মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

পর্ব ২৫

আমি পলিন আর রাজীব।  বেলায়েত সরদারের কোনও খোঁজ পেলাম না। তবে আমি জানি, বেলায়েত জঙ্গলের মানুষ, ও ঠিক নিজের জন্য একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজে নিতে পারবে। দুশ্চিন্তা হচ্ছিল অন্য দুই জনের জন্য। ফারুক ভাই আর সুজন। সরদারের ট্রলারের সহযোগী তারা। ছুটতে শুরু করেছি। ২০০-২৫০ মিটার গিয়ে বুঝলাম, আমার দ্বারা ছুটে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব হবে না। গরানের শ্বাসমূলগুলি ছোট ছোট কিন্তু ভীষণ শক্ত। ওই শ্বাসমূলে পা লেগে একেবারে কেটেকুটে একাকার। এইভাবে আর দৌঁড়নো যাবে না। এদিকে বড় কোনও গাছ নেই যার পিছনে গিয়ে লুকাবো। না ! এই ভাবে দৌড়লে বিপদ আরও বাড়বে। যে কোনও সময় গুলি এসে লেগে যেতে পারে। যা থাকে কপালে। আমি থেমে গেলাম। তারপর সরে গিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় কাদার উপরে বসে পড়লাম। আমার দেখাদেখি পলিন আর রাজীবও এসে বসে পড়লো ওই জায়গায়। তিনজনই ভীষণ হাঁফাচ্ছি। তবে পলিনকে দেখলাম ও বেশ শক্ত আছে। নার্ভ ফেল করেনি। কিন্তু রাজীব একেবারে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেছে। আর একটা জিনিস এখানে বলতে হয়। আমি দেখলাম, পলিন ওর হাতে করে ভিডিও ক্যামেরা আর মাইক্রোফোনটা নিয়ে এসেছে।  যে কোনও মুহূর্তে এখানে মৃত্যু আসতে পারে। কোস্টগার্ড তো দেখে গুলি চালাচ্ছে না। ওদের ওই গুলি যে কারও গায়ে লাগতে পারে, সেই সময় সব কিছু তুচ্ছ করে পলিন ওর ক্যামেরা আর আমার বুমটা নিয়ে এসেছে। ওই সময়, বিপদ যখন আমাদের চারদিকে ঘিরে ধরেছে, সেই সময়ও মনে মনে পলিনকে সাবাসি না দিয়ে পারলাম না। ধন্য তোমার পেশাদারিত্ব। ওই ক্যামেরাটা পলিন না আনলে আমরা যে এতো সাক্ষৎকার নিয়েছি সেটা হয়তো প্রকাশ করতে পারতাম না। এদিকে রাজীব কিন্তু ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। তবে রাজীবও দৌঁড়নোর সময় একটা কাজের কাজ করেছে। ওর ছোট ফোনটা হাতে করে নিয়ে এসেছে। আমার দুহাত খালি। আমি ট্রলার থেকে নেমেই দৌড় শুরু করেছিলাম। আমি রাজীবের থেকে ফোনটা চেয়ে নিলাম। তারপর ওকে একটু আশ্বস্ত করলাম। ফোনটা নিলাম কারন যদি বেঁচে ফিরতে পারি, তবে কোনও গাছের উপরে উঠে নেটওয়ার্ক খুঁজে ফোন করবো। ওদিকে গুলি কিন্তু থামেনি। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ এলাকা জুড়ে। তবে এতক্ষণ শুধু কোস্টগার্ডই গুলি করছিল। এবার শুরু হল জলদস্যুদের পাল্টা গুলি। আর এই গোলাগুলির মাঝখানে আমরা।

দূর থেকে আবছা লাগছে। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কারা গুলি ছুড়ছে দস্যুদের পক্ষ থেকে? প্রায় সব দস্যু তো পালিয়ে গেছে, তবে গুলি ছুড়ছে কে? গুলি ছুড়ছে একা মাস্টার ! সেদিনের সেই দৃশ্য যেন হলিউডের এক রোমহর্ষক চিত্রনাট্য। যদি কেউ সিলভেস্টার স্ট্যালনের Rambo দেখে থাকেন কিছুটা বুঝতে পারবেন। একটা জঙ্গলের ভেতরে একটা বন্দুক নিয়ে Rambo একাই ফাইট করছে। ঠিক সেই দৃশ্য যেন আমার চোখের সামনে। একা মাস্টার। একজন ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধা। পুরো এলাকা জুড়ে দৌড়ে দৌড়ে গুলি ছুড়ছে। দেখলে মনে হবে হয়তো অনেক লোক। অথচ মাস্টার একা। তার হাতে একটা এইট শ্যুটার বন্দুক। আর পিঠে থ্রি নট থ্ৰি বন্দুক। গুলির যে পোসেসটা (গুলি রাখার জায়গা ) তার সাথে রয়েছে সেটাও বিরাট বড়।

মানে এতটাই বড় যে একজন প্রাপ্তবয়স্কের পক্ষে হাঁটাও কষ্টকর। ওই পোসেসটা তার কোমরে বাঁধা। আর গুলির একটা ভারী ব্যাগ বহন করছে অপহৃত একজন বয়স্ক জেলে। সে শুধু মাস্টারকে সাহস দিয়ে যাচ্ছে, “মামা আফনে চিন্তা হরিয়েন না। আফনে বাঁচলে মুইও বাঁচমু।’’ সে মাস্টারকে গুলি ভরতেও সাহায্য করছে। আর মাস্টার মাত্র দু’টো বন্দুক দিয়ে ওই সময় এমন একটা পরিবেশ তৈরি করলো যেন দশ-বিশজন লোক একসাথে গুলি করছে। একটা লোক যার ট্রেনিং নেই , কিভাবে এইরকম অস্ত্র চালাতে শিখলো সেটা ভাবাই দুষ্কর। তবে মাস্টারের সব গুলি ছিল আকাশের দিকে তাক করা। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আতঙ্কিত করার জন্যেই মাস্টার গুলি ছুড়ছিল। কি বলবো! শুনেছিলাম সুন্দরবনের সব দস্যুনেতারা মাস্টারকে ভয় পায়। তার কারণ পরিষ্কার হয়ে গেল। এইভাবে চললো প্রায় চল্লিশ পয়তাল্লিশ মিনিট। ওই দিক থেকে কোস্টগার্ড মেগাফোন দিয়ে বার বার বলছিল, আপনাদের ঘেরাও করে ফেলেছি ,এবার আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, মাস্টারের পাল্টা আঘাত হতচকিত করে দিয়েছিল তাদেরকে। একসময় পিছু হটে কোস্টগার্ড চলে গেল। স্পিডবোট ঘুরিয়ে ফিরে যাবার সময় আর একবার তারা ব্রাশফায়ার করেছিল। অবশ্য মিনিট দুইয়ের মধ্যে গুলি আর স্পিডবোটের আওয়াজ মিলিয়ে যায়। ওই চল্লিশ মিনিটের যুদ্ধে মাস্টার শুধু তার কৌশল দিয়ে আটকে দিয়েছিল কোস্টগার্ড বাহিনীকে।  

এর মধ্যে আমাদের রাজীব ঘটিয়ে বসলো একটা ঘটনা। সে এতই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে আমাকে বললো, চলেন ভাই আত্মসমর্পণ করি। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কি বলে! এমনিতেই আমরা তখন কাদায় লেপ্টে শুয়ে আছি। কারণ বসলে যদি গুলি লাগে (বুঝতে পারছিলাম আমাদের উপর দিয়ে গুলি যাচ্ছে )। সেই সময় রাজীবের কথা শুনে আমার প্রথমে একটু হাসি পেল। বলে কি এখন! আত্মসমর্পণ করবো! আমি রাজীবের পিঠে একটা হাত রাখলাম— কি বলতেছেন আপনি? এখন কিভাবে সারেন্ডার করবেন?  ও আমাকে বললো, ভাই আমার হাতে যে গামছাটা আছে ওটা একটা লাঠিতে পেঁচিয়ে উড়াবো। আমি ওকে আশ্বস্ত করলাম। কিছু হবে না চুপ করে থাকেন। এদিকে পলিনের আবার একটু মাথা গরম। রাজীবের কথা শুনে ধমক দিয়ে উঠলো। -অ্যাই! পাগলের মতো কথা বলছেন। চুপ করে বসেন এখানে। রাজীব, পলিনের ওই মূর্তি দেখে চুপ করে গেল।

যাই হোক, একটু পরে বুঝতে পারলাম কোস্টগার্ড তাদের স্পিডবোট ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে। মাস্টার যে দিকে ছিল তার উল্টোদিক মানে খালের দিক থেকে গুলি করছিল কোস্টগার্ড। এবার তারা খালের দিক থেকে পিছিয়ে বাটলো নদীতে আসলো। আমি ওদের দেখতে পেলাম। ওরা ফিরে যাচ্ছে। হঠাৎ কোস্টগার্ড আমাদের দিকের জঙ্গলে ব্রাশফায়ার শুরু করলো। মেগাফোন দিয়ে ঘনঘন ঘোষণা করতে লাগলো। আত্মসমর্পণ করুন। আমি দেখলাম কয়েকজন অপহৃত জেলে নদীর পাশে গিয়ে কোস্টগার্ড বাহিনীকে হাত পা নেড়ে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলো। কোস্টগার্ডের ট্রলারটিও গুলি করতে করতে এগিয়ে এল। ওখানে বড়োজোর পাঁচ জনের মতো জেলে ছিলেন। কোস্টগার্ডের লোকেরা তাদের তুলে নিয়ে সোজা উত্তরের দিকে রওনা দিল। বুঝতে পারলাম, এই কোস্টগার্ড বাহিনী কাগা থেকে এসেছিল, এখন ওরা আবার সেখানেই ফিরে যাচ্ছে। আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে কাগার অফিস মাত্র ২০ মিনিটের পথ। ওরা যদি আবার ফিরে আসে, নিশ্চয় বড় বাহিনী সঙ্গে নিয়ে আসবে। আমার মনে হল, যা কিছু করার সেটা কোস্টগার্ড ফিরে আসার আগেই করতে হবে। কিন্তু করবো কি করে? সবে তো জোয়ার শুরু হয়েছে। ট্রলারগুলি সবকটাই কাদার উপরে লেপ্টে আছে। কি করে বেরুবো এখান থেকে? সেই চিন্তাই মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এদিকে কোস্টগার্ড যখন চলে গেল, কুই দেওয়া শুরু হল। কুই মানে একরকম ইশারা। হরিণ যে ভাবে ডাকে অনেকটা সেইরকম। ওই ডাক দিয়ে সুন্দরবনে একজন অন্যজনের অবস্থান বা অস্তিত্ব বুঝতে পারে। আমি শুনতে পেলাম সামনের দিক থেকে মাস্টারের কুই-এর আওয়াজ। তারপর বিভিন্ন দিক থেকে কুই-এর শব্দ ভেসে এল। এবার আমি কুই দিলাম। আর বিভিন্ন দিক থেকে আসা কুই-এর শব্দগুলি শুনে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম কার কুই কোনটা। আসলে আমি চেষ্টা করছিলাম মাস্টারের কুই কোনটা— সেটা খুঁজে বের করার। যাই হোক, কিছুক্ষণ কুই বিনিময় হল। বিনিময় মানে কেউ একটা কুই দিলে আমার দিক থেকে একটা। এইভাবে হয় কুই বিনিময়। কিছুক্ষন পরে কুই বিনিময় করতে করতে আমি দেখতে পেলাম মাস্টারকে। এবার পুরো কনফিডেন্স ফিরে পেলাম। প্রায় দৌঁড়ে গেলাম মাস্টারের কাছে। মাস্টার আমাকে দেখে যেন স্বস্তি পেল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘‘ওরে ভাই! এ কিসের মধ্যে পড়লাম আমরা ! কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল! কিন্তু আপনি ঠিক আছেন তো ভাই! বুঝলাম, মাস্টার যথেষ্ট চিন্তা করছিল আমাদের নিয়ে। আমাদের তিনজনকে অক্ষত দেখে সে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। একটু পরে মাস্টার আবার চিল্লাচিল্লি শুরু করল। এবার আমার উপর রাগ করে। কেন আমি এখানে ছিলাম। এখানে গোলাগুলি চলছে। যদি আমার কিছু হয়ে যেত। আমি ওকে কোনওমতে আশ্বস্ত করলাম। তাও তার রাগ কমছিল না। যাই হোক, এর মধ্যে সোহাগ-সহ অন্যরাও সেখানে চলে এল। এখন আমি, মাস্টার, সোহাগ আর বাকি চার-পাঁচজন দস্যু মিলে শলাপরামর্শ করছি কি করা যায়? এর মধ্যে কেটে গেছে প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট। সময় বয়ে গেছে অনেকটা। জোয়ার শুরু হয়েছে। আমাদের ট্রলারগুলো আবার পানিতে ভেসে উঠছে। কিন্তু এদিকে আমরা যে ট্রলারে যাবো সেটা তো নষ্ট।  কি করা যাবে? ও ট্রলার তো বেলায়েত ছাড়া কেউ ঠিক করতে পারবে না। আর বেলায়েতই বা কোথায়? কেটে তো গেছে অনেকক্ষণ! বেলায়তদের কথা ভেবে আবার দুশ্চিন্তা মাথায় চেপে বসলো আমার।

(ক্রমশ)

1 COMMENT

  1. ভাই দিন দিন মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি
    ভালোবাসা অবিরাম ভাই

Comments are closed.