তখন মাঝরাত। ঘড়ির কাঁটা অগস্ট ১৪ পেরিয়ে ১৫-র দিকে। পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলে জমকালো অনুষ্ঠানের ঘনঘটা। ব্রিটিশরাজ ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে ভারতের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে। চলছে সদ্য প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন জওহরলাল নেহরুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ‘Tryst with Destiny’। কিন্তু যাঁর হাত ধরে তৈরি হল এই স্বপ্ন-সম্ভব ইতিহাস, তিনি তখন কোথায়?

তিনি, জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে রয়েছেন অনেক দূরে। তাঁর অন্তরে কোথাও সেই উৎসবের আলো জ্বলেনি। দাঙ্গা-দীর্ণ কলকাতা শহরের বেলেঘাটা এলাকার দারিদ্র্য-পীড়িত, জনবহুল এক সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত পাড়ায় তিনি তখন ক্লান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন। গত কয়েকদিন তাঁর কেটেছে এ শহরের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণ করার প্রাণপণ প্রয়াসে। কলকাতায় তিনি এসে পৌঁছেছেন ৯ অগস্ট। এখান থেকে তাঁর যাওয়ার কথা নোয়াখালি। সেখানকার দাঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে তিনি অতীব উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছেন। বেলেঘাটার হায়দারি মনজিলে (যা পরবর্তীকালে ‘গান্ধীভবন’ নামে পরিচিত) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি দল, এ শহরের দাঙ্গা বন্ধ করার অনুরোধ নিয়ে। ১১ অগস্ট এলেন সুরাবর্দি সাহেব। তাঁকে গান্ধী অনুরোধ করলেন নোয়াখালির সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। অন্যথা তিনি নিঃশর্ত অনশনে যাবেন। এক উন্মত্ত জনতা বাপু এবং সুরাবর্দি সাহেবের মুখোমুখি হল। বাপু তাদের শান্ত করতে মরিয়া চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। সেই তীব্র বিক্ষোভ চলল আরও দু’দিন। ১৪ অগস্ট সন্ধ্যায় প্রার্থনা সভায় গান্ধী সবাইকে ২৪ ঘণ্টার অনশনে যোগ দিয়ে ভারতের কল্যাণ কামনা করতে এবং চরকা কাটায় মনোযোগ দিতে বললেন।
প্রার্থনা সভা সমাপ্ত হলে আবার আক্রান্ত হল হায়দারি মনজিল। জানলা দরজায় পাথর বৃষ্টি হতে লাগল। ঝনঝন করে ভেঙে পড়তে লাগল জানলা-দরজার কাচ বাপু ও সুরাবর্দির গায়ে। অবশেষে দু’জনে পাশাপাশি জানলার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিক্ষুব্ধ, উন্মত্ত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে কোনওক্রমে শান্ত করলেন তাদের।

সেই রাতে রাজধানী দিল্লির সমস্ত উৎসব-অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রেখে ক্লান্ত বাপু ঘুমিয়ে পড়লেন এক জীর্ণ তোষকের ওপর। তিনি ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর পক্ষে স্বাধীনতার ওই উৎসবে যোগ দেওয়া সম্ভব নয়। সেই উৎসবে সামিল হতে ভারতবাসীকেও তিনি বারণ করলেন। যে স্বাধীনতা ভারতবাসী আজ পেল, তা ভবিষ্যতে ভারত ও পাকিস্তানের জন্য সংঘর্ষের বীজ বপন করলো। এই পরিস্থিতিতে কীভাবে তাঁর পক্ষে উৎসবের আলো জ্বালানো সম্ভব? স্বাধীনতার ঘোষণার চেয়ে আজ অনেক বেশি করে প্রয়োজন হিন্দু-মুসলমান দেশবাসীর মধ্যে স্থায়ী শান্তির আয়োজন।
১৫ অগস্ট বাপু ঘুম থেকে উঠলেন ভোর ৩.৪৫ মিনিটে। সারলেন তাঁর সমস্ত প্রাতঃকৃত্য। ইতিমধ্যে বেশ কিছু অভিনন্দন বার্তা পেয়েছেন। কোনও প্রতিক্রিয়া নেই তাঁর। তিনি প্রার্থনা করলেন, চরকা কাটলেন নীরবে। তারপর পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভাকে এই বার্তা পাঠালেন:

আজ থেকে আপনাদের কাঁটার মুকুট পরতে হবে। সত্য ও অহিংসার পথে চলায় প্রয়াসী হতে হবে। বিনয়ী ও সহিষ্ণু হতে হবে। এখন আপনাদের সামনে কঠিন পরীক্ষার সময় সমাগত। ক্ষমতা সম্পর্কে সতর্ক হোন, কারণ ক্ষমতা মানুষকে কলুষিত করে। এর ফাঁদে পা দেবার জন্য প্ররোচিত হবেন না। স্মরণে রাখবেন, আপনারা শপথ নিয়েছেন ভারতের দরিদ্র গ্রামবাসীর কল্যাণ সাধনের জন্য।
বাপুর সেই বার্তার মর্ম আজকের ভারতবাসী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে।

8 COMMENTS

  1. […] তখন বাপু অনেক দূরে… সেলুলার জেলে বিপ্লবীদের রান্নাবান্না দেশের লড়াইয়ে পতিতার টাকা বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী পূর্ববঙ্গের প্রথম স্বাধীনতা বিতর্কের পরেও জনগণমন আমাদের পতাকা Share WhatsApp Facebook Telegram Twitter Google+ Pinterest Linkedin Previous articleপ্ল্যানচেটে স্বাধীনতা রাতুল চন্দরায়https://balihas.com/ […]

  2. […] তখন বাপু অনেক দূরে… সেলুলার জেলে বিপ্লবীদের রান্নাবান্না দেশের লড়াইয়ে পতিতার টাকা বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী পূর্ববঙ্গের প্রথম স্বাধীনতা বিতর্কের পরেও জনগণমন আমাদের পতাকা Share WhatsApp Facebook Telegram Twitter Google+ Pinterest Linkedin Previous articleবিতর্কের পরেও জনগণমনNext articleদেশের লড়াইয়ে পতিতার টাকা জীবন সাহাhttps://balihas.com/ […]

  3. […] তখন বাপু অনেক দূরে… সেলুলার জেলে বিপ্লবীদের রান্নাবান্না দেশের লড়াইয়ে পতিতার টাকা বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী পূর্ববঙ্গের প্রথম স্বাধীনতা বিতর্কের পরেও জনগণমন আমাদের পতাকা Share WhatsApp Facebook Telegram Twitter Google+ Pinterest Linkedin Previous articleআমাদের পতাকাNext articleপূর্ববঙ্গের প্রথম স্বাধীনতা অরিতা ভৌমিকhttps://balihas.com/ […]

  4. […] তখন বাপু অনেক দূরে… সেলুলার জেলে বিপ্লবীদের রান্নাবান্না দেশের লড়াইয়ে পতিতার টাকা বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী পূর্ববঙ্গের প্রথম স্বাধীনতা বিতর্কের পরেও জনগণমন আমাদের পতাকা Share WhatsApp Facebook Telegram Twitter Google+ Pinterest Linkedin Previous articleআত্মসমর্পণে রাজি ছিল না অধিকাংশ জলদস্যুNext articleআমাদের পতাকা বালিহাঁস ডেস্ক […]

  5. […] তখন বাপু অনেক দূরে… সেলুলার জেলে বিপ্লবীদের রান্নাবান্না দেশের লড়াইয়ে পতিতার টাকা বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী পূর্ববঙ্গের প্রথম স্বাধীনতা বিতর্কের পরেও জনগণমন আমাদের পতাকা Share WhatsApp Facebook Telegram Twitter Google+ Pinterest Linkedin Previous articleবন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী স্বাগতা চৌধুরীhttps://balihas.com/ […]

  6. […] তখন বাপু অনেক দূরে… সেলুলার জেলে বিপ্লবীদের রান্নাবান্না দেশের লড়াইয়ে পতিতার টাকা বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী পূর্ববঙ্গের প্রথম স্বাধীনতা বিতর্কের পরেও জনগণমন আমাদের পতাকা Share WhatsApp Facebook Telegram Twitter Google+ Pinterest Linkedin Previous articleপূর্ববঙ্গের প্রথম স্বাধীনতাNext articleসেলুলার জেলে বিপ্লবীদের রান্নাবান্না প্রণব দাসhttps://balihas.com/ […]

  7. […] তখন বাপু অনেক দূরে… সেলুলার জেলে বিপ্লবীদের রান্নাবান্না দেশের লড়াইয়ে পতিতার টাকা বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী পূর্ববঙ্গের প্রথম স্বাধীনতা বিতর্কের পরেও জনগণমন আমাদের পতাকা Share WhatsApp Facebook Telegram Twitter Google+ Pinterest Linkedin Previous articleকারা কাহিনী – অরবিন্দ ঘোষNext articleবিতর্কের পরেও জনগণমন সুকুমার মিত্রhttps://balihas.com/ […]

Comments are closed.