জনগণের মন পড়বার দায় কার কতখানি, তা নিয়ে দড়ি টানাটানি চলতেই থাকে। ফি-বছর ১৫ই অগস্ট আসে আর যায়। আপিসের ড্রেস কোডে তেরঙা ভ্যারিয়েশন। নয়া উদারবাদের নীতি মেনেই পঁচাত্তরে স্বাধীনতার জন্য ৭৫% ছাড় পোশাক থেকে আসবাব সবেতেই। আর মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা শুরুর আগে বাজতে থাকে জাতীয় সঙ্গীত। কানে সুরটুকু ঢোকা মাত্র রিফ্লেক্সে উঠে দাঁড়ানোই দস্তুর। এর অন্যথা হলেই দেশপ্রেম কম পড়িয়াছে! ইস্কুল চত্বর থেকে শুরু করে লালকেল্লা, মাঠ ময়দান— গমগম করে ওঠে ‘জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে’। অনেক নেতি আর ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়েও দৃপ্ত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে ওঠে ৫ থেকে ৭৫ এক দুর্দম আবেগে। প্রতিটা আবেগের পিছনেই একটা গল্প থাকে। জাতীয় আবেগের পিছনে থাকে জাতীয় ইতিহাসের চেনা-অচেনা অধ্যায়।

১৯১১ সাল। ইংরেজ শাসনের ২০০ বছর অতিক্রান্ত। স্বাধীনতা তখনও অধরা। কংগ্রেসি নীতিতে নরম পন্থার রমরমা। রাজা পঞ্চম জর্জ আর রানি মেরি ভারতে আসেন ১৯১১-র ২রা ডিসেম্বর। তৎকালীন বোম্বাই থেকে রাজকীয় শোভাযাত্রা সহ দিল্লিতে পৌঁছন ৭ তারিখে। ডিসেম্বরের ১২ তারিখ পূর্ব আর পশ্চিম মিলিয়ে অখণ্ড বাঙ্গালা প্রদেশ গঠনের কথা ঘোষণা করেন। আর কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত জানান। ১৯০৫ থেকে চলা বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন একটা পরিণতি পেল শেষ অবধি— এমন একটা আবেগ কাজ করতে থাকে সব স্তরে। দিকে দিকে চলতে থাকে এর উদযাপন। প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে ফেডারেশন হলের মাঠে এক বিরাট জনসভায় রাজা, ভাইসরয় আর সেক্রেটারি অফ স্টেটকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়। এই রকম একটা আবহে কংগ্রেসের ২৬তম বার্ষিক অধিবেশন। অধিবেশন বসবে কলকাতায়, ২৬ থেকে ২৮শে ডিসেম্বর। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে ঠিক হল বিশেষ কিছু করা হবে। তা কী এই বিশেষ কিছু? পঞ্চম জর্জের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটা গান নিবেদন করলে কেমন হয়? পূর্বপরিচিত এক কংগ্রেসি কর্মকর্তা রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করলেন একটা গান লিখে দিতে। অভ্যর্থনা সমিতির অন্যতম সম্পাদক ডঃ নীলরতন সরকারের সহযোগী জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগী গানটি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন। এই গানটিই ‘জন গণ মন’। দীনেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে নীলরতন সরকারের বাড়িতে গানটির রিহার্সালও হয়। অ্যাদ্দুর অবধি ঠিকই ছিল। তারপরেই আসল বিতর্কের শুরুয়াত।

পঞ্চম জর্জ

অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে সমবেত কণ্ঠে উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসেবে ‘জন গণ মন’ গাওয়া হয়। এরপর রাজদম্পতিকে স্বাগত জানিয়ে এবং বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য পঞ্চম জর্জের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দু’টি প্রস্তাব আলোচিত ও গৃহীত হয়। আর ওই একই গানের দল ব্রিটিশ রাজশক্তির জয়গাথা মুখর একটি হিন্দি গান পরিবেশন করে। এই দ্বিতীয় গানটির রচয়িতা রামভুজ দত্ত চৌধুরী। “যুগ জীবে মেরা পাদশা/ চহু দিশ রাজ সবায়া” গানটি প্রত্যক্ষ ভাবে পঞ্চম জর্জের প্রশস্তিমূলক। দিল্লিতে পঞ্চম জর্জের জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে দরবার বসানোর ঘটনাটুকু মনে রাখলে গানটার তাৎপর্য সহজেই বোঝা যায়। ২৮ ডিসেম্বর ‘The Bengalee’ র রিপোর্টে এই বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়, “ A Hindi song paying heart-felt homage to Their Majesties was sung by the Bengali boys and girls in chorus”। সেই সঙ্গে রিপোর্টে এটাও বলা হয় “ The proceedings commenced with a patriotic song composed by Babu Rabindranath Tagore…”। ওই একই তারিখে ইংরেজি অমৃতবাজার পত্রিকাতেও লেখা হয়, “ The proceedings began with the singing of a Bengali song of benediction…”। আশীর্বচনের মতো ধ্বনিত হচ্ছে একটা গান। অথচ তা নিয়ে এরপর জলঘোলার শেষ নেই।
‘জন গণ মন অধিনায়ক’ গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া না যাওয়ায় কবে, কোথায়, কীভাবে গানটি রচিত তা নিয়ে ধন্দ থাকলেও, এ গান যে পঞ্চম জর্জের চরণে আদৌ নিবেদিত নয় এটা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু The Englishman, The Statesman, বিলেতে প্রকাশিত India পত্রিকায় খবরটি পরিবেশিত হয় একেবারে অন্যভাবে। The Englishman ছাপে, “ The proceedings opened with song of welcome to the King Emperor, specially composed for the occasion by Babu Rabindranath Tagore…”। The Statesman-এ লেখা হয়, “The proceedings commenced shortly before 12 O’clock with a Bengali song…the choir of girls led by Sarala Devi then (after the loylty resolution) sang a hymn of welcome to the king specially composed for the occasion by Babu Rabindranath Tagore, the Bengali poet.”। এই দ্বিতীয় রিপোর্টটা একটু খুঁটিয়ে দেখলেই কীভাবে তথ্য বিভ্রান্তি ঘটছে বা ঘটানো হচ্ছে বোঝা যাবে। এখানে স্পষ্ট দুটো গানের কথা বলা আছে। কিন্তু দ্বিতীয় গানটিকেও রবীন্দ্রনাথের লেখা বাংলা গান হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। রয়টার্সের পরিবেশিত সংবাদের বয়ানও প্রায় এক। প্রাদেশিক কাগজগুলোতে এই বয়ানই অনুসৃত হয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মুল সুরটি বেঁধে দিয়েছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ, মিডিয়া ট্রায়ালে তিনিই চিহ্নিত হন ব্রিটিশভক্ত রাজকবি হিসেবে! এজরা পাউন্ড অবধি প্রশ্ন তুলছেন রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা নিয়ে।

ব্রিটিশ ঘেঁষা মিডিয়ার এই বিকৃত সংবাদ পরিবেশনে তিতিবিরক্ত রবীন্দ্রনাথ ‘তত্ত্ববোধিনী’র মাঘ সংখ্যায় (১৯১২, জানুয়ারি) ‘ভারত-বিধাতা’ শিরোনামে গানটি ছাপান। ১১ই মাঘ (২৫ জানুয়ারি) মাঘোৎসবে গানটি ব্রাহ্মসঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয়। গানটির মূল ভাবটুকু সম্পর্কে বলেন , “আমাদের যাহা কিছু আছে সমস্তই পণ করিয়া ভূমার পথে নিখিল মানবের বিজয় যাত্রায় যেন সম্পূর্ণ নির্ভয়ে যোগ দিতে পারি”। তত দিনে কিন্তু শান্তিনিকেতনের ইস্কুল গড়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ শিক্ষানীতির কঠোর সমালোচনা করে একটা বিকল্প শিক্ষদর্শ প্রতিষ্ঠা করতেও প্রয়াসী হন। এই স্কুল যে ব্রিটিশ অফিসারদের সন্তানদের পক্ষে আদৌ উপযুক্ত নয়, তা নিয়ে একটা গোপন সরকারি সার্কুলার বেরোয় ২৬ জানুয়ারি। পঞ্চম জর্জ রবীন্দ্রনাথকে নাইটহুড উপাধি দেন ১৯১৫ সালে। এই ঘটনাও সম্ভবত ‘জন গণ মন’ বিতর্কে ইন্ধন যোগায়। জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এই উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন ১৯১৯-এ। এবং প্রতিবাদ পত্রটি পাঠান ব্রিটিশ সরকারকে।

জার্মানিতে সুভাষচন্দ্র

ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ সত্ত্বেও ‘জন গণ মন’ ঘিরে বিতর্কের জের আমৃত্যু বহন করতে হয় রবীন্দ্রনাথকে। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্র পুলিনবিহারী সেন গানটি রচনার উপলক্ষ জানতে চেয়ে একটা চিঠি লেখেন মূল ঘটনাটির প্রায় ২৫ বছর পর। ১৯৩৭ সালে লেখা সেই চিঠির জবাবে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “সে বৎসর ভারত সম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠিত আমার কোনো বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুনে আমি বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে প্রবল উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি জনগণমনঅধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয়ঘোষণা করেছি, পতনঅভ্যুদয় বন্ধুর পন্থায় যুগযুগধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথী, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক, সেই যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জই হতে পারেন না সে আমার রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন”। ১৯৩৯ সে সুধারাণী দেবীকে লেখা চিঠিতেও অনুরূপ অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায়। মৃত্যুর মাত্র তিন মাস আগেও ১৯৪১ এ নন্দগোপাল সেনগুপ্তকেও চিঠিতে প্রায় একই কথা লেখেন রবীন্দ্রনাথ। এই মূঢ়তার জবাব দেওয়াটাই আসলে তাঁর কাছে ছিল আত্ম অবমাননার শামিল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই, ১৯৪১ সালের নভেম্বরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে জার্মানির বন শহরে ‘দ্য ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ’-এর অধিবেশনে ‘জনগণমন’কে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৪৩ এর ২১ অগস্ট ‘আজাদ হিন্দ’ সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গানটি গাওয়া হয়। নেতাজি দ্বিধাহীন হলেও ভারতের গণপরিষদে জাতীয় সঙ্গীত কী হবে— তা নিয়ে বেশ কয়েকবার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। ‘বন্দে মাতরম’ নাকি ‘জনগণমন অধিনায়ক’ তা নিয়ে রীতিমতো কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে গণপরিষদের সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধান স্বাক্ষর করার সময়ে ‘জনগণমন’কে স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করেন। মূল গান পাঁচ স্তবকের হলেও জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে প্রথম স্তবকটি গাওয়া হয়। ৫২ সেকেন্ড এর এই সুর-তাল-লয়-ছন্দ-কথাকে ঘিরে আবর্তিত হয় আজও ভারতবাসীর যাবতীয় দেশজনিত আবেগ। ১১২ বছর পরেও থামে না বিতর্কের জের। শিশুশ্রেণি থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ময়দান—সুরের অনুরণনও থামে না।

(অলঙ্করণ -রাতুল চন্দ রায়)

9 COMMENTS

  1. ‘মূঢ়তার জবাব দেওয়াটাই ছিল তাঁর কাছে ছিল আত্ম -অবমাননার শামিল ‘ —- এটা এখনও এখনও সঠিক মূল্যায়ন

  2. খুব সুন্দর করে লিখেছিস। প্রত্যেকের এই তথ্যগুলো জানা দরকার।

Comments are closed.