(শাহজাহান-মমতাজের স্মৃতিবিজড়িত বুরহানপুরে ঘুরে এসে লেখাটি লিখেছেন অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়)

যমুনার তীরে আগ্রাতে নয়। বরং তাপ্তি নদীর ধারে ‘দাক্ষিণাত্যের দরওয়াজা’ বুরহানপুরেই প্রিয় মমতাজের স্মৃতিতে তাজমহল গড়ার কথা প্রথমে ভেবেছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। ইন্দোর থেকে একশো আশি কিলোমিটার দূরে, ইতিহাসের পাতায় মুখ লুকিয়ে থাকা বুরহানপুরে একদিন সম্রাটের সঙ্গী হয়ে এসেছিলেন অসুস্থ মমতাজ। সেখানেই মৃত্যু হয়েছিল মুঘল সাম্রাজ্ঞীর। ছয়মাস বুরহানপুরেই রাখা ছিল তাঁর দেহ। তারপর ১৬৩১ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে, মমতাজের দেহ কফিন বাক্সে নিয়ে আসা হয় আগ্রায়, শায়িত করা হয় তাজমহলে। তারপর থেকে শাহজাহান আর ফিরে যাননি প্রিয় শহর বুরহানপুরে। প্রেমিকার স্মৃতি বিজড়িত প্রাসাদ থেকে বাকি জীবন মুখ ফিরিয়ে থাকতে চেয়েছেন তিনি।

একাকী এক হৃদয়, আহুখানা

রোজই আগ্রায় তাজমহল দেখতে যান দেশবিদেশের মানুষ। বেগম-প্রেমিকা মমতাজের স্মৃতিতে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের গড়া অবাক করা সৌধ তাক লাগিয়ে দেয় পর্যটকদের। কিন্তু ইতিহাসের নির্জনতার সাক্ষী হয়ে রয়ে গিয়েছে শাহজাহান-মমতাজের প্রেমের শহর। মমতাজমহলের জীবনের শেষ দিনগুলির স্মৃতি আর মুঘল সম্রাটের সঙ্গে তাঁর প্রেম কাহিনী আজও ভেসে বেড়ায় বুরহানপুরের প্রাসাদে।

মমতাজের জীবনের শেষ দিনগুলির কথা আর আগ্রায় তাজমহল তৈরির আগের ঘটনা শোনানোর আগে বুরহানপুরের ইতিহাসকে কিছুটা জেনে নিতে হবে।

 মুঘলদের প্রিয় এই শহরের গোড়াপত্তন করেছিলেন ফারুকী সুলতানরা। দিল্লির সুলতান ‘ফিরোজ শাহ তুঘলক’, ১৩৭২ খ্রীষ্টাব্দে ‘মালিক অর্জা ফারুকী’কে থালনেরের জায়গীরদার নিযুক্ত করেন। তিনি নিজের কৃতিত্বে জমিদারির সীমানা বাড়িয়ে নেন।  ১৩৮২ খ্রীষ্টাব্দ (অন্যমতে ১৩৯৯ খ্রীষ্টাব্দ) থেকে  ‘মালিক আহমেদ খান রাজা’, তুঘলকি বংশের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে স্বাধীন ভাবে রাজ্য শাসন শুরু করেন,  রাজ্যের নাম দেন ‘খান্দেশ’। তিনি ‘উমর-উল ফারুক’ উপাধি নিয়েছিলেন,  তাঁর নাম থেকেই শুরু হয় ‘ফারুকী সাম্রাজ্য’। বুরহানপুর ছিল খান্দেশের রাজধানী, ১৬০১ খ্রীষ্টাব্দে আকবর ফারুকীদের থেকে ছিনিয়ে নেন ‘অসিরগড় দুর্গ’, খান্দেশ করায়ত্ত করেন। অসিরগড় ও বুরহানপুর থেকেই মুঘলরা দাক্ষিণাত্যের উপর নজরদারি চালাতেন। বুরহানপুরের ভৌগোলিক,  রাজনৈতিক ও সামরিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ‘দাক্ষিণাত্যের দরওয়াজা’ বলা হতো একে। মুঘল জমানায় বুরহানপুরকে বলা হতো ‘দ্বার-উস-সুরুর’ .. ‘স্বর্গের দরওয়াজা’, অনেকে বলতেন, ‘দ্বার-উল-আয়ার’  যার অর্থ, ‘সেরার সেরা’!   

তাপ্তি নদীর তীরে শাহী কেল্লা

মুঘল জমানায় রীতিই ছিল, দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা, মুঘল শাহী পরিবারের হতে হবে। আকবরের পুত্র ‘দানিয়েল’ ও পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গীর তাঁর পুত্রদের— ‘শাহ পারভেজ’ ও ‘খুররম’ (শাহজাহান)কেও এখানকার শাসনকর্তা করে পাঠিয়েছিলেন।

মুঘল সম্রাটদের মধ্যে বুরহানপুরে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন শাহজাহানই। এটি ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। তাপ্তি নদীর তীরে ফারুকীদের তৈরী শাহী কেল্লাকে তিনি আরও সুসজ্জিত ও সমৃদ্ধ করেছিলেন। ‘দেওয়ান-ই-আম’, ‘দেওয়ান-ই-খাস’, মমতাজ মহলের ‘স্নানঘর’ তাঁর আমলেই গড়ে উঠেছিল এই শাহী কেল্লাতে।  মুঘল ও পার্সিয়ান স্থাপত্যরীতির এক অনবদ্য নিদর্শন ‘শাহী কেল্লা’ বা বাদশাহী কেল্লার ‘জেনানা হাম্মাম’, এখানকার ছাদের ফ্রেস্কো ও মোটিফের কারুকার্য আর তার সাথে রঙের ব্যবহার— যেন, পাথর ও রঙের বন্দিশ! মার্বেলের মেঝে, মাঝখানে ফোয়ারা, মাথার ওপরে গম্বুজে মৌচাকের নকশা, নীল লাল হলুদ সবুজের গোলাপ, টিউলিপ ও নানা ফুলের সমারোহের চিহ্ন, ফিকে হয়ে গেলেও রঙ মুছে যায়নি এখনও। দেওয়ালের পাথরে মাছের আঁশের নকশা খোদাই করা, তার ওপর জল পড়লে মনে হয় মাছ সাঁতার কাটছে। দেওয়াল বেয়ে নেমে আসতো ঝর্ণার মতো ঠান্ডা ও গরম জল, হামামের মধ্যবর্তী পুলটির গভীরতা এক দশমিক আট মিটার, এখানেই মমতাজমহল নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন পরিচারিকাদের সাথে জলকেলিতে।

আকবরের পুত্র দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা শাহাজাদা দানিয়েল, শিকার অভিযানে এখানে প্রায়ই আসতেন, তিনিই তৈরী করেন ‘আহুখানা’, মানে ‘হরিনের বাগান’, মমতাজের প্রিয় ছিল আহুখানা, এখানেই তিনি গড়ে তোলেন গোলাপ বাগান, যা ছিল তৎকালীন সময়ে মধ্যভারতের সেরা!

শাহী কেল্লায় মমতাজের হামাম

১৬৩০ খ্রীষ্টাব্দে, শাহজাহান দাক্ষিণাত্যের শাসনকার্য্যে অখুশি হয়ে আবার বুরহানপুর এলেন, যথারীতি মমতাজও এসেছেন— সম্রাট যে তাঁকে ছাড়া থাকতে পারেন না। মুরাদ বক্সের জন্মের পর, ১৬২৫ থেকে ১৬৩০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি, বয়স ও হয়েছে তাঁর, শরীর দুর্বল, রক্তাল্পতায় ভুগছেন, তবুও অসুস্থ শরীরে সম্রাজ্ঞীকে আসতে হয়েছে বুরহানপুর। এবারেও, তিনি অন্তঃসত্বা!

সম্রাট শাহজাহান তখন যুদ্ধক্ষেত্রে,  খবর পেলেন চতুর্দশ সন্তানের মা হয়েছেন মমতাজ। কন্যা সন্তান, কিন্তু সম্রাজ্ঞী ভীষণ দুর্বল ও কাহিল!

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দ্রুত ছুটে এলেন সম্রাট, শাহী কেল্লায়, হাকিম-উল-মুলুক, ‘ওয়াজির আলি খান’ জানালেন,  বেগম নিদ্রায়, কোনওরকম উত্তেজনা তাঁর শরীরের পক্ষে ভাল নয়, সম্রাজ্ঞী একটু সুস্থ হলেই জাঁহাপনাকে এত্তেলা করা হবে।

মধ্য রাতে দরজায় করাঘাত, জাঁহাপনার হুকুমে, দ্বাররক্ষী দরওয়াজা খুলে দিলেন!সম্রাজ্ঞীর অবস্থা সঙ্গীন, মুমূর্ষু! সম্রাটকে একবার চোখের দেখা দেখতে চান!

মমতাজমহলের মকবারা

সম্রাট এসে দাঁড়ালেন জেনানামহলে মমতাজের পাশে। নিজের হাতে তুলে নিলেন তাঁর পাণ্ডুর হাত। শয্যার পাশে তখন বেগমের খাস পরিচারিকা সাতিউন্নিসা ও হাকিম ওয়াজির আলি খান। কথা বলার শক্তি হারিয়েছেন বেগম, চোখের কোন দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। বড় আদর করে সম্রাট নিজের হাতে মুছিয়ে দিলেন তাঁর ‘দিল-কা-কলিজা’র চোখের জল!মমতাজের পাশে বসে থাকতে থাকতে একসময়ে নিজেও কান্নায় ভেঙে পড়লেন গোটা ভারতের অধীশ্বর।

সূর্যোদয়ের আগেই মৃত্যু হল মমতাজের(৭ জুন, ১৬৩১ খ্রীষ্টাব্দে)। ধীর পায়ে সম্রাট ফিরে এলেন নিজ কক্ষে, অর্গল তুলে দিলেন, পরের আট দিন নাকি সেই অর্গল উন্মোচিত হয়নি। জানা যায় না, সম্রাট কী করে ছিলেন ওই আট দিন!

ইতিহাসবিদদের মতে, মমতাজের দেহ তাজমহলে শায়িত করার আগে প্রথমে শাহী কেল্লায়, তারপরে নিয়ে আসা হয় বুরহানপুরের কাছে আহুখানাতে, এখানেই মমতাজ ছয় মাস শায়িত ছিলেন!

মমতাজের মৃত্যুর পর, সূর্য্ যখন ঢলে পড়তো, তাপ্তি নদীর জলে এসে পড়তো তার ছায়া, আহুখানার  সোপান বেয়ে মকবারায় উঠে আসতেন সম্রাট, বিশ্বস্ত প্রহরী পাহারা দিত বাইরের দরজায়, আর মমতাজের কবর আলিঙ্গন করে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়তেন সম্রাট…।

সম্রাট প্রতিদিন তাঁর প্রিয় বেগমের কবরে দিয়া জ্বালাতেন,  মৌলবীরা কোরান পাঠ করতেন, হিন্দু পণ্ডিতেরা উচ্চারণ করতেন বেদের মন্ত্র, আর সারা মকবারার চিরাগদানগুলিতে জ্বলে উঠতো চিরাগ…আকাশ জুড়ে বেজে উঠতো সম্রাটের ‘একলা থাকার সুর’!

দ্বার-উল-আয়ার, অসিরগড়

তাপ্তি নদীর তীরে এই বুরহানপুরেই মমতাজের স্মৃতিতে তাজমহল তৈরির কথা ভেবেছিলেন শাহজাহান। তবে সেই পরিকল্পনা ত্যাগ করতে হয়েছিল তাঁকে। ইতিহাসবিদদের মতে, এর কারণ হল, তৎকালীন সময়ে রাজস্থানের মাকরানা থেকে সাদা মার্বেল পাথর এখানে নিয়ে আসা ছিল দুরূহ। আর পরিকল্পনাকাররা যে মাপের, যে ব্যাপ্তিতে সৌধকে ভেবেছিলেন, এখানকার মাটি হয়তো সেই ভার বহন করতে পারতো না!

তাজমহলের সঠিক স্থান নির্বাচনে ছয় মাস সময় লেগে যায়। ওই ছয় মাস মমতাজের দেহ বুরহানপুরেই রাখা ছিল। কিন্তু কোথায় রাখা হয়েছিল প্রিয় বেগমের দেহ, কীভাবেই বা অবিকৃত অবস্থায় রাখা হয়েছিল— ইতিহাসে কোনও তথ্যনির্ভর সূত্র পাওয়া যায় না! অনেকে মনে করেন, বেগমের দেহ ইউনানী পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। একটি কাঠের বাক্সে কর্পূরের গুড়ো, চন্দনের গুড়ো, বাবলা ও নিম গাছের ডাল পাতা দিয়ে সুতির কাপড়ে জড়িয়ে রাখা হয় বেগমের দেহ। যদিও এই ভাবে একটি দেহ অবিকৃত অবস্থায় থাকতে পারে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হয় বই কি!

কেউ কেউ মনে করেন, আহুখানাতে জলের বড় পুলের(হৌজ)মাঝখানে চতুস্কোন প্লাটফর্মে কবর দেওয়া হয় মমতাজকে। আবার অন্য মতে, তাঁকে আহুখানার বরদারিতেই সমাধিস্ত করা হয়েছিল। কারও মতে, মমতাজকে আহুখানা থেকে একটু দূরে তাপ্তি নদীর তীরে কবর দেওয়া হয়েছিল।              

১৬৩১ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মমতাজের দেহ কফিন বাক্সে নিয়ে আসা হয় আগ্রায়, শায়িত করা হয় তাজমহলে। মহাভাত খানকে দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে, ১৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে শাহজাহান বুরহানপুর ত্যাগ করেন, আর কোনওদিন ফিরে যাননি তাঁর স্বপ্নের সেই শহরে!

ছবি : লেখক

সহায়ক গ্রন্থ সূত্র:

১। Madhya Pradesh District Gazetteer:East Nimar,Indore(1992),

২। ‘মধ্য যুগের ভারতীয় শহর’, অনিরুদ্ধ রায়

৩। ‘লা-জবাব দেহলী অপরূপা আগ্রা’, নারায়ণ সান্যাল

৪। Madhya Pradesh District Gazetteer, 1969

৫। ‘তাপ্তি তট আউর তাকত’, ঘনশ্যাম মালব্য