মুকন্দপুর যাচ্ছিলাম। হার্টের রুটিন চেক আপ। বিধাননগর থেকে গড়িয়ার বাস। কিন্তু মুকুন্দপুরের বেশ কিছুটা আগেই কয়েকবার কঁকিয়ে একেবারে নিশ্চুপ। নেমে অন্য বাস ধরব কি না— সেই দোটানার মধ্যেই ড্রাইভার ফোন করে দিয়েছে টাটা কোম্পানির টোল ফ্রি নম্বরে। সঙ্গে সঙ্গে জিপিএস ট্র্যাকিংয়ে দেখে নিয়ে কাছাকাছি থাকা মান্না মোটর গ্যারেজ থেকে মিস্ত্রি হাজির। তারা এসেই ল্যাপটপ নিয়ে ড্রাইভারের সিটে বসে ড্যাশবোর্ডে জ্যাক গুঁজে দিয়ে চেক-আপ করতে লাগলো। তারপর বনেট খুলে চৌকো মতো একটা প্লাগ পাল্টে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাস স্টার্ট।
বুঝলাম, জগৎ অনেক বেশি স্মার্ট হয়ে যাচ্ছে, পাল্লা দেওয়া কঠিন। ধুলো-কালি মেখে, বাসের নীচে শুয়ে পড়া মেকানিকদের দিন হয়তো শেষ। কয়েক মিনিট আগেই মিস্ত্রি না ইঞ্জিনিয়ার ওই দু’জন বাসের মাইক্রো চিপসের প্যানেলে তাঁদের খেল দেখিয়ে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে, সেমিকন্ডাকটর চিপস কী ভাবে আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠছে।
করোনা জগৎটাকে একেবারে পাল্টে দিয়ে গেল। অনলাইন পড়াশুনা, ঘরে বসে অফিস। দরকার কম্পিউটার-স্মার্ট ফোন— মানেই মাইক্রো প্রসেসর চিপস। গাড়ির চাহিদাও ফের ঊর্ধ্বমুখী। রকেট গতিতে বাড়ছে চিপসের চাহিদা। একটা মোবাইলে লাগে ডজনখানেক চিপস। লেটেস্ট মডেলের গাড়িতে প্রয়োজন ১০টির মতো প্রসেসর আর ৪০-১০০টি চিপস। তবে লাগবে তো ঠিকই, মিলছে কোথায়? চাহিদা সত্ত্বেও স্রেফ চিপস ঘাটতির জন্য প্রায় ৮০ লক্ষ গাড়ি তৈরি করা যায়নি। আগে অর্ডার-ডেলিভারির ব্যবধান ছিল এক সপ্তাহ, অতিমারির ধাক্কায় সেটা এখন ছ’মাস। বিশেষজ্ঞদের মতে, চিপস ও দক্ষ প্রযুক্তিবিদের ঘাটতি ক্রমশ বাড়বে। আবার ৫জি এলে চিপসের চাহিদাও বাড়বে বহুগুণ।
প্রথম ষ্টীম ইঞ্জিন, দ্বিতীয় তড়িৎ এবং তারপর তথ্যপ্রযুক্তি যদি তৃতীয় শিল্প বিপ্লব ঘটিয়ে থাকে, তাহলে এখন চিপস নির্ভর ডিজিটাল প্রযুক্তির চতুর্থ শিল্প বিপ্লব চলছে। মোটা দাগে চিপসগুলি বিভিন্ন ধরনের মাইক্রো প্রসেসর, মেমরি চিপস,স্ট্যান্ডার্ড চিপস, গ্রাফিক কার্ড এবং soc (system on chips) বা বিশেষ কাজের বিশেষ চিপস্। এগুলি আসলে অতি ক্ষুদ্র পরিসরে ট্রানজিস্টারের অজস্র গেট বর্তনী। চিপস তৈরি হয় অতি পাতলা সেমিকন্ডাক্টর জালি যাকে ওয়েফার বলে, তার মধ্যে কোটি কোটি ট্রানজিস্টরের গেট বর্তনী প্রিন্ট করে। একলাইনে বললেও এটা কিন্তু অতি জটিল প্রক্রিয়া। কাজটিকে বলা হয় ফেব্রিকেশন আর কোম্পানিগুলিকে ফাউন্ড্রি বলে। চিপসের বিশাল বাজারের সিংহভাগ এখন তাইওয়ানের দখলে (৬৩%), এরপর দক্ষিণ কোরিয়া (১৮%) ও চিন(৬%)। অর্থাৎ, বিশ্ববাজারের ৮৭% তিন দেশের কব্জায়।
ভারত এ জগতে নিতান্তই লিলিপুট। তবে আটের দশক থেকে শুরু করে ভারত আজ সফটওয়্যার বিশ্বে একনম্বরে। আমেরিকা বাদে ভারতেই রয়েছে সর্বোচ্চ সংখ্যক চিপস ডিজাইন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। সারা বিশ্বের ২০%। চিপসের বহুজাতিক সংস্থাগুলির ৯০টির মতো শাখা রয়েছে বেঙ্গালুরুতে। বিশ্বে যখন দক্ষ প্রযুক্তিবিদের অভাব, ভারতে তখন উল্টো ছবি, আধিক্য। সুতরাং কাঠামো তৈরি, প্রতিমা গড়াটাই যা বাকি। সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেমের জন্য ভারত অনেক দূর যেতে পারে বলেই ইঙ্গিত মিলছে। সম্প্রতি সেমিকন্ডাক্টরের সমগ্র ক্ষেত্র ধরে ৭৬০০০ কোটি টাকার উৎপাদন উৎসাহ প্রকল্প (pli) ঘোষণা করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশে চিপস ব্যবহারে এখন খরচ হয় ৮০০০ কোটি ডলার, ২০৩০ সালে তা পৌঁছবে ১১০০০ কোটি ডলারে।
তবে ভারতে এখনও চিপসের সবটাই আমদানি নির্ভর। টাটা, বেদান্তের মতো কয়েকটি সংস্থা বড় পুঁজি নিয়ে মাঠে নেমেছে। সবাই প্রধানত OSAT (Outsourced assembly & testing)কে পাখির চোখ করতে চাইছে। টাটারা ইতিমধ্যেই তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ায় যোগাযোগ করেছে। ফক্সকনের সাথে মোবাইল চিপস ও ডিসপ্লে তৈরির চুক্তি পাকা করতে চলেছে বেদান্ত। Intel চাইছে ভারতে সেমিকন্ডাক্টর ফাউন্ড্রি বানাতে। সব মিলিয়ে, চিপস-বাজারের লড়াইয়ের ময়দানে জমি তৈরি হচ্ছে ভারতের।