পর্ব এক

আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।

       কথায় বলে, ‘ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার গোরু’। এর থেকেই আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান বোঝা যায়। ঘরের বউ হল একটি সম্পদ, যার দাম গোরুর থেকে কম। হবে নাইবা কেন, গোরু কিনতে গেলে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা লাগে, আর ঘরে বউ আনলে ‘পণ’-এর টাকা পাওয়া যায়। বিয়ে করে ঘরে নারী আনলে যেমন টাকা পাওয়া যায়, আবার নারী বিক্রি করলেও অর্থ পাওয়া যায়। নারী তো বেশ এক দারুণ পণ্য; কিনলেও টাকা, বেচলেও টাকা।

          মানব সভ্যতার ইতিহাসে নারীর স্থান সবদিন এরকম ছিল না। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এরকম হয়েছে। ব্যতিক্রম সবসময় ছিল, এখনও আছে। কিন্তু ব্যতিক্রম দিয়ে কোন তত্ত্ব খাড়া করা যায় না। আমরা যদি মানব সভ্যতার আদিম যুগের দিকে তাকাই, তখন মহিলাতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ছিল। ‘বিবাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানটির আমদানি হয়নি। মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে এক জায়গায় বাস করত বা যাযাবরের জীবন যাপন করত। তখন সব নারীই গোষ্ঠীর বা কৌমের সব পুরুষের ভোগ্যা ছিল, সেই সঙ্গে সব পুরুষও সব নারীর ভোগ্য ছিল। ক্রমে মানুষ যখন কৃষিজীবী হল, তখন তার মধ্যে সম্পত্তির ধারণা এল। সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসাবে নিজের সন্তানকেই চাইল মানুষ। যৌথ যৌন সম্পর্ক ছিন্ন করে পরিবারতন্ত্রে আস্থা রাখল। কৃষিকার্যে উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ কমে যেতে থাকল। উৎপাদিত দ্রব্য খাদ্য উপযোগী করতে নারীদের ভূমিকা বেড়ে গেল। গৃহকার্যে এবং সন্তান পালনেই তাকে মন দিতে হল বেশি। মহিলারা ক্রমশ গৃহবন্দী হয়ে পড়লেন। নারী হয়ে উঠলেন গৃহকর্মে নিপুণা।

          ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রাক আর্যযুগের তো কোন লেখ্য ইতিহাস বা সাহিত্য পাওয়া যায় না, তাই সিন্ধু সভ্যতার যুগের নারীর অবস্থান জানা সম্ভব নয়। আর্যদের ভারতে আগমনের পর ইতিহাস বা সাহিত্য হল বেদ। ঋকবেদের যুগে নারীর স্থান সমাজে ঠিকঠাক ছিল বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। কারণ, সে যুগে নারীরা বিবাহ না করে অথবা স্বামী মারা যাওয়ার পর বিধবা হিসাবে সসম্মানে সমাজে থাকতে পারতেন। বিদ্যাচর্চায় অংশগ্রহণ করতে পারতেন। কুমারী কন্যার কথা বলা আছে ঋকবেদে। এদের বলা হত অমাজু অর্থাৎ যারা বাপের বাড়িতেই বুড়ো হয়ে যায়; অথবা কুলপা অর্থাৎ বৃদ্ধ কুমারী। এই স্বাধীনতা কিন্তু ঋকবেদের যুগের পর ক্রমশ খর্ব হতে শুরু করে। বর্তমান যুগে যতই আমরা নারী স্বাধীনতার কথা বলি না কেন, সামাজিক স্বাধীনতা এখনও নারীর নেই। যা নারী পাচারের (Woman Trafficking) অন্যতম কারণ। এটা যথা সময়ে বিশদে বলা যাবে। অবশ্য ঋকবেদে নারীর ইচ্ছাক্রমে বা অনিচ্ছাক্রমে নারী হরণের কথা উল্লেখ আছে। বিবাহে কন্যাপণের কথা যেমন আছে, তেমনি কন্যার শরীরে ত্রুটি থাকলে বরপণের কথাও আছে।

ভোগ্যপণ্যের বাজার

        সহমরণের কথা প্রথম শোনা যায় অথর্ব বেদে। আবার অথর্ব বেদে কোন নারীর একাধিক পুরুষকে পতিরূপে গ্রহণ করার স্বাধীনতার কথাও আছে। বেদের শেষের দিকে নারী আর স্বাধীন থাকলো না। বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রে আছে,

      “পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।    

        রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি”।।

           অর্থাৎ নারীকে কুমারী কালে রক্ষা করবে পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্ররা; নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয়। নারীকে শাসন করার অধিকার পুরুষ পেয়ে গেল শাস্ত্রে। শাস্ত্রে আরও আছে ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। অর্থাৎ পুত্রলাভ করার জন্যই বিয়ে করা। নারীর আরেকটি সংজ্ঞা পেলাম, জননী। গৌতম ধর্মসূত্র বলছে ‘পশু-ভূমি-স্ত্রীনাম্ অনতিভোগ্য’ অর্থাৎ পশু, জমি ও নারী অতিভোগ্য নয়। তার মানে নারী ভোগ্য বস্তু নিঃসন্দেহে। তৈত্তিরীয় সংহিতাতে আছে ‘তস্মাদু হ স্ত্রিয়ো ভোগমেব হারয়ন্তে’ অর্থাৎ নারী সম্ভোগ আনে। প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকে নারীকে ভোগ্যবস্তু হিসাবে দেখা হচ্ছে ভারতবর্ষে। যাক, এসব নিয়ে অন্যরকম ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আমি একটু নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈদিক যুগের সাহিত্যের উদাহরণগুলি ব্যাখ্যা করলাম। উদ্দেশ্য একটাই, নারী যে অতীতকাল থেকে ভোগ্যবস্তু বা পণ্য, তার একটু আভাস দেওয়া। যা পণ্য তাই বিক্রি হবে, আর যদি সেই পণ্য বিক্রি আইনগত ভাবে স্বীকৃত না হয়, তাহলে তা পাচার হবে; যা বর্তমানে হচ্ছে।

তথ্য ঋণ: প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য

                                               [ক্রমশ]