পর্ব ৩৭

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

আত্মসমর্পণ করলো সুন্দরবনের দোর্দন্ড প্রতাপশালী দস্যু মাস্টার-সহ সাত জন। তারা চলে গেল ৱ্যাবের জিম্মায়। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। যদিও আমি জানতাম কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না তবু একটু দুশ্চিন্তা তো থেকেই যায়। ৱ্যাবের পক্ষ থেকে মাস্টারদের খুব ভালভাবে গ্রহণ করা হল।আত্মসমর্পণকারীদের যতটুকু সন্মান দেওয়া যায় তাতে ঘাটতি ছিল না ৱ্যাবের। তাদের লঞ্চে উঠিয়ে নেওয়া হল। আর বস্তায় রাখা অস্ত্রগুলি সব যত্ন করে ট্রলারে রাখা হল।

আমাদের গন্তব্যস্থল হাড়বাড়িয়া। ওখানে মাস্টার-সহ সবাইকে নিয়ে যাওয়া হল। আনুষ্ঠানিক ভাবে একটি ছোট পরিসরে আত্মসমর্পণ পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। সময় সকাল সাড়ে ছয়টা। আমাদের লাইভ টিমের যন্ত্রপাতি রেডি। সরাসরি দেখানো হবে এই আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান। আমাদের ক্যামেরা চালু হল। শুরু হল যমুনা টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার। ব্রেকিং নিউজ – সুন্দরবনের সবচেয়ে বড়ো বনদস্যু দল মাস্টার বাহিনী ৱ্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করলো।

আলোড়ন পড়ে গেল চারদিকে। সরাসরি সম্প্রচার শুরু হতেই ফোন আসলো মেজর আদনানের কাছে। আদনান আমার কানের কাছে এসে বললো, উপর থেকে ফোন এসেছে। সম্প্রচার কি বন্ধ করা যায় ?

আমি বললাম, না।  একাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সম্প্রচার চলবে। কারণ, আমি শুধু বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ নয়, এই সম্প্রচার করবো বলে মাস্টারদের কাছেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। কারন মাস্টাররা যে ধরা দিয়েছে, সেটা টেলিকাস্ট না করলে ওরা নিরাপত্তাজনিত সমস্যায় ভুগবে। মাস্টাররা চাইছিল, ওরা যে আত্মসমর্পণ করেছে সেটা জনগণ জানুক। কিন্তু আদনানের অনুরোধে যতটা ছোট করে সম্ভব আমি লাইভ করলাম।

ওইটুকু অবশ্য যথেষ্ট। তোলপাড় হয়ে গেল পুরো বাংলাদেশ। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি। যেখানে লাইভ করছিলাম, সেখানে নেটওয়ার্ক ছিল না। কিন্তু লাইভ শেষ করে যখন নেটওয়ার্কের সীমার ভিতরে আসলাম, দেখলাম একের পর এক কল ঢুকছে আমার ফোনে। কোস্টগার্ড, গোয়েন্দা সংস্থা  তারপর ৱ্যাবের অন্য অফিস- সব জায়গা থেকে ফোন। সবাই জানতে চাইছে -কি হল ? কি করে এই সব সম্ভব হল?

আমি বললাম, ঘটনা যেটা দেখছেন সেটাই। একটু পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে মাস্টার বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে।

কিন্তু সমস্যা তৈরি করলো আবহাওয়া। সকালের পর থেকে আবহাওয়া এতটাই খারাপ হতে শুরু করলো যে হেলিকপ্টার উড়ানো বিপজ্জনক। সেদিনের মতো আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হল।

আমি বুঝতে পারলাম, প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় মাস্টাররা ভীষণ দুশ্চিন্তা করছে। আদনানের সঙ্গে কথা বলে আমি গেলাম তাদের কাছে। বললাম, আমি আছি কোনও ভয় নেই। দেখছেন তো আবহাওয়ার অবস্থা। আবহাওয়া ঠিক হলে সব কিছু ঠিক হবে। মাস্টারদের আশ্বস্ত করলেও আমার মধ্যে টেনশন কাজ করছিলো। কিন্তু তিন রাত জেগে আছি। একটানা জেগে থাকতে থাকতে ক্লান্ত আমি।

মাস্টারকে বললাম, একটু সময় পাওয়া গেছে। আপনারা ফোন করে দেখেন যারা আত্মসমর্পণ না করে ফিরে গেছে তাদের মধ্যে আর কেউ আত্মসমর্পণ করবে কিনা ? যদি ভুল ভাঙে তাহলে এসে আত্মসমর্পণ করুক।

আমার কথা শুনে মাস্টার ফোন করলো। আর তার ফোন পেয়ে আরও তিনজন আসলো আত্মসমর্পণ করতে।

২৯শে মে সারাদিন আবহাওয়া খারাপ। তিরিশ তারিখও এক অবস্থা। আবহাওয়া উন্নতি হল ৩১- এ এসে। সেই দিন সকালে স্বরাষ্টমন্ত্রী আসলেন। মংলার ফুয়েল জেটিতে সীমিত পরিসরের আয়োজন। মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে অস্ত্র তুলে দিয়ে আত্মসমর্পন করলো মাস্টার-সহ ১০জন দস্যু। 

দস্যুদের সঙ্গে আমার এমন কোনও প্রতিশ্রুতি ছিল না যে তাদের সাধারণ ক্ষমা করা হবে বা অন্য কিছু করা হবে। তাদের কাছে আমার একটাই প্রতিশ্রুতি ছিল যে আত্মসমর্পণের আগে বা পরে তাদের গায়ে কেউ হাত দিবে না। কোনও ক্রসফায়ার হবে না। অন্য বাকি সব আসামিরা যেভাবে গ্রেফতারের পর কারাগারে যায় , জামিনে মুক্ত হয়, ঠিক সেই প্রক্রিয়াই অবলম্বন করা হবে। 

কিন্তু পরে সরকারের পক্ষ থেকে দস্যুদের প্রতি উদারতা দেখানো হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী নিজে ঘোষণা দিয়েছিলেন, হত্যা এবং ধর্ষণ, এই দুই ধরনের মামলা বাদে অন্য সব মামলা প্রত্যাহার করা হবে।

এদিকে যারা আত্মসমর্পণ করলো না, ভোরবেলা ৱ্যাব সেসব দস্যুদের নিজস্ব স্পিডবোটে করে যে যেখানে নামতে চেয়েছিলো, তাদের সেখানেই নামিয়ে দিয়ে আসে। অর্থাৎ, দস্যুদের দেওয়া সব প্রতিশ্রুতিই আমি রক্ষা করতে পেরেছিলাম।

২৯ মে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর সম্প্রচারের পরে যেমন নানা সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আমার কাছে ফোন এসেছিল, ঠিক সেই রকম পরদিন সকালে অর্থাৎ ৩০ তারিখ আমার কাছে আসতে শুরু করলো সুন্দরবনের নানা দস্যু সর্দারের ফোন। নোয়া মিঞা, জাহাঙ্গীর এই সব নামকরা দস্যুনেতারা আমাকে ফোন করতে শুরু করলো। তাদের সবার চিন্তা- কি হয়েছে ? কেমন করে সব কিছু হল? মাস্টারকে নিয়ে কি করবে প্রশাসন?  অনেক দস্যুর সাথে যেটা ঘটেছে সেই ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটবে নাতো? ওই দস্যুনেতাদের সবারই চিন্তা- কী হয় কী হয়?

আর আমার চিন্তা অন্য। এখানেই কি শেষ? একটি দস্যুদলের আত্মসমর্পণ করিয়ে কি আমার কাজ শেষ হয়ে যাচ্ছে? নাকি এই কাজ চালিয়ে যাবো? সুন্দরবনকে পুরোপুরি দস্যুমুক্ত করার চিন্তা সেদিন থেকেই আমার মাথায় আসে।

(ক্রমশ)

2 COMMENTS

Comments are closed.