীর্তন না করে, বোর্ডারদের ধরে রাখার চেষ্টা না করে অন্য হোটেলের ঠিকানা বাতলে দেওয়াটা অবাক করে দেবার মতোই ঘটনা। আমরা তাঁকে কথা দিলাম, সেখানে যদি জায়গা না পাই আমরা রাধাকৃষ্ণ লজে এসেই উঠব। বৃষ্টি পড়ছিলই। সবার কাছেই ছাতা রয়েছে। ছাতা মাথায়, বোঁচকা কাঁধে, বৃষ্টি ভেজা পথে পা বাড়ালাম। উদ্দেশ্য, গেস্ট হাউজ।

আমরা এসেছি ছাতনার দিক থেকে। সেদিক থেকে এসে এই রাস্তা ধরে চলে যাওয়া যায় রানিগঞ্জ। ওই রানিগঞ্জ মুখিই হাঁটা শুরু করলাম আমরা। বেশ খানিকটা হাঁটার পর মূল রাস্তা থেকে বাঁদিকে আর একটা রাস্তা চলে গেছে। যেখান থেকে ভাগ হয়েছে রাস্তা সেখানে দুই রাস্তার মাঝে যে ‘ভি’ আকৃতির জমি—সেখানেই গড়ে উঠেছে শুশুনিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত পরিচালিত গেস্ট হাউজ ‘আরণ্যক’। গেট খোলাই ছিল। সবাই মিলে ঢুকে পড়লাম জল, কাদা, কাঁকড়-মাটি, ঘাস সমাকীর্ণ গেস্ট হাউসের চত্বরে। দোতলা গেস্ট হাউস। নীচের তলার একটা ঘরে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলো বাড়ির কেয়ারটেকার। তাকে ডেকে তোলা হোল।

মোটামুটি বিনয় সহকারেই জিজ্ঞাসা করা হোল, ঘর পাওয়া যাবে কি? অল্পবয়স্ক ছোকরা আধশোয়া অবস্থাতেই আমাদের কাছে জানতে চাইল আজকের তারিখ। আর সেটা শোনার পর ব্যাজার মুখে, নির্লিপ্ত স্বরে জানিয়ে দিলো, আজ আর কাল বুকিং রয়েছে। অতএব কোন ভাবেই ঘর দেওয়া যাচ্ছে না। কী আর করা! গেস্ট হাউজের ভাল ভাল ঘরগুলোর দিকে বোকার মতন তাকাতে তাকাতে আবার রাস্তায় এসে উঠলাম। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম জায়গাটাকে। এমন জায়গায় এই গেস্ট হাউস তৈরি করেছে, যার সামনে ইউক্যালিপটাস, সেগুন আর ছাতিমের জঙ্গল, পিছন দিকটায় দিঘি-ক্ষেত-ধূ-ধূ প্রান্তর। নিস্তব্ধ, শান্ত পরিবেশ। অনেক্ষণ বাদে বাদে রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ির আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। বা বলা যায় শব্দ হবার মতো কোন জায়গাই নেই। কাছাকাছি দোকানপাট বলতে সেই শুশুনিয়া মোড়।

মনে মনে নিজেকে বললাম, আর তাকিয়ে লাভ কি! রাধাকৃষ্ণের পাঁচশো টাকা দামের ছাতা পড়া খুপরিই আমাদের অগতির গতি। চলো, যাওয়া যাক! বৃষ্টি পড়েই চলেছে। খানিকটা এগোতেই চোখ চলে যায় রাস্তার বাঁ দিকে তারজালির বেড়া দেওয়া সেগুন-ইউক্যালিপটাস গাছে ছাওয়া একটা অঞ্চলের দিকে। বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে ছাড়া ছাড়া বেশ কিছু ঘর। ঘরগুলো দেখে বেশ বোঝা যায় বহু বছর সংস্কারের কাজ হয়নি। বৃষ্টি ভেজা দেওয়ালগুলো রংচটা, শ্যাওলা ধরা। দরজা-জানলারও তথৈবচ অবস্থা। দু-একটা ঘরের দাওয়ায় দু-একজন লোকও দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত বনবিভাগের ঘর ওগুলো।

জায়গাটা খুব সুন্দর, নিরিবিলি। মনে মনে ভাবি, খালিই তো মনে হচ্ছে ঘরগুলো। এখানে কি আমাদের একটু জায়গা হবে না? একটা লোককে দেখা যাচ্ছে ঘরের বারান্দায়। ওকে জিজ্ঞাসা করে দেখলেই তো হয়। আমি আর গোরা রাস্তা থেকে নেমে গেট দিয়ে ঢুকে ঘরের বারান্দায় বসে থাকা লোকটার দিকে এগিয়ে গেলাম। মাঝবয়সি মানুষটি খাওয়া-দাওয়া সারছিলো। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, ঘর তো সব ফাঁকাই মনে হচ্ছে। আমরা কি এখানে থাকতে পারি? লোকটি নরম গলায় স্পষ্ট ভাবে বলল, এমনি এমনি দেওয়া যাবে না। বাঁকুড়ার অফিস থেকে বুক করে আসতে পারলে তবেই দেওয়া যাবে। আমরা জিজ্ঞাসা করি, ঝামেলা এড়িয়ে কোন ভাবেই কি একটু জায়গা দেওয়া যায় না? আমাদের হতাশ করে জবাব দিল লোকটা— দুঃখিত, এটাই নিয়ম। ওই কাগজটা নিয়ে আসুন, জায়গা দিয়ে দেব। অগত্যা আবার রাস্তায় এসে উঠি। এগিয়ে চলি সেই অপছন্দের রাধাকৃষ্ণ লজের দিকে।

(ক্রমশ)

অলংকরণ – রাতুল চন্দরায়