কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পুজো
কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পুজো

বুড়িমা এবছর আড়াইশো বছরে পা দিল। অবশ্যই কোন মানবী নন। ইনি মা জগদ্ধাত্রী। কৃষ্ণনগরের ‘বুড়িমা”।
কৃষ্ণনাগরিকদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যাবে। ভাগ করা যাবে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানেও। কিন্তু সকলের নাড়ি টিপলে অনুভূত হবে, একমাত্র বুড়িমাই সমস্ত কৃষ্ণনাগরিকদের হৃদয়ে একই ছন্দে বাজে। সেখানে কোন ভেদ নেই। বুড়িমার নামে সবাই এক পতাকা হাতে বিসর্জনের শোভাযাত্রায় একসঙ্গে হাঁটে। সেই উন্মাদনা যিনি চাক্ষুষ করেছেন, একমাত্র তিনিই জানেন। সারা কৃষ্ণনগর বুড়িমার জন্য আনন্দে, আবেগে, চোখের জলে ভেসে যায়।
কথিত আছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মুর্শিদাবাদের নবাব আলিবর্দী খাঁ-র কর প্রদানে অপারগ হওয়ায় বন্দি হন। মতান্তরে, নবাব ১২ লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করেছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র তা দিতে অস্বীকার করায় বন্দি হন। মুক্ত হয়ে তিনি যেদিন কৃষ্ণনগরের ফিরলেন, সেদিন দুর্গা পুজোর দশমী। শেষ বিকেলে কানে এলো ঢাকের বাজনা। ততক্ষণে মা দুর্গার বিসর্জন হয়ে গিয়েছে। দুর্গাপুজো করতে না পারার পাপবোধে রাজা ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। ব্যথিত কৃষ্ণচন্দ্র নাকি স্বপ্নাদেশ পান মা দুর্গার অপর রূপ জগদ্ধাত্রীকে পুজো করার। কৃষ্ণনগর তথা এই বঙ্গে সেই থেকে সূচনা হয় জগদ্ধাত্রী পুজোর (১৭৬৬)। এর কয়েক বছর পর শুরু হয় চাষাপাড়া বারোয়ারির পুজো। পরবর্তীকালে যা ‘বুড়িমা ‘ নামে পরিচিত হয়।

কথিত আছে, এক সময় পুজোর বিপুল ব্যয়ভার বহন করতে রাজা চিন্তিত হয়ে পড়েন। মা জগদ্ধাত্রী স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন, চাষা পাড়ার লেঠেলরা পুজোর আয়োজন করবে। ১৭৭২ সালে শুরু হয় চাষাপাড়ার পুজো। ১৭৯০ সাল নাগাদ গোবিন্দ ঘোষ ঘট ও পটের পরিবর্তে প্রতিমা রূপে দেবীর পুজা শুরু করেন। আনুমানিক ৭০-৭৫ বছর আগে চাষা পাড়ার মা জগদ্ধাত্রী বুড়িমা নামে অভিহিত হয়। কৃষ্ণনগরের প্রাচীনতম বারোয়ারি পুজো বলেই ‘বুড়িমা’ নামকরণ হয়েছিল বলে প্রবীণ নাগরিকেরা মনে করেন। অন্যান্য মতও প্রচলিত রয়েছে।
বুড়িমা আজ কৃষ্ণনগরের ‘মিথ’। মানুষের বিশ্বাস, মুশকিল আসান, কোথাও যেন নাগরিকদের অদৃশ্য ভরসার স্থল। এ যেন বিশ্বাসে মিলায় বস্তু….। পুজোর দিন লাইন দিয়ে সোনা- রূপোর গহনা, শাড়ি প্রদানের ধুম পড়ে যায়…। প্রতিমা সেজে ওঠে সোনার গহনায়। অনুমান করা হয়, বুড়িমার গহনার পরিমাণ ৫০০ থেকে ৭০০ ভরি। পুজোর দিন ৪০ কুইন্টাল গোবিন্দভোগ চালের ভোগ রান্না করা হয়। যা প্রায় ৬০ হাজার ভক্তের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বুড়িমার প্রসাদ পৌঁছে যায় প্রায় পৃথিবীর সব দেশে। যার বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় কোটিতে! বুড়িমার সবকিছুই যেন সম্মোহনে মোড়া, হাজার হাজার মানুষের একসঙ্গে অঞ্জলি প্রদান থেকে শুরু করে, দর্শক সমাগম প্রশাসনের ঘাম ঝরিয়ে দেয়। পুজোর ধার্য খরচ আনুমানিক ৫০ লক্ষ টাকা হলেও সেটা বেড়ে কোথায় দাঁড়ায় বলা মুশকিল ! তবে বুড়িমার চাঁদা কারও কাছে গিয়ে তোলা হয় না। ভক্তরা এসে চাঁদা প্রদান করে। ৫০-৬০ হাজার চাঁদার বিল নিঃশেষ হয়ে যায় পুজোর দুপুরে! নবমীর দিন হয় কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো। সপ্তমী অষ্টমী নবমী এবং দশমীর পুজো একদিনেই সম্পন্ন হয়। পুজো পরিচালনার দায়িত্ব থাকে সম্পাদক গৌতম ঘোষের উপর। তাঁর পিতামহ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সম্মিলিত ভাবে ৮০ বছর ধরে এই পুজোর পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছে ‘ঘোষ পরিবার’।

বারোয়ারি পুজোর এ-ও এক অনন্য নজির ।লক্ষ লক্ষ মানুষ বুড়িমাকে একবার দেখার জন্য আকুল হয়ে ওঠে। জনজোয়ার রাত পেরিয়ে ভোরেও শেষ হয় না। পরদিন শুরু হয় ঘট বিসর্জনের আয়োজন। সকালবেলা ঘট বিসর্জনে শোভাযাত্রা দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষ রাস্তার ধারে ভিড় জমায়। রাতে সব ঠাকুরের পর হয় বুড়িমার ভাসান। সাঙে বুড়িমা চলেন রাজবাড়ি হয়ে জলঙ্গি নদীর ধারে। কদমতলা ঘাটে। সাঙ অর্থাৎ বেহারাদের কাঁধে চড়ে বাঁশের মাচায় বিশাল আকারের বুড়িমা-মূর্তি তড়তড়িয়ে এগিয়ে চলে। এ দৃশ্য অন্য কোথাও মেলা ভার ! সামনে দৌঁড়য় যুবকের দল। হাতে হাতে ঘোরে বুড়িমা লেখা পতাকা। কৃষ্ণনগর তখন একটাই নামে চিৎকার করে, বুড়িমা বুড়িমা …। কখনও‌ বুড়িমার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সৌভাগ্য হলে, মৃন্ময়ী মূর্তির টানা-টানা চোখের দিকে তাকালে বোঝা যাবে বুড়িমা কীভাবে চিন্ময়ী হয়ে ওঠে।