নারীপাচার পর্ব ২৬

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

বৈদিক যুগের সূচনাকাল থেকেই নারী-পুরুষ সমান অধিকার নিয়ে বিদ্যাশিক্ষা, জ্ঞানচর্চা ও ধর্মাচারে অংশগ্রহণ করত। নারীদের চারুকলা বিদ্যার শিক্ষা দেওয়া হতো; যেমন কণ্ঠসংগীত, যন্ত্রসংগীত, নৃত্য ইত্যাদি। ঋগ্বেদে দেখা গিয়েছে বিশেষ কোনও অনুষ্ঠানে মেয়েরা গান গাইছেন। ঋগ্বেদে নারীদের নৃত্য পারদর্শিতার বহু উল্লেখ রয়েছে। মহাভারতেও পাই নারীরা গান গাইছেন এবং নানা বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন। এগুলি নারীরা শুধু নিজেদের শখ মেটানোর জন্য করছেন তা নয়; অন্যের চিত্ত বিনোদনের জন্যও করছেন।

    বৈদিক যুগের পর স্মৃতির যুগে সাধারণ মহিলারা গৃহবন্দী হয়ে পড়ল, তাদের চারুকলা চর্চায় ছেদ না পড়লেও বিনোদন জগতে তাদের অবাধ অংশগ্রহণ রইল না। মানুষকে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে গেলে বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবেই। বিনোদন জগতে নারীদের স্থান নিলেন নগর-নটী বা রূপোপজীবিনীরা। 

    মৌর্য ও গুপ্তযুগে রূপোপজীবিনীরা নগরবাসীর বিনোদন করে প্রভূত উপার্জন করতেন। এজন্য তাদের রাজকর দিতে হতো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আছে, রূপোপজীবিনীদের মাসে দু’দিনের আয় রাজকর হিসাবে দিতে হবে। বিদেশাগত নট, নর্তকদের প্রদর্শনী পিছু পাঁচপণ রাজকর হিসাবে দিতে হবে। যেসব আচার্য গণিকা, দাসী, রূপোপজীবিনীদের গীতবাদ্য, নৃত্য, অক্ষরজ্ঞান, চিত্রকলা, যন্ত্রসংগীত, গন্ধদ্রব্য প্রস্তুতি, অঙ্গমর্দন, মাল্যনির্মাণ ও কামকলা শিক্ষা দেবেন, তাদের রাজ সরকার থেকে বৃত্তির ব্যবস্থা করা হবে। গণিকাপুত্রদের মধ্যে যারা নৃত্য-গীতাদিতে পটু তারাই আচার্য পদভূষিত হবেন। 

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে বাৎসায়ন রচিত কামসূত্রে নারীদের চৌষট্টি প্রকার অঙ্গবিদ্যা বা কলা শিক্ষণীয় ছিল। তার মধ্যে প্রধানগুলি হল গীত, বাদ্য, নৃত্য, ক্রীড়া, চিত্রবিদ্যা, মাল্যরচনা, সীবনবিদ্যা, কাব্য রচনা, বৃক্ষপালন, তক্ষনবিদ্যা, শয়ন রচনা, শরীর পঠনবিদ্যা, যুদ্ধবিদ্যা, ব্যায়াম ইত্যাদি। বাৎসায়ন বলেছেন, নারী যৌবনের পূর্বে পিতৃগৃহে থেকে কামশাস্ত্র এবং তার অঙ্গবিদ্যাগুলি আয়ত্ত করবে, বিবাহিতা হলে স্বামীর অভিপ্রায় অনুসারে এই বিদ্যা গ্রহণ করবে। এই বিদ্যা দেবে বিশ্বাসযোগ্য কোন স্ত্রী, যে পূর্বে পুরুষ সঙ্গমে প্রবৃত্ত হয়েছে। বাস্তবে গৃহস্থ জীবনে এই বিদ্যা কতটা কার্যকর হয়েছিল— আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তা বলা মুশকিল; তবে বারবণিতারা এই বিদ্যা গ্রহণ করতেন। 

      বাৎসায়ন বারবণিতাদের প্রধানত তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিলেন— গণিকা, রূপাজীবা ও কুম্ভদাসী। এদের প্রত্যেকটিকে আবার উত্তম, মধ্যম ও অধম শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। কোন শ্রেণীর তা বোঝা যাবে তার জীবন যাপনের ধরন দেখে ও বাইরের শ্রীসম্পদ দেখে। এদের মধ্যে রূপোপজীবিনীদের রুচি সতন্ত্র। এদের মধ্যে নায়িকাগুণ এবং চারুকলার রুচি বর্তমান। কুম্ভদাসী আসলে বেশ্যাপতির দাসী বা কুট্টনী। 

         এইজন্য প্রাচীন কাল থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বঙ্গদেশে বিনোদন তথা সংস্কৃতির অঙ্গনে বারনারী তথা রূপোপজীবিনী ছিলেন পথিকৃৎ। তবে বাংলার অভিনয় জগতে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত নারীদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। তখন ছেলেরাই মেয়ে সেজে অভিনয় করত। ১৮৭৩ সালে ১৬ আগস্ট বেঙ্গল থিয়েটার-এ মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘শর্মিষ্ঠা’ থিয়েটার অভিনীত হয়, তাতে এলোকেশী ও জগত্তারিণী নামে দুই নিষিদ্ধপল্লীর বেশ্যা অভিনয় করলেন। এই নাটকে অবশ্য গোলাপসুন্দরী ও শ্যামাসুন্দরী নামে আরও দুই রূপোপজীবিনী অভিনয় করেছিলেন, তবে প্রথম রাতে নয়। তার আগে যাত্রা, নাচ, ঝুমুরে বেশ্যারা অভিনয় করেছেন; থিয়েটারে এই প্রথম।পরবর্তীকালে পতিতাপল্লী থেকে আগত বিনোদিনী দাসী, তিনকড়ি, তারাসুন্দরী ছিলেন সফল অভিনেত্রী। 

    শুধু থিয়েটার জগতে নয়, সংগীত জগতে এক্ষেত্রে নাম করা যায় কমলাঝরিয়া, মানদাসুন্দরী দাসী, কুসুমকুমারী, গাঙ্গুবাঈ, ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালাদের— যাঁরা প্রভূত সুনাম অর্জন করেছিলেন। চলচ্চিত্র জগতেও বারাঙ্গনা বা তাদের কন্যারা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। কলা ও সংস্কৃতির জগতে এদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। 
আরেকটু পিছনে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি—কলকাতায় তখন “বাবু কালচারের” যুগ। বাবুবাড়িতে দুর্গাপূজা, দোল, রাসের ধুম। সেই ধুমের প্রধান অঙ্গ ছিল বাঈনাচ। বাঈনাচের আসরে কে কত পয়সা উড়িয়ে বাবুমহলে নাম কিনতে পারবে তার প্রতিযোগিতা হতো দুর্গাপূজার সময়। শোভাবাজার রাজবাড়ি দুর্গাপূজার বর্ণনায় আছে, “মাঝখানের বিশাল অঙ্গনে হিন্দু নর্তকীদের নাচ গান চলছে। সাহেব অতিথিরা চারিদিকে কৌচে বসে তন্ময় দেখছেন। মাঝে মধ্যে মুসলমান বাঈরা হিন্দুস্থানী গান গেয়ে ও রঙ্গতামাশা করে আসরের সকলকে আপ্যায়ন করছে।” এই বাঈরা হতেন সাধারণত মুসলিম। ১৮২০ সালে পূজার সময় কোনও বাবুর বাড়িতে বাঈনাচ হয়নি। কারণ ওই বছর দুর্গাপূজা ও মহরম একই সঙ্গে ছিল। ১৮২৯ সালের পর শহরে বাঈনাচের আসর বিশেষ জমেনি। 

     দেখা যাচ্ছে, বিনোদন জগতে বারবণিতা তথা রূপোপজীবিনীদের বরাবর চাহিদা ছিল। বিনোদন তথা সংস্কৃতি জগৎ তাদের খ্যাতি দিয়েছে অবশ্যই। ঘুরিয়ে বলা যায়, এই বিনোদন তথা সংস্কৃতি জগৎ রূপোপজীবিনীদের উৎসাহিত করেছে। রূপোপজীবিনীদের যোগানে নারীপাচারের একটা ভূমিকা থেকেই যায়।    

তথ্যঋণ:- 
১. বাৎসায়নের কামসূত্র – ডঃ মুরারিমোহন সেন - (নবপত্র প্রকাশন)। 
২. কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র - সুকুমার সিকদার (অনুষ্টুপ)। 
৩. মহীয়সী ভারতীয় নারী - সম্পাদক স্বামী মাধবানন্দ (উদ্বোধন)। 
৪. বাঙালী নারী: হাজার বছরের ইতিহাস – মাহমুদশামসুল হক [হাতেখড়ি (বাংলাদেশ)]। 
৫. অন্য কলকাতা - বিশ্বনাথ জোয়ারদার (আনন্দ পাবলিশার্স)।