“আমাদের পতাকা” শিরোনামে ফিল্মস ডিভিশন প্রথমে কালো ও সাদাতে ভারতীয় পতাকার উপর তাদের তথ্যচিত্র  তৈরি করেছিল। সেটা ১৯৫১ সাল। চার বছর পরে ওই তথ্যচিত্রের একটি রঙিন সংস্করণও তারা তৈরি করে। ২৯ মে, ১৯৫৩ ভারতের জাতীয় পতাকা মাউন্ট এভারেস্টে উত্তোলন করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে, ভারতের জাতীয় পতাকা অ্যাপলো-১৫ জাহাজে মহাকাশে উড়েছিল। ১৯৮২ সালে দক্ষিণ গঙ্গোত্রীতেও প্রথমবার তেরঙ্গা উড়ানো হয়েছিল। এই সব ঘটনাই সংবাদপত্রে খবর হয়েছে। তবে ভারতের জাতীয় পতাকা গণপরিষদে আনুষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হওয়ার বহু আগে, নানা সময় নানা ধরনের পতাকা বিভিন্ন জায়গায় উত্তোলন করা হয়েছিল।

ভারতের জন্য একটি জাতীয় পতাকার ধারণা প্রাথমিক ভাবে জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা নয় বরং ১৮৫৭ সালের অভ্যুত্থানের পরে ব্রিটিশ সরকার উত্থাপন করেছিল। ১৮৬৩ সালে ‘ভারতের তারকা’ পতাকা প্রস্তাব করা হয়েছিল। ভারতের পতাকা নিয়ে প্রথম জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার সৃষ্টি হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। জাতীয় পতাকার প্রাচীনতম প্রোটো-টাইপগুলির মধ্যে একটি ছিল ১৯০৫ সালে মার্গারেট নোবেলের (সিস্টার নিবেদিতা) ডিজাইন করা পতাকা।  সেটি একটি লাল বর্গাকার আকৃতির পতাকা, পুরো সীমানা বরাবর ১০৮টি ‘জ্যোতিস'(তেল বাতি) ছিল।  সঙ্গে ছিল একটি “বজ্র চিহ্ন”(বজ্রধ্বনি) হলুদ রঙে একটি সাদা পদ্মের সাথে মাঝখানে। পতাকার উপরে বাংলা লিপিতে “বন্দে মাতরম” শব্দটি খোদাই করা। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় তাদের বার্ষিক অধিবেশনে এই পতাকাটি প্রদর্শন করেছিল।

পাশাপাশি, ১৯০৬ সালের ৭ অগস্ট কলকাতার পার্সিবাগান স্কোয়ারে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ সমাবেশে স্বাধীনতা সংগ্রামী শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু প্রথম তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। এই পতাকাটি “কলকাতা পতাকা” নামে পরিচিত হয়েছিল এবং এতে কমলা, হলুদ এবং সবুজ রঙের তিনটি অনুভূমিক ব্যান্ড ছিল এবং দেবনাগরী লিপিতে কেন্দ্রে “বন্দে মাতরম” শব্দটি খোদিত ছিল। যৌথভাবে এটির নকশা তৈরি করেছিলেন দুই স্বাধীনতা সংগ্রামী শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু ও সুকুমার মিত্র।

২২ অগস্ট,১৯০৭-এ জার্মানির স্টুটগার্টে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনের সময় মাদাম ভিকাজি রুস্তমজি কামা আরেকটি পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। যার শীর্ষে সবুজ, কেন্দ্রে জাফরান এবং নীচে লাল এবং সবুজ ব্যান্ডের উপর একটি সারিতে আটটি পদ্ম ছিল ব্রিটিশ ভারতের আটটি প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব হিসেবে। কেন্দ্রীয় ব্যান্ডে দেবনাগরী লিপিতে “বন্দে মাতরম” শব্দগুলি খোদিত ছিল। ভিকাজি কামা, সাভারকার ও শ্যামজি কৃষ্ণ ভার্মা যৌথভাবে পতাকাটি নকশা তৈরি করেছিলেন। এর দশ বছর পর অ্যানি বেসান্ত এবং বাল গঙ্গাধর তিলক ১৯১৭ সালের হোম রুল আন্দোলনও একটি পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। সেই সময়ও পতাকায় বেশ কিছু বদল আসে।

১৯১৬ সালে, পেঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া ওমর সোবহানি ও এস.আর বোমানজি যৌথভাবে ভারতীয় জাতীয় পতাকা মিশন শুরু করেন। তিনি একটি বই ‘এ ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ ফর ইন্ডিয়া’ লিখেছেন এবং জাতীয় পতাকার জন্য ত্রিশটি ভিন্ন নকশা উপস্থাপন করেছেন। ১৯২১ সালে, মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে তিনি জাতীয় পতাকার জন্য একটি নকশা জমা দেন যাতে একটি লাল এবং সবুজ পটভূমিতে একটি চরকা ছিল। লালা হংসরাজ প্রস্তাবিত পতাকার উপর একটি চরকা চিত্রিত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। যাই হোক, মহাত্মা গান্ধী মনে করেছিলেন যে পতাকা ভারতের সমস্ত ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে না।

সম্ভবত, ভারতীয়দের দ্বারা একটি জাতীয় পতাকা গ্রহণের জন্য নির্ধারক মুহূর্তটি ছিল ১৯২৩ সালের মে মাসের নাগপুর পতাকা সত্যাগ্রহ, যা জামনালাল বাজাজ এবং অন্যান্যদের নেতৃত্বে ছিল। ওই সত্যাগ্রহ “পতাকাটিকে একটি অপেক্ষাকৃত প্রান্তিক প্রতীক থেকে জাতীয় আন্দোলনের একটি কেন্দ্রীয় উপাদানে রূপান্তরিত করেছিল”। আসলে প্রথম পতাকা সত্যাগ্রহ জব্বলপুরে ১৮ মার্চ, ১৯২৩ সালে কংগ্রেস কাউন্সিলরদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরে তা নাগপুরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

১৯২৯ সাল নাগাদ আরেকটি নতুন তেরঙ্গা পতাকার নকশা করা হয়েছিল। যার উপরে সাদা, মাঝখানে সবুজ এবং নীচে লাল, তিনটি ব্যান্ড জুড়ে একটি “চরকা” আঁকা ছিল। এই পতাকাটি স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। যদিও এটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পতাকা হিসেবে গৃহীত হয়নি। ২ এপ্রিল,১৯৩১-এ, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি জাতীয় পতাকার জন্য একটি নকশা গ্রহণের জন্য সমস্ত পরামর্শ খতিয়ে দেখার লক্ষো সাত সদস্যের পতাকা কমিটি নিযুক্ত করে। পরে, ১৯৩১ সালে কংগ্রেসের করাচি অধিবেশন চলাকালীন, পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া দ্বারা নকশা করা পতাকা গৃহীত হয়েছিল, যার কেন্দ্রে একটি “চরকা” সহ জাফরান, সাদা এবং সবুজ তিনটি অনুভূমিক স্ট্রিপ ছিল।

২৩ জুন, ১৯৪৭ গণপরিষদ ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের নেতৃত্বে একটি অ্যাডহক পতাকা কমিটি গঠন করে এবং আবুল কালাম আজাদ, ডঃ বি.আর. আম্বেদকর, সি. রাজাগোপালাচারী, কে এম মুন্সি ও সরোজিনী নাইডু এর সদস্য ছিলেন। তিন সপ্তাহের আলোচনার পর, পতাকা কমিটি ১৪ জুলাই, ১৯৪৭-এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পতাকাকে ব্যাপক ভাবে গ্রহণযোগ্য করার জন্য উপযুক্ত পরিবর্তন সহ ভারতের জাতীয় পতাকা হিসাবে গ্রহণ করা উচিত। ভারতীয় জাতীয় পতাকা নিয়ে বিতর্ক ২২ জুলাই,১৯৪৭-এ প্রথমবারের মতো ভারতীয় গণপরিষদে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এটি প্রস্তাব করা হয়েছিল যে ‘চরখা’ বা চরকাটি অশোকের “ধর্ম চক্র” দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।

স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই, গণপরিষদের প্রতিনিধি হংস মেহতার নেতৃত্বে বাহাত্তর জন মহিলার একটি দল ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের কাছে তেরঙ্গা পতাকা পেশ করেন। ভারত স্বাধীন দেশ হওয়ার পর, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় সেন্ট্রাল হলে (বর্তমানে সংসদ ভবন নামে পরিচিত) প্রথমবারের মতো জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। ১৫ অগস্ট,১৯৪৭ বিকেলে ইন্ডিয়া গেটের কাছে প্রিন্স পার্কে ‘ওয়ার মেমোরিয়ালে’ প্রথম সর্বজনীন পতাকা অভিবাদন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ১৬অগস্ট,১৯৪৭-এ সকাল সাড়ে আটটায় লাল কেল্লার প্রাচীরে প্রথমবারের মতো তেরঙ্গা উত্তোলন করা হয়েছিল এবং ১৫ আগস্ট, ১৯৪৮ থেকে লাল কেল্লায় পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল।

ভারতের জাতীয় পতাকা হল গাঢ় জাফরানের অনুভূমিক ত্রিবর্ণ, মাঝখানে সাদা এবং নীচে সমান অনুপাতে গাঢ় সবুজ। জাফরান সাহস ও ত্যাগের চেতনার প্রতীক। সাদা বিশুদ্ধতা ও সত্য এবং সবুজ বিশ্বাস ও উর্বরতার প্রতীক। পতাকার দৈর্ঘ্যের ও প্রস্থের অনুপাত দুই ও তিন (২:৩)। সাদা ব্যান্ডের মাঝখানে একটি নেভি ব্লু চাকায় চব্বিশটি স্পোক রয়েছে, যা চক্রকে প্রতিনিধিত্ব করে। এর নকশাটি যে চাকা থেকে নেওয়া হয়েছে তা সারনাথে রয়েছে। দেশের অধিকাংশ মানুষই জানেন যে ভারতের বর্তমান তিরঙ্গাই একমাত্র জাতীয় পতাকা যেখানে গেরুয়া, সাদা এবং সবুজ রং রয়েছে। এক একটি রং এক একটি বিষয়ের প্রতীক।

ভারতের পতাকা কোড,২০০২ জাতীয় পতাকার অবমাননাকর উপায় ছাড়া সাধারণ জনগণ, বেসরকারি সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সদস্যদের দ্বারা জাতীয় পতাকা প্রদর্শনের উপর সমস্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। নতুন পতাকা কোড হয়েছে শিল্পপতি নবীন জিন্দাল ও ভারত সরকারের মধ্যে সাত বছরের দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে যেখানে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় নাগরিকদের পতাকা ওড়ানোর অধিকারকে সমর্থন করে রায় দিয়েছে।

(অলঙ্করণ -রাতুল চন্দ রায়)

4 COMMENTS

Comments are closed.