সকাল

সুধাময়বাবু এলেই দলবল বেধে এরা উড়ে ঝটপট নেমে পড়ে দত্ত বাড়ির পুরনো ছাদে। বকবকম…  বকবকম… গুটর গু…গুট গুট…গুটর গু…বকবকম… কত কথা তাদের মানুষটাকে ঘিরে। সাদাটি বেশ দেমাকি। খয়েরি আর সাদার রঙ মিলান্তি যেটি, শুধু তার সঙ্গেই সাদার একটু আধটু  ভাব জমে কখনও। রোদ ওঠার মুহূর্ত থেকে ধীরে ধীরে সাদা কালোর এ লুকোচুরি তাড়িয়ে তাড়িয়ে চেটে নেয় মানুষটা। দাবার ঘরের মত খোপে খোপে নির্জনতা এলিয়ে থাকে ছাদ জুড়ে।  অনন্ত আকাশের সঙ্গে কোন গোপন পরামর্শে ক্ষণ রচিত হয় অদৃশ্য তুলিতে। এ নির্জনতা ভাঙতে বুকের ভিতর চিনচিন করে তাই, থাকে এক আকাশ দ্বিধা। এ সময়ে ঘড়ির কাঁটাগুলো যদি থমকে যেত সেকথা ভেবেই মনে মনে আনন্দ হয় সুধাময়বাবুর। হাড়বজ্জাত, বিচ্ছু ছেলে একবার বদবুদ্ধি দিয়েছিল বাবাকে, 

” ওসব পুরনো আদ্যিকালের ঘড়িতে আর দম না দিলেই একেবারে খারাপ হয়ে যাবে। তখন ফেলে দিয়ে নতুন অটোমেটিক  সিস্টেমের ঘড়ি নিয়ে এসো! ব্যস! তোমার কাজ কমে গেল।”

বাবা মুচকি হেসে ছেলের চুল ঘেঁটে দিয়েছিল সেদিন। একতলা থেকে দোতলা সিঁড়ির ওঠানামার ছন্দে বাপ ঠাকুরদার আমলের বড় দেওয়াল ঘড়ি সময়কে এ বাড়িতে বেধে রাখে। বাড়ির কর্তা মাঝে মধ্যে ঘড়ির ঘণ্টার সঙ্গে দুলে যান।  দুলতে ভালবাসেন বড়।  তেল দিয়ে, ঝেড়ে মুছে অতি যত্নে সময়কে আলতো আদরে দুলিয়ে রাখতে সুধাময়বাবু সহসা ভোলেন না সেকারণে।  সেদিন আনমনে এক বাবা ছেলের পিঠ চাপড়ে বলেছিল, “সময় থমকে গেলে ঘোর বিপদ রে বুবাই! সময়ই যে ঈশ্বরের ছায়া!”

এসব কথা বলতে বলতে বাবার চোখে সুদূর না দেখা স্বপ্নেরা ঝেঁপে নামে। রেখে যায় জলছাপ, উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া কিছু অভিমান ধুলো হয়ে মিশে থাকে ছাদের কার্নিসে, সিঁড়ির রেলিং-এ। সে বুবাই দেখেছে অনেকবার।

 দত্তদের শরিকান বাড়ির ছাদ আজও স্বপ্ন দেখতে ভোলেনি। কিছুদূরে মাঠ ছাড়িয়ে দিগন্তে মাঝেমধ্যে মায়াবী আলো খেলা করে। এদিক-সেদিকের গাছপাতারা দিনের আলোর রং মেখে হাতছানি দিলেই মাপা পায়ে দ্রুত লয়ে নীচে নামতে হয় বাড়ির কর্তাকে। না নেমেই বা উপায় কই!  মিনু ভোর ভোর স্নান সেরে দু-চারটে ফুল তুলে গোপালের পায়ে দিয়েই হেঁসেলে ঢোকে। এবেলা গাছে জল দেওয়া, কোন গাছের পাতা পোকায় খেয়েছে— সে সব দেখার সময় মিনুর হয় না। সুধাময় কিছু বলতে গেলেই ঝাঁঝিয়ে উত্তর আসে, “আমার এখন মরারও সময় নাই! তোমার আদুরে রাজরানি মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে দাও!  এসব শিখুক!  শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে তো!  “

পা টিপে টিপে মেয়ের ঘরের বিছানার উল্টো দিকে এসে দাঁড়ায় বাবা। বড্ড ছেলেমানুষিতে ভরা একটু অগোছালো স্বভাবের এ মেয়ে বাপের খুব আদুরে।  প্রশ্রয় সুধাময়ই দেন। মেয়ের সখের গোলাপ গাছটি নেতিয়ে পড়লে আদরিনী বড় কষ্ট পাবে। বাপকে তাই অফিস যাওয়ার আগে সার, জল জোগাতে হয়।

অনেক দিনের পুরনো বাড়ি।  উঠোনের বরফি কাটা লাল-সাদা মেঝেতে চটা উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়। গেটের মুখে দু’পাশে সারি দিয়ে নানান মাপে, রঙে,  ঢঙে ফুলগাছের টব আলো করে থাকে। গাছে জল দেওয়ার ভারী লোহার মগে লাল দাগ ধরে গেছে দীর্ঘ ব্যবহারে। মেয়ে মাঝে মাঝে ঠোঁট বাঁকায়— “ইসস! কী দাগধরা জিনিস সব এ বাড়িতে! “

হাসিমুখে বাপ বোঝায়, “ও যে সময়ের দাগ রে টুসি!”

বাপ মেয়ের এসব সাধ আহ্লাদ অবশ্য স্বল্পায়ু। আঁচল কোমরে জড়িয়ে পাকা গিন্নি সুধাময়বাবুর স্ত্রী বাজারের থলিটি ঝুপ করে বড় বারান্দায় ফেলে ঠোঁট বেঁকিয়ে হেঁসেলে ঢোকেন গিয়ে। সকালের পরিশ্রম ও আগুনের গনগনে আঁচে তাঁর শ্যামলা বউ এর নাকের পাটায় বিন্দু বিন্দু জমা ঘাম আর হালকা লালচে রঙের আভা তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখে এক প্রৌঢ় প্রেমিক। সে প্রেমের অবসরে বাজার সেরে আসার মৌতাত গাঢ় হয় বাড়ির কর্তার।  

মনে মনে ভাবেন সুধাময়,  ‘এই তো!  এই রকম মুহূর্তেই জীবন এসে হাতমুঠিতে বসে।’  তখন তাকে আদর করে হৃদয়ের কুলুঙ্গিতে তুলে রাখতে হয়। কবে কোনওদিন না জানি সেসব স্মৃতির ধুলো ঝেড়ে সময় পেরোয়, পেরোয় এক একটি দিন রাত্তিরের ঢেউ! সেসব মানুষের নিজের কাছেই অজানা! 

সাঁঝ

মফস্বলী মিনুর শৈশবের অভ্যেস সন্ধেকে ‘সাঁঝ’ বলা। ছেলেমেয়েরা হাসে। কুয়াশার মতো নিঃসাড়ে সাঁঝ নামে না, ওদের সন্ধে হয়। হয় বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে লাইব্রেরিতে বইয়ে মুখ গুঁজে, না হয় কোনও রেস্টুরেন্টের আলো ঝলমল টেবিলের হৈ-হল্লায়। আরেকজন তো মাঠে ফুটবল পিটিয়ে ধুলোবালি, জলকাদা মেখে ঘরে ফেরে। ঘরে ফিরেই নানারকম বায়ানাক্কা। গোধূলি কত অপূর্ব পট সাজায়, আনখেয়ালে সে দেখার সময় থাকলে তোরাও বলতিস সাঁঝ— নিজের মনেই আওড়ায় টুসি আর বুবাই-এর মা। এ বড় আদরের ডাক, নরম করে কানে কানে ডাকতে হয় ।

আগে ওদের বাবা আপিস থেকে ফিরলে ছাদে দাঁড়িয়ে গোধূলির আদরটুকু গায়ে মেখে নিত উভয়ে। সুধাময়ের আদরের মিনুর এলানো হাতখোঁপায় ধীরে জ্যোৎস্না এলিয়ে পড়ত। স্বামীর কোলঘেঁষে সোহাগী হাসি দিত মিনু ছেলেমানুষের মতো। স্ত্রীর ছদ্ম বিরক্তি ঝরে পড়তো সন্ধের মিহি আলো আঁধারির সঙ্গমে। আবিল হত দত্ত বাড়ির কর্তা সুধাময়ের মন। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে মুখে কাপড় চেপে টুসি, বুবাই-এর মায়ের গাঢ় গলা ভেসে আসত, ‘‘বুড়োবয়সে তোমার ভীমরতি! ছেলেপিলে এখনই ঘরে ফিরবে! সাঁঝ উতরে গেলে আমার গোপালেরও গোঁসা হবে।’’

ওপার বাংলা থেকে এপারে আসার সময় মূলেচুলে সবই গেল, ঘরের গোপালকে বুকে আঁকড়ে নিয়ে এসেছিলেন সুধাময়ের ঠাকুমা। সেই ধারা বজায় রেখে তার স্ত্রী এখন  গোপালকে বুকে আঁকড়েই থাকে। মিনুর মুখে ‘সাঁঝ লাগা’ শব্দটি বড় নেশা ধরায় সুধাকরের মনে। মিনু গোপালকে আদর করে, খাওয়ায়, গা মোছায়, ঘুম পাড়ায়। গোপালের মনে কষ্ট হল না কি তার খোঁজ করে।  মিনু স্বামী সে যত্নের আবেশটুকু নিজের গায়ে মেখে নেয়। এভাবেই একের পর এক সাঁঝ নামে, সাঁঝ গাঢ় হয়…

মেয়ে একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘‘ওই পিতলের গোপলুটা অনেকটা পুতুলের মতো! তুমি ওরকম কর কেন মা! পুতুল কি অত বোঝে?’’

কড়া চোখে মেয়ের দিকে চেয়েছিল মিনু। ‘‘কেন? যত আদর তোরাই নিবি! সে হচ্ছে না!’’

গোপালের পছন্দ— তাই বুবাই কোথা থেকে জানি একটা বড়, লম্বা ময়ূরের পালক এনে দিয়েছে মাকে! কি অপূর্ব তার বরণ! সেটা ক্যালেন্ডারের খাঁজে আটকে রেখেছে মিনু।

—”তোমার গোপালের মাথায় পড়ালে না কেন?”

—‘‘না রে বুবাই , অত বড় পালকের ভার গোপুর সইবে না। তার চেয়ে আমি পালকের আরাম বুলিয়ে ওকে ঘুম পাড়াবো।“

সেই থেকে ওই ব্যবস্থা। এরপরে ছেলের অভিযোগ আর মেয়ের আব্দারের যৌথ যুগলবন্দীশে মাকে কত বার যে গরাস মেখে খাইয়ে দিতে হয় রাতের খাবার। ঘুমপাড়ানি গানও গাইতে হয় রোগে, সন্তাপে, আনন্দে, দুঃখে। খাবার টেবিলের এঁটো থালা কাচিয়ে নিয়ে চাট্টি লঙ্কা বেশি করে ডলে হুশহাশ দুপুরের খাবারের পাততাড়ি গোটান  দত্তবাড়ির কর্ত্রী। ছেলে-পিলে আর তাদের বাবা স্কুল, কলেজ, অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলেই অনন্ত দুপুর জীবন জানালার ধারঘেঁষে উঁকি দেয়। তিনিও তাই খাওয়া দাওয়ার পিছনে সময়কে বয়ে যেতে দেন না। এলোচুল মেলে অলস দুপুরের একচিলতে রোদ্দুর গায়ে মেখে উলকাঁটা নিয়ে বসেন।  বাঙলায় উৎসবের অপর নাম শীত ঋতু। পিঠে রোদ্দুর নিয়ে রঙ বেরঙে জীবন গেঁথে রাখার সুখ অনেকটা গোপন প্রেমের মত। বারংবার ছেলেমেয়ের শারীরিক মাপজোখের অছিলায় সে সুখ ছোঁয়া পড়ে। ওরা বোঝে না সেকথা। কত্তা স্নেহভরে বলেন, ‘‘এত পরিশ্রমের পর আবার দুপুরে উলকাঁটা কেন! একটু আরাম করতে পারো তো!’’ ছেলেমেয়েরা ঠোঁট উল্টে বলে, ‘‘এ পুরনো স্টাইল, আজকাল চলে না!’’ এদিকে আবার পরেও নেয়।

ঘুমন্ত ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিশফিশ করে মা, ‘‘এসব চিরকাল স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে। তোদের বড় হয়ে ওঠার সময়টা বাধা পড়ে থাকবে রঙিন উলকাঁটায়।’’

রাত গভীরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ক্লান্ত স্বামীর বুকে মাথা রেখে মন অকারণে হু হু করে ওঠে। সুধাময় বলেন, “এই দ্যাখো ! বিকেলের সখের সাজটি যে নষ্ট হবে তোমার…”

বিকেল হলেই চওড়া পাড় তাঁতের শাড়ি পরে গা ধুয়ে, পরিপাটি চুল বেঁধে পরিচ্ছন্ন থাকা মিনুর বরাবরের অভ্যেস। সুধাময়ের স্ত্রী-র মৃদু স্বর গুনগুন করে, “হোক নষ্ট, আমার অভ্যেস তাতে নষ্ট হয় না।’

তা হয়না। হওয়ারও নয়, বরং ছাপ রেখে যায় স্মৃতি হয়ে দত্ত বাড়ির আনাচেকানাচে!

দুপুর

বাবুর সঙ্গে কথা হয়েছিল এগারটা থেকে চারটে হবে ডিউটির টাইম। এদিকে বুড়ি বিড়বিড় করে ‘‘ধন্যি, দুপুরবেলায় কে কার বাড়িতে হুটপাট করে আসে শুনি?’’ এখন কে চাট্টি রাঁধে, কে-ই বা খেতে দেয়!’

“ও দিদা ! গরম গরম ঝোল ভাত খাইয়ে দিই তোমায়? এসো!’

—‘‘না না! এসব একঘেঁয়ে রান্না মুখে রোজ রোজ মুখে তুলবে আমার বুবাই, টুসি ? না কি উনাকেই এসব দিই প্রতিদিন!’’

কাঠের সোফায় নেতিয়ে থাকা শীর্ণ জিরজিরে মুখ, চেহারার মধ্যে থেকে তীব্র উজ্জ্বল আলো ফেলে নিজেকেই খুঁজে চলে বৃদ্ধা! এ খোঁজ অন্তহীন। কেউ বলেনি তাকে শেষ কোথায় ! আজকাল তেমন করে শুরুই বা করা হয়  কই! রাত্রে শোওয়ার লোকটা এককাপ চা আর ছোট বাটিতে শুকনো মুড়ি টেবিলে ঢাকা দিয়ে রেখে চলে যায়। ভাবে বুড়ির ক্ষমতা নেই সকাল সকাল ওঠার । 

এদিকে রাজ্যের কাজ পড়ে থাকে তার। আগের মতো সংসারের জোয়াল টানার ক্ষমতা নেই বলে কি নজর থাকে না নাকি কোনওদিকে! মনে মনে খুব একচোট হেসে নেয় মিনতি। আদরের মিনুর জন্য লোক রেখেছেন কত্তা! এদিকে সে মেয়ে তো দুপুর গড়িয়ে কাজে আসে। 

—‘‘ও দিদা , তোমার যে ওষুধ খাওয়ার টাইম হয়ে গেছে।”

গোপালের সামনে হাতজোড় করে মাথা নোয়াতে না নোয়াতেই অমনি টিকটিক করা! আজকাল পিঠের ব্যথার জন্য মাথা নোয়াতে পারেন না মিনু। তা-ও গোপালকে অভুক্ত রেখে তিনি কিচ্ছুটি মুখে দেন না। দুধসাদা বিছানার পাশে আধখাওয়া চায়ের কাপে মাছি ভনভন করে, মুড়ির বাটি আলগোছে উল্টে পড়ে থাকে। পাশের বাড়ির ধূর্ত বিড়াল মাছ, দুধের খোঁজে নিশ্চয়ই এসেছিল। মনে মনে বিড়ালকেই গাল পারেন মিনতি…

—‘‘হতচ্ছাড়া , লোভী বেড়াল আমার বুবাই, টুসির দুধটুকুতে নিশ্চয়ই মুখ দিয়ে গেছে!”

নড়বড় করে দু-চার পা ফেলে এগিয়ে যেতেই সুস্মিতা মিনুকে ধরে নেয়। প্রায় দৌড়ে গিয়েই আঁকড়ে ধরে সে। মোটা টাকার বিনিময়ে ঘণ্টা পাঁচেকের ডিউটি। এখনই সাত সমুদ্দুর তেপান্তরের পার থেকে ফোনাফোনি শুরু হবে। এ শহরে না থাকলেও বাবুর অনেক চেনাজানা। বুড়ির ভালমন্দ কিছু হয়ে গেলে অত সহজে তার রেহাই নেই! এদিকে গাইয়ে বর নিজের গান ছাড়া অন্য কোনওদিকে মন দেয় না। বাবার মতের বিরুদ্ধে এই লোককে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল সুস্মিতা। রোজগারপাতির ঠিকানা নেই সংসারের শুরু থেকেই । তখন মেয়েটার স্বপ্ন ছিল, অন্তত তাকে বুঝবে মানুষটা। দিনের শেষে ক্লান্তি জুড়িয়ে যাবে দুদন্ড কথা বলে। কিন্তু তার গায়ক বরের মধ্যরাত অবধি আলাপ, আলোচনা, ফোন চলতে থাকে। বুড়ি মানুষটার কাছ থেকে বাড়ি ফিরতে মনই হয় না আজকাল। কার জন্য ফিরবে সে! ঘড়ির কাঁটা চারটে ছাড়িয়ে প্রায়শই ছ’টা আটটার দিকে এগিয়ে যায়। অবশ্য একঘেয়ে রোজনামচা মাঝেমধ্যেই রামধনুর মতো রং বদলায়। বুড়ি আনখেয়ালে বিড়বিড় করে, সুস্মিতা কান পেতে রাখে—

“কত যুগ আগেকার সেসব কথা! এইরকম ফাগুন চাঁদের রাতে আমাদের চারচোখের মিলন হয়েছিল!  আজ তুমি চলে যাও মেয়ে! স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বাইরের মানুষের থাকা আমার পোষায় না! যাওয়ার আগে ওই আমার উনিকে ডেকে দিও। ঘরকুনো মানুষটা দিনরাত বই আর দাবা নিয়েই  কাটিয়ে দেয়!“

—‘‘তাহলে আজ তোমাকে সাজাবো দিদা!” বুড়ির তোবড়ানো ভাঙা গালের খোনা হাসিতে যোগ দেয় একটি তরতাজা হাসি! বহুদিন পর মলিন ধুলো পড়া দত্তবাড়ির আনাচকানাচ ঝলমলিয়ে ওঠে।

—‘‘ওরে আমার উনি সাজালেন! একা আমাকে সাজালে হবে!”

হাসতে হাসতে পাশের ঘরে দাদুর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে ক্ষমা চেয়ে আসে সুস্মিতা। এই ছদ্ম আনন্দটুকু তার নিজের জন্যও যে খুব দরকার ছিল। ছদ্ম অথচ কত গভীর সেসব অমলিন মুহূর্ত। চোখ কড়কড় করে তার। এরকম জমিয়ে রাখা মুহূর্ত সুস্মিতার জীবনে থেকেও নেই, যে ভাঁড়ার থেকে জীবনভরের রসদ জোগাড় করে মানুষের মন!

রাত্রি

দত্তবাড়ির রাত্তিরের আখ্যান একাধারে সুপ্রাচীন ও চিরনতুন। দিনের আলোর আনন্দ, উল্লাস, যন্ত্রণা বা যাপন এসময় নিজের সময়ে এসে থিতু হয়। খুটখাট শব্দে বন্ধ ঘরের আগল খুলে ঈশ্বর ঘন আঁধারে মিশে যেতে যেতে মুচকি হাসেন । ঠিক তখনই জানালার আড়ে আড়ে আলোর পরী নামে । তাদের হাতের সোনাকাঠি ক্ষয়ে গেছে। বড়ঘড়ির ছোট, বড় কাঁটায় তাল মিলিয়ে আলো গেছে কমে। তবে মরচে ধরেনি তাই এখনও পরীরা এ বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে ছুঁয়ে দেখে বুবাইয়ের বাতিল পুরনো কালো কোটটিতে ধুলো পড়ল কিনা! ওঘরের জানালার পাশে হেলানো কোলবালিশে মুখ গুঁজে টুসি ঘুমাচ্ছে না কি!

পাশের ঘরে তখন সরকার দাদার সঙ্গে বাড়ির কত্তার প্রবল লড়াই। নিজের নিজের রাজ্যপাট সামলে রাখার খেলা। এসব লড়াই নামান্তরে খেলাই তো! কারও রাজা উল্টে গেছে! কোথাও বা সিংহাসনে একচিলতে মলিন হলুদ আলো এলিয়ে আছে। কাঠের নড়বড়ে সিংহাসন যেন অপেক্ষায় পরবর্তী রাজার। কিন্তু রাজা আর আসে না। সময়ের ছোট কাঁটা  বড় কাঁটার সেতু আজ নড়বড়ে । দেওয়ালের পাঁজরে দাগ রেখে যাওয়া দিন তারিখের হিসেবে মাঝে মধ্যে আলো পড়ে। রাত্তিরের দরজা তখন পরীরাই খুলে দেয় । সাদরে নরম পালক বুলায় বাতিল পড়ে থাকা সেকেন্ড, মিনিট ও ঘণ্টার গোলকধাঁধায়। এসব গলিঘুঁজির রাস্তা একসময় গিয়ে মেশে বাড়ির ছাদের কার্নিসে। ইঁটের হৃদয় চিড়ে যেখানে সবুজ প্রাণ হাত পা মেলেছে আকাশে। রাতকথার অন্দরে আবছা হয়ে ছায়া পড়ে একটি অবয়বের সাথে জড়িয়ে থাকা অপর একটি অবয়বের। তারা কথা কয়, তাদের চোখের দু ফোঁটা মুক্তোতে গুনগুনিয়ে একলা সুর সাধে জীবন।

মিনু , দত্ত বাড়ির কর্ত্রী বিছানায় শিশুর মত জড়োসড়ো হয়ে জায়গা ছেড়ে দেন… কত অতিথি অভ্যাগত আসবে আজ । আলো জ্বলবে আনাচেকানাচে… গমগম করবে বাড়ি …

টুসি, বুবাইরা ওই তো এসে গেছে! সুধাময়বাবু চিলেকোঠায় শক্ত লাঠি আঁকড়ে দাঁড়ান ! অনেক উপর থেকে তিনি দেখেন। তাঁর সময় কখনও সমে আসে না…

নিয়ম করে দত্ত বাড়ির প্রবাসী মানুষগুলি প্রতি বছরই বাড়ি ফেরে। নাতি নাতনীরা তাদের দাদু দিদার ফটোতে খুব সাজায়। সুগন্ধী মালা, চন্দন, ফুলে ঈশ্বর আরেকবার মুচকি হেসে ফিরে যান । তাঁর তখন অনেক কাজ … ছাদে পায়রাগুলো দানাপানি না পেয়ে ঘুরঘুর করবে …হেঁসেলে রান্না শুরু নাহলে টুসি, বুবাইরা খাবে কি! এদিকে দুপুর হলেই সুস্মিতা আসবে এ বাড়ির গিন্নিকে সাজাতে, খাওয়াতে, মাখাতে…

আজ বহুযুগ পরে দত্তবাড়ির সব ঘড়িগুলি একসাথে ছুটতে থাকে …টিক টক…টিকটিক…ঢং ঢং …

“সুপরিচিত আলোকচিত্রশিল্পী অভিজিৎ চক্রবর্তীর কিছু সাদা কালো ছবি থেকে উড়ান গল্পের সূত্র খুঁজে পেয়েছি। অভিজিৎ চক্রবর্তীকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।”