পর্ব ২৮

(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)

তখন রাত বারোটা।  ট্রলার ছাড়লেন বেলায়েত সর্দার।  ট্রলারের একদম উপরে আমি আর বেলায়েত, সুকানিরা যেখানে থাকে সেই জায়গায়। বাকি সবাইকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম। বললাম, তোমরা রেস্ট নাও, আমরা দু’জন ট্রলার সামলাচ্ছি।  মাস্টাররা চেয়েছিল, আমাদের সাথে কিছুটা আসবে। কিন্তু তাদের ফিরিয়ে দিলাম। আমার যেদিকে রওনা দিলাম ওরা তার উল্টোদিকে চলে গেল। মাস্টারদের অনেক কাজ।  খুঁজতে হবে কোনও নিরাপদ খাল। আর খুঁজতে হবে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দস্যু ও জেলেদের। যাই হোক, আমরা ট্রলার স্টার্ট দিয়ে কিছুদূর গিয়ে মোবাইল ফোন অন করলাম। দেখি, পুরনো ফাইল ক্লিয়ার করার একটা মেসেজ এসেছে।  কোনও কিছু না চিন্তা করে ok বোতামটা টিপে দিলাম। তারপর গুগুল মাপ খুলতে গিয়ে দেখি, ম্যাপ তো নাই।  এ কি করেছি আমি ! জিপিএস লোকেশন দেখাচ্ছে। কিন্তু ম্যাপ নাই। এখানে তো নেটওয়ার্কও  নেই। কি করবো ! এদিকে কাগজটাকেও তো খুঁজে পাচ্ছি না !

সোহাগ আকন এতো কষ্ট করে বোঝাচ্ছিল কি করে আমাদের যেতে হবে।  কোন পথে গেলে আমরা হংসরাজ নদীতে পৌঁছতে পারবো। কিন্তু তার কথা মনযোগ দিয়ে শুনিনি। ভেবেছিলাম, টেকনোলজিই তো সব। গুগলের ভরসায় ছিলাম।  এখন গভীর অন্ধকার রাত, একটা ছোট খালে একটা ট্রলারে আমরা। চারদিকে কুয়াশা।  নেই কোনও অস্ত্রশস্ত্র।  আশপাশের জঙ্গল থেকেও তো জন্তু জানোয়ার আক্রমণ করতে পারে। কোন দিকে যাবো? রাগে চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে আমার। সঙ্গে পাঁচ- পাঁচজন।  নিজেকে নিজের ধিক্কার দিচ্ছিলাম। কিন্তু বিষয়টি কাউকে বুঝতে দিলাম না। যাই হোক, শেষ সম্বল ওই কাগজের ম্যাপটা। খুঁজে বের করতে হবে। বার বার পকেটে খুঁজতে শুরু করলাম।

ভাগ্য ভাল বলতে হবে, পেয়ে গেলাম ওই কাগজটা। আঁকাবাঁকা লেখা কিন্তু সেই সময়ের জন্য ভীষণ দরকারি। তখন ভাল করে দেখিনি সোহাগভাই ঠিক কিভাবে ম্যাপটা তৈরি করেছেন। একেবারে নতুন জায়গা ! আমি তো চিনিই না। জঞ্জলের মানুষ বেলায়েতও চেনে না। বসলাম ম্যাপ নিয়ে।  এখন তো জীবন মরণ সমস্যা।  বুঝতেই হবে ম্যাপ। যাই হোক কিছুটা ধারণা করে , কিছুটা ম্যাপ দেখে এগোতে থাকলো আমাদের ট্রলার। ভয় করছিল।  তবে জানি সঙ্গে যখন বেলায়েত আছে , যে করে হোক বিপদ থেকে ঠিক উদ্ধার পাবো আমরা। ছোট খাল দিয়ে চলতে চলতে একটা জায়গায় পৌঁছলাম। জায়গাটার নাম শতমুখী। জটিল জায়গা। শতমুখী বলার কারণ, ওই জায়গাটা ১০-১২টা খালের মিলনস্থল। ম্যাপটা আবার ভাল করে দেখলাম।  ঠিক কোন খালটা দিয়ে গেলে হংসরাজ নদীতে পৌছবো? সোহাগের ম্যাপ আর নিজের ইন্টিউশন কাজে লাগিয়ে ট্রলারটাকে ঢুকিয়ে দিলাম একটা খালে।  প্রায় দুই ঘণ্টা। ট্রলার চলছে।  ভুল পথে যাচ্ছি নাকি! রওনা দিয়েছিলাম রাত বারোটার সময়, তখন রাত দুটো বা সোয়া দুটো। না ভুল হয়নি। আমরা গিয়ে পড়লাম হংসরাজ নদীতে। 

দুশ্চিন্তা মুক্ত হলাম। হংসরাজ বড় নদী। এবার যেতে হবে পূর্বদিকে। তবেই পশুর নদী পেয়ে যাবো। পশুর নদী ধরে যদি উত্তরে যাই, মংলায় পৌঁছে যাবো। অর্থাৎ লোকালয়। আমরা দুবলার চর ছেড়েছিলাম তিনদিন আগে, এইবার ফেরার সময় যাবো মংলায়। তখন কটা বাজে? হয়তো চারটা বা তার কিছু আগে। ভোর হয়ে আসছে। আমরা পড়লাম পশুর নদীতে। পশুর নদীতে দেখি একটা জাহাজ যাচ্ছে। ভীষণ কুয়াশা, তবু জাহাজের অবয়বটা বুঝতে পারছিলাম। আমি বেলায়েত ভাইকে ডেকে তুললাম।

—ভাই আমি আর পারবো না। এবার আপনি চালান।  আমি একটু বিশ্রাম নিই। আমি ওকে চালাতে দিয়ে সেখানেই শুয়ে পড়লাম। দুটো চোখ ভীষণ বিদ্রোহ করছে। খোলা রাখা যাচ্ছে না। ওখানে মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে পড়লাম। আরও পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লাগবে মংলা পৌঁছতে। এই সময়টা বিশ্রাম নিয়ে নেই। মংলায় নেমে অনেক কাজ। ঘুমিয়েছি বোধহয় ঘণ্টা দেড়েক হয়েছে। হঠাৎ শুনি, আজানের ধ্বনি। এতো তাড়াতাড়ি চলে এলাম ! একটু অবাক হলাম। ঘড়িতে দেখি সাড়ে ছয়টা। মানে দু-আড়াই ঘণ্টার মধ্যে লোকালয়ে চলে এসেছি। সন্দেহ হলো আমার। এদিকে কুয়াশা অনেকটা বেড়েছে।  ঠিক করে কিছু দেখা যাচ্ছে না।  আবার চোখ বন্ধ করলাম। অস্বস্তি হচ্ছিল। উঠে বসলাম। চারপাশে একটু একটু আলো ফুটছে। আমি ভাবলাম, এতো তাড়াতাড়ি মংলার জয়মনি আসব কোথা থেকে! কোনও ভুল হচ্ছে নাতো আমার। এই সব ভাবতে ভাবতে দেখি আমরা আবার পশুরের মোহনায় চলে এসেছি। মানে তিনদিন আগে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেখানেই চলে এসেছি। সেই দুবলার চরে। আমরা একেবারে উল্টো দিকে চলে এসেছি। মানে চলার পথে কখন ট্রলার পাক খেয়ে ঘুরে গেছে খেয়াল করিনি। সেই সময় জোয়ার শেষ হয়ে ভাটা শুরু হয়েছে।

হয়তো বেলায়েত সরদার একটু তন্দ্রায় ছিল, তারপর কুয়াশা। ট্রলার যে ঘুরে গেছে টের পায়নি। ভাটার স্রোতে ট্রলার চলে এসেছে দুবলার চরে। একটু দূরে সাগর। আমি বেলায়েতকে ডেকে তুললাম।

—ভাই, এতো মংলায় যেতে গিয়ে সাগরে চলে যাচ্ছি। ট্রলার ঘুরাতে হবে। আমরা তো সাগরে ঢুকে যাচ্ছি! ট্রলার ঘুরিয়ে দুবলার চরের ‘আলোর কোলে নোঙ্গর করলাম। সেখানে জেলেদের সাময়িক বসতি আছে। পরিচিত অনেকেই। আছো দুটি মুদির দোকান ও সাময়িক রেস্তোঁরা।

আমরা যখন আলোর কোলেতে নামছি, ওখানে সবাই আমাদের অবাক করে দেখছে। হয়তো ভাবছে, কোথা থেকে আসছে এরা! এই তো তিনদিন  দিন আগে এখান  থেকে রওনা দিলো। তারপর আমাদের জামাকাপড়। আমার প্যান্টের তো দারুন অবস্থা। একদিকে পোড়া অন্যদিকে ছেঁড়া। প্রত্যেকে যেন ভুত দেখছে।

(ক্রমশ)

1 COMMENT

Comments are closed.