পর্ব ১১

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

         “ভাই বল আর বাপ-মাই বল, মেয়ে মানুষের স্বামীর বড় আর কেউ নয়। ভাই বাপ-মা গেলে দুঃখ কষ্ট খুবই হয়, কিন্তু স্বামী গেলে যে সর্বস্ব যায়।”

—শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (বিরাজ বৌ)।

         এই বক্তব্য বেশি দিন আগের নয় এবং এখনও প্রায় সমান ভাবে প্রযোজ্য। বৈদিক যুগে নারীর বিবাহ যেমন বাধ্যতামূলক ছিল না, তেমনি স্বামী মারা গেলে বৈধব্য জীবনও সেরকম ক্লেশদায়ক ছিল না। সমস্যা হল স্মৃতির যুগে, যখন বলা হল, “পিতার কর্তব্য হল যতদিন কন্যা সৎপাত্রে বিবাহিতা না হয় ততদিন তাঁকে সর্বতোভাবে রক্ষা করা। বিবাহিত নারী স্বামীর দ্বারা এবং বৃদ্ধা অবস্থায় পুত্রের দ্বারা রক্ষণীয়া হন।” এসব কথা বলা আছে মনুসংহিতায়। তবে স্বামী মারা গেলে, উপযুক্ত পুত্র না থাকলে তাকে কে রক্ষা করবে, তার কথা বলা নেই। মনু তবুও ভাল সহমরণের কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, “পতির মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রী ফলমূল আহার করে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করবে।” তিনি বিপত্নীক স্বামীর দ্বিতীয়বার স্ত্রী গ্রহণের নির্দেশ দিলেও, স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা নারীর পুনর্বিবাহ স্বীকার করেননি।

সহমরণের কথা প্রথম শোনা যায় অথর্ব বেদে। আবার অথর্ব বেদে নারীর একাধিক পতি নির্বাচনের স্বাধীনতার কথাও রয়েছে। সে যুগে ‘সহমরণ’ ছিল নারীর ইচ্ছার ব্যাপার। সহমরণের উচ্ছসিত প্রশংসা করতে দেখা গেল বৃহদ্ধর্মপুরাণে। অবশ্য বৃহদ্ধর্মপুরাণের রচনাকাল ধরা হয় মুসলিম আগমনের পর, অর্থাৎ অনেক আধুনিক কালে। সহমরণ যা পরবর্তীকালে সতীদাহের মহিমা পায়। খ্রিঃ পূঃ তৃতীয় শতকে সহমরণের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত আছে। ৭০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সতীদাহ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সতীদাহের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিলেন রাজা রামমোহন রায়। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে ০৪ ডিসেম্বর লর্ড বেন্টিক আইন করে সতীদাহ নিষিদ্ধ করলেন।

সতীদাহের অভিশাপ থেকে বাংলা তথা ভারতীয় নারী মুক্তি পেলেও বৈধব্যের অস্পৃশ্যতা থেকে মুক্তি ঘটেনি। দয়ার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র চেষ্টা করে ১৮৫৬ সালে ২৬ শে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তন করলেন বটে, কিন্তু আজও বাঙালী সমাজ বিধবা বিবাহ আদরণীয় নয়। সতীদাহ বন্ধ হয়েছে। কারণ, প্রকাশ্য নৃশংসতা বন্ধ করার সহজ, বিধবাদের এখনও সহজে বিয়ে হয় না। কারণ, তাদের বেশির ভাগ পুরুষ ‘উচ্ছিষ্ট’ মনে করে। এই গোপন নৃশংসতা বন্ধ করা কঠিন।

আজও হিন্দুসমাজ বিধবা বিবাহ মেনে নেয়নি। অথচ বিদ্যাসাগর হিন্দুদের বিশ্বাসযোগ্য করানোর জন্য হিন্দু শাস্ত্রের সাহায্য নিয়েছিলেন। তিনি সাহায্য নিয়েছিলেন স্মৃতিশাস্ত্র পরাশর সংহিতার। সেখানে আছে- “স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, ক্লীব হইলে, সংসার ধর্ম পরিত্যাগ করিলে অথবা পতিত হইলে স্ত্রী দিগের পুনর্বার বিবাহ করা শাস্ত্র বিহিত।” অর্থাৎ স্বামী মারা গেলে নারী দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে বাধা নেই। এই অস্ত্র নিয়ে বিদ্যাসাগর তৎকালীন যুগের ধর্ম রক্ষকদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন।

পরাশর অবশ্য বিধবাদের তিনরকম পথ দিয়েছিলেন – বিবাহ, ব্রহ্মচর্য ও সহমরণ। তিনি বলেছিলেন – যে নারী স্বামীর মৃত্যু হইলে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া থাকে, সে দেহান্তে স্বর্গলাভ করে। মানুষ্য শরীরে যে সার্ধ ত্রিকোটি লোম আছে, যে নারী স্বামীর সহগমন করে, তৎসম কাল স্বর্গে বাস করে।” অর্থাৎ স্বামী মারা যাবার পর স্ত্রী কাছে বেছে নেওয়ার মতো পন্থা ছিল, সে কীভাবে বাকি জীবনটা কাটাবে। 

কিন্তু বাস্তবে তা হতো না। যারা সহমরণে যেতেন না, তারা বেঁচে থাকতেন চরম লাঞ্ছনা, অপমান ও কলঙ্কের মধ্যে দিয়ে। বিধবারা শ্বশুরবাড়ি বা বাপের বাড়ি কোথাও সমাদর পেতেন না। এজন্য তারা গৃহত্যাগী হতেন, কূলত্যাগী হতেন। আর তথাকথিত সমাজ রক্ষাকরা বলতেন বিধবারা ‘কাম’ -এর তাড়নায় কুপথে যায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর নারীর মূল্য প্রবন্ধে বলেছেন, “শতকরা সত্তরজন হতভাগিনী অন্ন বস্ত্রের অভাবে এবং আত্মীয়-স্বজনের অনাদর উপেক্ষা, উৎপীড়নেই গৃহত্যাগ করে, কামের পীড়নে করে না”।

১৮৬৯ সালে ১১ মার্চ অমৃতবাজার পত্রিকা-য় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল— কলকাতার পতিতাদের মধ্যে ৯০% বিধবা।

তাহলে দেখতে পাচ্ছি, বৈধব্য আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বারাঙ্গনাদের সুলভ করেছে। অর্থাৎ নারীপাচারের ব্যবস্থাকে সুচারু রেখেছে।

(ক্রমশ)

তথ্যসূত্র:

১. মনুসংহিতা- সম্পাদনা ও ভাষান্তর- চৈতালী দত্ত- নবপত্র প্রকাশন।

২. বাংলাদেশের ইতিহাস (১ম খন্ড) – শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার।

৩. প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য

৪. নারী – হুমায়ুন আজাদ (আগামী প্রকাশনী, বাংলাদেশ)।

৫. অন্য কলকাতা- বিশ্বনাথ জোয়ারদার (আনন্দ)।