স্কুল জীবনে প্রায় সব ছাত্রকেই বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ— রচনাটি পড়তে হতো। রচনাটিতে বিজ্ঞানের সুফল ও কুফল আলোচনার পর উপসংহারে বলা হতো, বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ, তা র্নিভর করে মানুষ কী ভাবে তাকে ব্যবহার করছে, তার উপর। অর্থাৎ, বিজ্ঞানের আশীর্বাদ বা অভিশাপ হয়ে ওঠা নিয়ন্ত্রণ করে মানুষ— একমাত্র মানুষ। বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলে মানুষ যখন ভোগ করে দীর্ঘ আয়ু, সুখ, সীমাহীন স্বাচ্ছন্ন— শুরু হয় বিজ্ঞানের আশীর্বাদ যাত্রা। আবার এই বিজ্ঞানের হাত ধরেই সৃষ্টি হয় ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। শোনা যায়, হিরোশিমা-নাগাসাকির হাহাকার। বিজ্ঞান হল বিশেষ ভাবে লব্ধ জ্ঞান। এই নৈব্যক্তিক জ্ঞানই মানুষের হাতে পড়ে হয়ে ওঠে শুভ বা অশুভ।
মানুষকে যা ধারণ করে রাখে, তাই-ই ধর্ম। সেই কারণে ধর্মকে শুধুমাত্র আফিম বলে চিহ্নিত করা অতিসরলীকরণ, অযৌক্তিক। শ্রী রামকৃষ্ণ বলতেন, একজন লোক প্রদীপের আলোতেই ভাগবত পাঠ করছে। আর একজন সেই প্রদীপের আলোতেই দলিল জাল করছে। এখানে আগুনের কী দোষ! সে তো নির্লিপ্ত। তাকে ব্যবহার করে যে অন্যায় কাজ করছে, দোষ তার।
একই কথা ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ছড়িয়ে থাকা আলোকরশ্মিকে যদি একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করা যায়, তা হলে হয় কাগজে আগুন ধরে যায়। প্রাচীনকালে ভারতীয় ঋষিরা ধ্যানের সাহায্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মনকে একাগ্র করে একটি বিন্দুতে সংহত করার কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন। ফলে তাঁরা তাঁদের ধী-শক্তি তথা ইন্দ্রিয় শক্তিকে উচ্চতম চূড়ায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই অসাধারণ শক্তিসম্পন্ন ইন্দ্রিয় শক্তির দ্বারা তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন, সত্য স্বরূপ, সর্বময় ব্রক্ষ্ম তথা ইশ্বরের অস্তিত্ব। ঋষিরা বললেন, এই পরিবর্তনশীল জগতের সবকিছু ঈশ্বররূপ মহাশক্তির দ্বারা আচ্ছাদিত। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান এবং সর্বত্র বিরাজমান। এই পথ ধরেই সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের মানস নেত্রে উন্মোচিত হল সৃষ্টি রহস্য। তাঁরা উপলব্ধি করেন, এই বিশ্বে আমরা একলা নই। একই উৎস থেকে সবাই উৎসারিত। এবং সেই উৎসের সাথে নিবিড় সম্পর্কে সম্পর্কিত। সেই সর্বময় চেতনার সুরে সুর মেলাবার ক্ষমতা সবার প্রাণে খেলা করে। তাকে আত্মস্থ করতে হবে। তাই তো ধষি-কবি লেখেন, ‘বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেই সাথে যোগ তোমার সাথে আমারো।’ অর্থাৎ, বিশ্বপ্রাণের সাথে একীভূত হতে পারলেই সেই সর্বময় সত্ত্বার সাথে যুক্ত হওয়া যায়। মহান ঋষিরা আরও বুঝেছিলেন, সেই সর্ববিস্তারী সত্ত্বা বহু হয়েও এক। সমগ্র সৃষ্টির সাথে একাত্মতা ও সবার সুরে সুর মেলাবার বাণীই বহন করে অধ্যাত্ম শাস্ত্র, বেদ-বেদান্ত। ভারতীয় অধ্যাত্ম দর্শন বিশ্বাস করে ত্যাগ ও প্রেম হল সৃষ্টি রক্ষার প্রাথমিক শর্ত। সবাইকে ভালবাসো— এই হল সনাতন ধর্মের মূলকথা।
ধর্ম আফিম নয়
বেশিদিন আগের কথাই নয়, পাঁচশো-সাড়া পাঁচশো বছর আগে এই বাংলার নবদ্বীপে চৈতন্যদেবের নেতৃত্বে ধর্মকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়েছিল এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলন। গণরকীর্তনের জোয়ারে তৈরি হয়েছিল এক মহাপ্লাবী জনজাগরণ। ভেসে গিয়েছিল শাসকের ক্ষমতার দম্ভ। নিবৃত্ত হয়েছিল জগাই-মাধাই রূপী দুর্বত্তদের আস্ফালন, মুছে গিয়েছিল মানুষে মানুষে বিভাজন, অস্পৃশ্যতা। সমাজ গ্রহণ করল মানুষের ধর্ম, প্রেমের ধর্ম। যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছিল সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ভাবনায়। মানুষ উপলব্ধি করল, ‘ভালবাসা, শুধু ভালবাসা চাই, ভালবাসা সম্বল’। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ধর্মের প্রকৃত রূপ জনকল্যাণকারী। আর যা কিছু অপব্যবহার, তার পিছনে রয়েছে স্বার্থান্ধ কিছু মানুষের সীমাহীন লোভ ও লাগামহীন আকাঙ্ক্ষা। এই বাংলায় প্রচলিত সতীদাহ, গৌরীদানের মতো নারীদের চরম অবমাননার মতো মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের সংগঠক ছিলেন একদল কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ। বিবেকানন্দ বলেছেন, ধর্মকে কেন্দ্র করে মানুষ, সমাজ ও সভ্যতার যে ক্ষতি হয়, তার জন্য দায়ী ধর্মকে ব্যবহার করার পদ্ধতি। ধর্মকে যারা স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করে, বাণিজ্যের উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করে, তারাই ধর্মের নামে সমাজে অশান্তি, বিদ্বেষ ও রক্তপাত নিয়ে আসে। এ সব কিছুর জন্য ধর্মকে দোষ দেওয়া উচিত নয়।
তাই এই সঙ্কটের সময়ে চিরকল্যাণকারী ধর্মীয় শুভ ভাবনা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার দায় আমার আপনার সকলের।