‘‘লতা তুম দেখনা, ইয়ে গানা বহুত চলেগা। লোগ হামেশা কে লিয়ে ইসে ইয়াদ রাখেঙ্গে।’

অন্তরের বিশ্বাস থেকে কথাগুলি বলেছিলেন কবি প্রদীপ। সালটা ১৯৬৩। সেই বছরেই রচনা হয়েছিল একটি গান। গীতিকার— কবি প্রদীপ আর সুরকার, সি রামচন্দ্রন। প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান হবে দিল্লিতে। ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধে মৃত ভারতীয় সৈনিকদের স্মৃতির উদ্দেশে অনুষ্ঠান। সেদিন দিল্লির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে উপস্থিত রাষ্টপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ ,প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ,তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী। হাজির হয়েছেন গণ্যমাণ্য অনেকেই । মঞ্চে উঠলেন লতা মঙ্গেশকর। তাঁর গলায় প্রথম গান একটি ভজন, আল্লা তেরো নাম। তারপর সেই বিখ্যাত গান— এ মেরে বতনকে লোগো …।  বাকিটা ইতিহাস।

এই ২০২২ সালেও  যে গান মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। হয়তো আজ থেকে বহু বহু বছর পরেও প্রতিটি ভারতীয়কে অনুপ্রাণিত করবে এই গানটি। ২৭ জানুয়ারি, ১৯৬৩। ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে নানা গুণীজনের সামনে প্রথম গাওয়া হয়েছিল এই গান। কথা ছিল একটিবার মাত্র সেটি গাওয়া হবে। কিন্তু মানুষের ভাল লাগা সব কিছুকে উল্টেপাল্টে দিল। ১৯৯৭ সালে ৯ই মার্চ একটি লাইভ অনুষ্ঠানে লতা মঙ্গেশকার বলছিলেন, ‘‘৩৩ বছর আমাকে এই গান গাইতে হচ্ছে । এমন কোনও অনুষ্ঠান নেই যেখানে আমাকে এই গানটি শোনাতে অনুরোধ করা হয়নি।’’ গানটিকে লতা বলে থাকেন তাঁর সিগনেচার টিউন (Signature tune)। তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক গানটির ইতিহাস।

লতা বলেছিলেন, কবি প্রদীপের কথা সেদিন আমার বিশ্বাস হয় নি। যে গান কোনও সিনেমায় ব্যবহার করা হচ্ছে না , একবার শুধু প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে গাওয়া হবে, কী করে সেই গান চিরশাশ্বত হবে?  আমি সেদিন ওঁর কথা বিশ্বাস করিনি। তবে শুনেছিলাম, কী ভাবে তিনি গানটি লিখেছিলেন। মুম্বইয়ের তাজমহল হোটেলের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন কবি প্রদীপ। হঠাৎ তাঁর মাথায় আসে একটি গানের কথা। হাতের কাছে নেই কোনও খাতা-পেন।  কী কররেন? পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট  বের করে ছিড়ে  ফেললেন। যাক, পাওয়া গেল এক টুকরো কাগজ ! কিন্তু কলম কোথায় পাবেন? কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা  করলেন, একটা পেন হবে? শেষপর্যন্ত একজনের থেকে পাওয়া গেল কলম। খস খস করে কবি প্রদীপ লিখে ফেললেন গানটির শুরুর অংশটি। সেই সময় তিনি সিনেমার গান লিখতেন। প্রতি গানে মিলত ২০০ টাকা ! তবে এই গানটি লিখে পরম যত্নে রেখে দিলেন কোটের পকেটে।

১৯৬২ সালে চিনের সঙ্গে  যুদ্ধে হেরে যায় ভারত। গোটা দেশ শোকে ডুবে। সেই সময় ভারত সরকার ঠিক করল, দেশের সেনাবাহিনী ও নাগরিকদের মানসিক ভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই দিল্লির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।

ডাক পড়ল আমার। অনুষ্ঠানটিতে  গান গাইতে হবে। এমন অনুষ্ঠানে আমি গান গাইবো শুনে কবি প্রদীপ চলে এলেন আমার বাড়িতে। তাঁর হাতে একটি গানের লিরিক। আমাকে বললেন, তুমি এই গানটি গাইবে। কিন্তু আমার তখন ভীষণ ব্যস্ত সিডিউল। সারা দিন নানা সিনেমার গান গাইতে হচ্ছে। বললাম, না আমার দ্বারা হবে না। অনুষ্ঠানের মাত্র দশ দিন বাকি। এই সময়ের মধ্যে গান তুলে সেই গান গাওয়া অসম্ভব। কিন্তু কবি প্রদীপ গোঁ ধরে রইলেন। সেই গানটাই গাইতে হবে। ডাক পড়ল সি রামচন্দ্রনের। তাঁর পছন্দ হলো লিরিক। বললেন, ঠিক আছে গানটির সুর আমিই দেব। তবে লতা যদি গাইতে না পারে আশা গাইবে।

গোঁ ধরলেন কবি প্রদীপ। না, আমি গানটি শুধু লতার কথা ভেবে লিখেছি। ওঁকেই গাইতে হবে।

 ঠিক আছে, আমরা দু’জনে গাই। আমি একটু আনন্দ পেলাম বোনের সঙ্গে ডুয়েট গাইবো বলে। রাজি হয়ে গেলাম, আশা আর আমি দু’জনে মিলে গানটি গাইতে। না, আমি এই গানের স্ক্রিপ্ট ছিড়ে  ফেলব, লতা একা  যদি গানটি না গায়— আবার গোঁ ধরলেন প্ৰদীপজি। কিন্তু আমি জোর করায় কবি তিনি রাজি হলেন। গানটি সুর দিলেন সি রামচন্দ্রন। পুরো গানটি অর্কেস্টেড করলেন হেমন্তকুমার মানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আমি আর আশা দু’জনে গানটি অনুশীলন করলাম। কিন্তু যাবার দিন আশা এসে বলল, না দিদি আমি দিল্লি যাচ্ছি না। তার মানে! পুরো গান আমাকে একা গাইতে হবে !

এই প্রথম গান করতে গিয়ে আমি নার্ভাস। কি হবে? পারবো তো? সি. রামচন্দ্রন আগেই চলে গিয়েছেন দিল্লি। আমি আমার কাছের বন্ধু নলিনী মাত্ৰেকে নিয়ে চেপে বসলাম বিমানে। সঙ্গে একটা টেপ রের্কডার। সব সময় শুধু গানটি শুনে যাচ্ছি আর প্র্যাকটিস করছি ভিতরে ভিতরে। প্লেনে আমার যাত্রাসঙ্গী দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর, মেহবুব খান, মদনমোহন আর শঙ্কর জয়কিশান।

বিমান থেকে নেমে ভীষণ মাথা ধরেছে। কি করে গাইবো আমি! যন্ত্রনায় পারছি না। নন্দিনী উৎসাহিত করল আমাকে। তুমি আজ দারুন গান গাইবে। দু’টি গান গাইলাম আমি। তারপর স্টেজ থেকে নেমে এক কাপ কফি নিয়ে সবে বসেছি, সেই সময় আমার কাছে এলেন মেহবুব খান সাহেব। “চল, পন্ডিতজী (নেহেরু ) বুলা রাহা হ্যায়।”

পন্ডিতজি! আমাকে! মেহবুব সাহেবের সঙ্গে একটি ঘরে গিয়ে দেখি, সেখানে উপস্থিত রাধাকৃষ্ণণজি,পন্ডিতজি ,ইন্দিরাজি ছাড়াও আরো অনেক স্বনামধন্য লোক। আমাকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়ালেন। মেহবুব সাহেব পন্ডিতজিকে বললেন, “ইয়ে  হ্যায় হামারি লতা, আপকো কায়সা লাগা উসকা গানা।” পন্ডিতজি বললেন, “বহুত আচ্ছা ! মেরে আঁখো মে পানি আ গেয়ি।” পন্ডিতজি আমাকে আবার জিজ্ঞসা করলেন, তুমি কি বোম্বাই ফিরে গিয়ে গানটি রেকর্ড করবে? আমি বললাম, না! এই গানটি শুধু এই অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হয়েছে ।

পন্ডিতজিকে যে কথা বলেছিলাম, সেটা কিন্তু রাখতে পারিনি। তারপর থেকে যত প্রোগ্রাম করেছি, সব জায়গায় আমাকে এই গানটি গাইতে হয়েছে। মানুষের মধ্যে মিশে গেছে এই গান। কিন্তু একটা দুঃখ থেকে গেছে আমার মনে। গানটি তৈরি হয়েছে যাঁর জন্য কোনওদিন তিনি তাঁর প্রাপ্য সন্মান পাননি*। কবি প্রদীপকে সেই অনুষ্ঠানে ডাকা হয়নি। তারপর অনেক অনুষ্ঠান হয়েছে। কিন্তু আমি কোথাও শুনিনি কেউ এই লোকটিকে ডেকে সম্বর্ধনা দিয়েছে। অথচ এই গান তৈরির সিংহভাগ কৃতিত্ব তাঁর। কারণ, এই গানের আসল হল লিরিক। কবি প্রদীপের লেখা শব্দগুলি প্রতিটি ভারতীয়ের মনে গেঁথে গেছে। কিন্তু এমন একটি মহান গান রচনা করেও তিনি যেন উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছেন।

*১৯৯৭ সালে কবি প্রদীপকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দেওয়া হয়। তবে লতাজি কথাগুলি বলেছিলেন তারও আগে।